সঙ্কটে গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদিতার শেকড় উন্মোচন
০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
![](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2023December/4-20231231210132.jpg)
৫ বছর আগে ফ্রিডম হাউসের প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০১৭ সালের পূর্ববর্তী এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছেছে। এটা কর্তৃত্ববাদিতার উত্থান, বিপর্যস্ত গণতন্ত্র ও মানব স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের সময়কালকে প্রতিফলিত করেছে। এর কারণ হিসাবে বলা হয়, এ সময়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতিগুলি বিশ্বজুড়ে আক্রমণের মুখে পড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা, সংখ্যালঘুদের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন।
এ সময়কালে একাত্তরটি দেশ রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতায় নিট পতনের শিকার হয়েছে, মাত্র ৩৫টিতে এ সবের উন্নতি হয়েছে। আর এ সময়টিতে আমেরিকান রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ত্বরান্বিত পতনের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন ও গণতন্ত্রের উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহ্যগত ভূমিকা থেকে পিছু হটেছে। ২০০৬ সালে ১২ বছরের বৈশ্বিক স্লাইড শুরু হওয়ার পর থেকে, ১১৩টি দেশে নিট পতন হয়েছে এবং মাত্র ৬২টি নিট উন্নতি হয়েছে।
এরপর বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে আবার যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে নিয়ে এসেছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নীতিতে রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের জন্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে আপোষকামিতা এক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি নিয়ে আসতে পারছে কিনা সংশয় রয়ে গেছে। তবে এ সময়ে অনেক দেশে কর্তৃত্ববাদি প্রবণতা দেখা গেলেও সামরিক অভ্যুত্থান কিছুটা হলেও কমেছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চর্চার ওপর সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রভাব নিয়ে অনেকে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে তালুকদার মনিরুজ্জামান ও রওনক জাহান এর ওপর নানা মাত্রায় কাজ করেছেন। সাংবাদিক গবেষকদের মধ্যে যে ক’জন দীর্ঘ সময় বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের শীর্ষে রয়েছেন আমীর খসরু। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতা এবং বিবিসি ও আল জাজিরাসহ বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোর জন্য নানাভাবে কাজ করার জন্য বিশ্বব্যাপি পরিভ্রমণ তার এই পর্যবেক্ষণকে শাণিত করেছে। তার এ অভিজ্ঞতালব্ধ একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো- ‘সংকটে গণতন্ত্র: সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক শাসনের সমস্যা’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
দুই.
সরকার পরিচালনার একটি পদ্ধতি হলো উদার গণতন্ত্র। যদিও এটিকে সমাজবাদের মতো একটি আদর্শ হিসাবে দেখতে চান না আমীর খসরু। তার মতে, কোনক্রমেই আদর্শ বা মতাদর্শিক তত্ত্ব বা দার্শনিক ভিত্তির ব্যবস্থা নয় এটি। ফলে মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছ্বাস ক্রমেই বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ভঙ্গুর বা গভীরতাহীন গণতন্ত্র একটি দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ভাঙনের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যদি ব্যাপক ও সুসম্পন্নভাবে মানবাধিকারসহ সর্বজনের অধিকারকে নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে ঐ শাসকদের মধ্যে স্বৈরাচারি ও একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা জন্ম নেয়া হয় অনিবার্য। আর এতেই জন্ম নেয় অগণতান্ত্রিক সরকার, অনুদার গণতন্ত্র ও হাইব্রিড শাসন ইত্যাদি। এগুলোই গণতন্ত্রের বিপরীত তরঙ্গের জন্ম দেয়।
