ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

আশুরার মর্মকথা

Daily Inqilab এ.কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী

২৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:১৫ পিএম | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০২ এএম

বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতের বছরের প্রথম মাস আল মুহররম। এই শব্দটি আসলে গুণবাচক বিশেষণ, নামবাচক বিশেষ্য নয়। ইসলামের আগমনের বহু পূর্ব হতে প্রাচীন আরবে বছরের প্রথম দুই মাস ছিল যথাক্রমে সাফার ও সাফার। আল মুহররম ও সাফারের পরিবর্তে আল সাফারাইসি এই দ্বিপাক্ষিক রূপের ব্যবহার দেখে তা সহজেই অনুভব করা যায়।

আরবের বর্ষপঞ্জির ইতিহাস গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করলে দেখা যায়, প্রাচীন আরবে বছরের প্রথম অর্ধাংশে তিনটি মাস ছিল। যথা: সাফার, রবি ও জুমাদা। এই তিনটি মাসের প্রত্যেকটিতে দুটি করে মাস ছিল। যেমন প্রথম সাফার, দ্বিতীয় সাফার, প্রথম রবি, দ্বিতীয় রবি, প্রথম জুমাদা, দ্বিতীয় জুমাদা। যেহেতু দুই সাফারের পরে দুই রবি ও দুই জুমাদা ছিল এবং দুই সাফারের প্রথমটি অলক্ষণীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম মাস ছিল বলে এর গুণবাচক অ্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘আল মুহররাম’। যুগ ও কালের ক্রমধারায় আল মুহররম আখ্যাটিই প্রথম সাফারের পরিবর্তে ধীরে ধীরে বছরের প্রথম মাসের নাম হয়ে গেছে। আর সাফারের সানী মাসটি সাফার নামে আখ্যায়িত হয়েছে। তবে বছরের শেষ অর্ধাংশের মাসগুলোর নাম পূর্ববৎই রয়ে গেছে। যথা: রাজাব, শাবান, রামাদান, শাওয়াল, জুলকাদা, জুলহিজ্জা। জুলহিজ্জা মাসও অলক্ষণীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম হওয়ায় অধি বছর ছাড়া অন্যান্য বছরে চারটি অলক্ষণীয় পবিত্র মাসের তিনটি একাধিক্রমে আসত। যেমন- জুলকাদা, জুলহিজ্জা ও মুহররম। আর রজব মাসটি পৃথকভাবে আসত, যা অদ্যবধি একই রকম আছে।

মহান রাব্বুল আলামীন, চন্দ্রকেই সময়ের পরিমাপক রূপে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে: তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এটা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এই সকল নিদর্শন বিষদভাবে বিবৃত করেন। (সুরা ইউনুস: আয়াত-৫)।

এই আয়াতে কারিমায় চাঁদের জন্য মানযিল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী জ্যোতির্বিজ্ঞানে চান্দ্র মাসকে ২৮টি মানযিলে ভাগ করা হয়েছে। চান্দ্রমাসের এই মানযিলকে বাংলা ভাষায় তিথি বলা হয়।

তবে চান্দ্র বছরকে সৌর বছরের সাথে একই পর্যায়ে আনায়ন করার জন্য অধি বছর সূত্রে একটি মাসকে বর্ধিত করা হতো। বর্ধিত এই মাসটিকে জুলহিজ্জার পরে সংযুক্ত করার নিয়ম ছিল। কিন্তু এই বর্ধিত মাসটি অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস হতো না। এর ফলে মুসলিম জ্ঞানী চিন্তাবিদগণ এরূপ গর্হিত মাস বৃদ্ধি করাকে সংশ্লিষ্ট মুহররম (অলঙ্ঘনীয় পবিত্র) মাসের নতুন করে সাফার নাম দেওয়ার শামিল বলে উল্লেখ করেন। এর দ্বারা আল মুহররম (অলঙ্ঘনীয়, পবিত্র মাসকে) লঙ্ঘনীয় মাসে পরিণত করা হয়। এটা আল্লাহপাকের প্রদত্ত বছর গণনার নির্দেশের পরিপন্থী। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস (যুলকাদা, যুলহিজ্জা, মুহররম ও রাজাব) এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে। যেমন তারা তোমাদের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রেখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। এই যে মাসকে পিছিয়ে দেয়া কেবল কুফুরীকে বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিরদের বিভ্রান্ত করা হয়। তারা একে কোনো বছর বৈধ করে এবং কোনো বছর অবৈধ করে, যাতে তারা আল্লাহ যেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলোর গণনা পূর্ণ করতে পারে। তাদের মন্দ কাজগুলো তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে। আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (সুরা তাওবা: আয়াত ৩৬-৩৭)। এই আয়াতে কারীমার দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, বছর গণনায় বর্ধিত মাসের কোনো স্থান নেই।