এটি ঠিক যে, গণতন্ত্র আদর্শ কিনা, এ বিষয়ে লেখকের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার অবকাশ রয়েছে। কারণ, উদার গণতন্ত্রকে ঘিরে পুঁজিতন্ত্র ও মুক্তবাজারের সমন্বয়ে এক ধরনের পূর্ণাঙ্গ আদর্শবাদের জন্ম হয়, যার সাথে অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে শাসক বাছাই ও মৌলিক মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে গণতন্ত্রের বিকৃতির বিষয়ে লেখকের বক্তব্যে দ্বিমতের অবকাশ নেই। গণতন্ত্রের উত্থান পতনের ধারাকে অনেকে অনেকভাবে দেখেছেন। আমেরিকান চিন্তাবিদ স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের পর্যায়ক্রমিক ধারাকে একটি তত্ত্বের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। লেখক তার বইয়ে এটি উল্লেখও করেছেন। হান্টিংটনের ওয়েব ও পাল্টা ওয়েব তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা অনুসারে বিশ্বব্যাপি প্রথম গণতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি তরঙ্গ চলে ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত, এর বিপরীত তরঙ্গ আসে ১৯২২ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত, দ্ব্তিীয় স্বল্প মেয়াদি তরঙ্গ শুরু হয় ১৯৪৩ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। আর পাল্টা তরঙ্গ আসে ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত। গণতন্ত্রের তৃতীয় তরঙ্গ শুরু হয় ১৯৭৫ সাল থেকে। এর বিপরীত তরঙ্গ শুরু হয়েছে কিনা তা হান্টিংটন হয়তো উল্লেখ করেননি। তবে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ফ্রান্সিস ফুকাইয়ামা ১৯৯২ সালে তার আলোচিত বই ‘এন্ড অব হিস্টরি এন্ড লাস্ট ম্যান’ বইয়ে বলেছেন, ‘উদার গণতন্ত্রই হচ্ছে সর্বশেষ যথাযথ রাজনৈতিক আদর্শ’। এটিকে তিনি ইতিহাসের সমাপ্তি হিসাবে কল্পনা করেছেন।
স্যামুয়েল হান্টিংটন ফুকাইয়ামার মতো উদার গণতন্ত্র দিয়ে ইতিহাসের সমাপ্তি টানেননি। তিনি সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব দিয়ে পশ্চিমের উদার গণতন্ত্রের বিপরীতে ইসলামিক, চৈনিক ও রুশীয় সভ্যতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। আমেরিকান রাষ্ট্রনায়কগণ তার এই সভ্যতার দ্বন্দ্বকে ওয়ার এন্ড টেরর নীতিতে বাস্তবে প্রয়োগের চেষ্টা কলেছেন বলে মনে হয়, যার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মুসলিম দুনিয়ায় লম্বা সময় ধরে চলমান ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধে এর গতি রুশ-চীন তথা দ্বিতীয় লক্ষের দিকে ছুটলেও সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধে তা আবার ‘ওয়ার এন্ড টেরর’ যুগে প্রত্যাবর্তন করেছে বলে মনে হয়।
ইহুদি বংশোদ্ভুত আমেরিকান চিন্তাবিদ হান্টিংটনের তত্ত্বকে যারা বড়ভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফিলিস্তিন বংশোদ্ভুত আমেরিকান তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমেরিকায় হান্টিংটনের চেয়ে এডওয়ার্ড সাঈদের কম গুরুত্ব পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনকি নোয়াম চমস্কির বিরোধিতাকেও আমলে নেয়া হয়নি। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনের টুইন টাওয়ারের ঘটনা এবং এর পরে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তানে সংঘটিত ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গেলেও সংকটে গণতন্ত্রের লেখক ওয়ান ইলেভেন পরবর্তি পুরো বিশ্ব ব্যবস্থায় ওলট-পালটের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনের নামে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ ও আইন প্রণয়নের নামে সাধারণ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের রিপোর্টে গণতন্ত্র বিকৃতির যে ধারা গত দুই দশকে হয়েছে তার সাথে এর সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে বইটিতে। আর গণতন্ত্রের একটি বিপরীত প্রবণতা বিগত ১২ বছরে বিশেষভাবে দৃশ্যমান হবার পেছনে এর ভুমিকা থাকতে পারে বলে মনে হয়। এ কারণে উদার গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক বলয়ের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে পরাভূত হয়ে তাদের নীতি পদক্ষেপসমূহকে এক পর্যায়ে থেমে যেতে দেখা যায়। এটি আরব বসন্তের পরে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষভাবে দেখা গেছে।
তিন.
‘গণতন্ত্রের সংকট’ বইয়ে সামরিক শাসন ও এর পরবর্তী বেসামরিক শাসনের বিষয়ে ফোকাস করা হয়েছে বিশেষভাবে। এখানে সামরিক শাসনকে গণতন্ত্রের বিপক্ষে প্রধান বাধা হিসাবে দেখা হয়েছে। তবে কর্তৃত্ববাদিতার জন্ম বা বিকাশকে সামরিক অভ্যুত্থান বা সেনা শাসনেই সীমিত হিসাবে দেখা হয়নি। প্রখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়ার একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যকে লেখক তুলে এনেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনই গণতন্ত্রের একমাত্র গ্যারান্টি নয়’। বাংলাদেশি লেখক দার্শনিক ফরহাদ মজহার তার সাম্প্রতিক একটি লেখায় ‘হিটলারও নির্বাচিত ছিলেন’ শিরোনামের একটি ছবিচিত্র দিয়ে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন।
লেখক গণতন্ত্রের সংকট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বইয়ের অনেকগুলো পরিচ্ছেদে বিষয়টির গভীরে যেতে চেষ্টা করেছেন। এর প্রতিটি পরিচ্ছেদে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণের সময় তত্ত্বগত প্রাসঙ্গিক বিষয়ও তিনি নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো, সামরিক শাসন পরবর্তী বেসামরিক নেতৃত্বের সমস্যা, প্রসঙ্গ: রাষ্ট্র ক্ষমতায় সামরিক বাহিনী- সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের সমস্যাবলী এবং সামরিক আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব ও রাজনীতিতে বৈধতার সংকট। এর মধ্যে প্রথমটিকে বলা যায়, বইটির আলোচ্য বিষয়গুলির মূল তাত্বিক ভিত্তি। যেখানে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্র চর্চাকে বি¯ৃ‘তভাবে ব্যাখ্যা করে দেখানো হয়েছে যে, জনগণের ক্ষমতায়ন ছাড়া গণতন্ত্র নিশ্চিত হতে পারে না। আর জনগণের ক্ষমতায়নই সামরিক শাসন বা স্বৈরাচারি ব্যবস্থা প্রতিরোধে সক্ষম করে তুলে। আর এই ব্যবস্থাই সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক নেতৃত্বের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে বেসামরিক নেতৃত্বের যোগ্যতা ও প্রজ্ঞার অভাব হলে তারা এ চেষ্টা কখনো চালান না। ফলে বেসামরিক শাসন হটিয়ে দেয়ার পর আবারো সামরিক শাসন বা বেসামরিক মোড়কে স্বৈরাচারি ব্যবস্থার আগমণ সহজতর হয়।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের সমস্যা বিশ্লেষণ করে কিভাবে রাজনীতিবিদদের সঠিক ও কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর সফলতা ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কটি দেশকে সামরিক শাসনমুক্ত করতে পেরেছে, আবার এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে তা আবার সামরিক শাসনকে অনিবার্য করে তুলেছে তার ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। যদিও এর পেছনে পুরোটো দায় বেসামরিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা নয়, একই সাথে সুযোগ সন্ধানি সামরিক কমান্ডারদের উচ্চাভিলাষও এর পেছনে কাজ করে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে সামরিক আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব অনেক সময় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অনুঘটক হতে দেখা যায় আবার পর্দার অন্তরালে তাদের ভুমিকা কিভাবে সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার ওপর আলোচনা করা হয়েছে। দেখা যায়, সুসংগঠিত শক্তিধর প্রতিষ্ঠান হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের সামরিক বাহিনীতে কিছু শীর্ষ ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছা পুরো প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে থাকে। উচ্চাভিলাস আর পোশাদারিত্বের সংঘাত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণ হতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে। আবার এই সংঘাতে পেশাদারিত্বের জয় সামরিক শাসনের অবসানেও ভূমিকা রাখে। সেনা নেতৃত্ব শালিসী ভূমিকা নিয়ে বেসামরিক নেতৃত্বের পূনরাবির্ভাবে ভূমিকা রাখবে নাকি সংকটের সুযোগে ক্ষমতায় প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে সেটি সামরিক নেতত্বের পোশাদারিত্ব নিরুপণ করে। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব হয়েছিল প্রথমোক্ত প্রক্রিয়ায় যদিও তিনি ক্ষমতার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একসময়। আবার এরশাদের আবির্ভাব ও ক্ষমতা গ্রহণ দুটোই ঘটেছে শেষোক্তভাবে। আর তার পতন ঘটে সামরিক নেতৃত্বের শালিসী ভূমিকায়। এই বিষয়গুলো লেখক চমৎকারভাবে একজন গবেষকের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তুলে এনেছেন।
বাংলাদেশে স্বল্পকালীন বেসামরিক শাসনের পর পাকিস্তানের মতই আবার সামরিক শাসন আসার কারণ ও পটভূমি বিশ্লেষণ করা হয়েছে বইটিতে। এরপর সামরিক শাসনের কারণ ও সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তারপর গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা হলো সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক। লেখকের মতে, বাংলাদেশের সামরিক শাসন জারি হবার পটভূমি অনেকখানি স্বাধীনতাত্তোর বেসামরিক শাসনই তৈরি করেছিল। বদরুদ্দিন উমরের এ সংক্রান্ত একটি বক্তব্য প্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃত করেছেন লেখক। উমরের এ বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যেখানে তিনি বলেছেন, অভ্যন্তরীণ সংকট ঘনীভূত হবার পরিণামে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলেও এসব অভ্যুত্থানের পশ্চাতে সাম্রাজ্যবাদের নেপথ্য এবং কোন কোন সময় প্রকাশ্য ভূমিকাও থাকে। স্নায়ুযুদ্ধকালে সোভিয়েত ও আমেরিকান দুই বলয়ই তাদের কৌশলগত স্বার্থের পক্ষে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে ইন্ধন দিয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য এর ব্যত্যয় ঘটলেও একই বিষয়ের পূনরাবৃত্তি আরব বসন্তের পরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে।
সামরিক শাসনের পেছনে সঙ্গত কারণেই থাকে সামরিক আমলাতন্ত্রের ভূমিকা। উন্নত ও উদার গণতন্ত্রের দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীকে যেভাবে পেশাদারিত্বের সাথে গড়ে তুলে বেসামরিক নেতৃত্বের অধীনে চলার আবহ তৈরি করা হয়, তার বিপরীতটা দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এসব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন বিপরীত বলয়ের ঘনিষ্ট হতে শুরু করে তখন সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপের জন্য গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন দেশগুলোর গোপন ইন্ধন দেবার ঘটনা এখনো বিরল নয়। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক শাসন পরিবর্তনে সেটি লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশের বেসামরিক শাসনের প্রথম সংক্ষিপ্ত সময়কে লেখক সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘ক্ষমতার ব্যক্তিকরণ’ হিসাবে। এই অধ্যায়টির ব্যাপারে লেখক খুব বিস্তৃত আলোচনা করেননি। দুটি কারণে এটি হতে পারে। প্রথমত, এই শাসনকালকে তিনি সাংবাদিকতার সক্রিয় পেশাকালে হয়তোবা দেখেননি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সংবিধানকে শেষ দফায় সংশোধনে দেশের স্থপতি ও প্রথম সরকার প্রধান সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্যকে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এরপরও সাধারণ পর্যালোচনা হিসাবে এই অধ্যায়ে লেখক নিজে এবং অন্যদের উদ্ধৃত করে যা বলেছেন তাতে বাংলাদেশের প্রথম শাসনকালের প্রতিচ্ছবি মোটাদাগে উঠে এসেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়েছে, ‘এরা নির্বাচনের পরাজয়কে চিরদিনের জন্য ক্ষমতা হারানো বলে ভয় করেন। সমালোচনাকে মনে করেন বিরোধি দলের মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত কর্মকান্ড। বিরোধি মতামতকে এরা সহ্য করতে পারেন না।’ রওনক জাহানের এই মন্তব্য ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত শাসনকালের মূল্যায়ন হিসাবে করা হলেও বাংলাদেশের গত দেড় দশকের শাসনের ব্যাপারে এটি অবিকল প্রযোজ্য হতে পারে। লেখক নিজে বলেছেন, শেখ মুজিব উদার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার বদলে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র দিয়েছিলেন। আর এটি হয়েছিল তথাকথিত ক্যারিজমেটিক নেতৃত্বের অনিবার্য ফসল হিসাবে।