এতো কিছুর পরও প্রাথমিক যুগে বর্ধিত মাস প্রবর্তন করে চান্দ্র বছরকে সৌর বছরের সমপর্যায়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অপচেষ্টা আদৌও ফলবতী হয়নি। কারণ এই যে, প্রাচীন আরবে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত অভাব ছিল প্রচুর, সে যুগে শীতকালীন অর্ধ বছর আরম্ভ হতো আল মুহররম মাস দ্বারা। প্রথম ছয় মাসের নাম দেখলে তা সহজেই বোঝা যায়। ইয়াহুদি বছরের ন্যায় আরব বছরও শরৎকালে আরম্ভ হতো।

আল কোরআনের ৯নং সূরা তাওবাহ-এর ৩৭ নং আয়াতে বর্ধিত মাস যুক্ত করার রীতি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর মুসলিম বছরের সমস্ত ঋতুতেই ঘুরে ফিরে আসে। কারণ, বারটি চান্দ্রমাসে সর্বদাই তিনশত চুয়ান্ন বা তিনশত পঞ্চান্ন দিন পাওয়া যায়। যেমন বর্তমানে পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।

আল মুহররম মাসের দশম দিবসকে আশুরা বলা হয়। হাদীস শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরত করার পর ইহুদিদের নিকট হতে জানতে পারলেন যে, এই আশুরার দিন হযরত মুসা (আ.) জালিম কাফের ফেরাউনের বন্দিদশা হতে ইসরাইলি-বংশধরদের উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউন সসৈন্যে সাগরে ডুবে মরেছিল। এ কারণে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় স্বরূপ হযরত মুসা (আ.) এই দিনে রোজা পালন করেছিলেন এবং একই কারণে ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা রাখে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা হযরত মুসার সাথে আমাদের সম্পর্ক অগ্রাধিকারমূলক এবং নিকটতম। তখন হতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং এইদিনে উম্মাতগণকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। হাদীস শরীফে এতদসংক্রান্ত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা: (ক) রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে আশুরার রোজা পালনের আদেশ দান করেছেন এবং তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। (খ) কতিপয় সাহাবী-রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আরজ করলেন, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আশুরাকে বড় মনে করে। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমি আল মুহররমের নবম দিনও রোজা রাখব। (গ) পরবর্তীতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর হতে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীগণকে আর আশুরার রোজার আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না। (ঘ) অবশ্য তিনি নিজে রমজানের রোজার অনুরূপ গুরুত্বসহকারে বরাবর আশুরার রোজা পালন করতেন। (ঙ) তিনি বলেছেন: রমজানের রোজার পর সর্বাপেক্ষা আফজল মুহররমের এই রোজা। বস্তুত আশুরার উল্লেখ দশই মুহররম অর্থে সুপ্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। যার আবহ এখান পর্যন্ত একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। কতকগুলো ইসলামী অনুষ্ঠান ও রীতি প্রাচীন আরবদের বিশেষত হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধরদের মধ্যে তারই নির্দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। যার ফলে আশুরার মর্যাদা বহুগুণে বর্ধিত হয়েছিল। তবে, এই দিনে শুহাদায়ে কারবালার রূহের মাগফেরাত ও মানজেলাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুসলিম মিল্লাত দোয়া ও মোনাজাত করে থাকেন। এটা বড়ই বরকতময় কাজ।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা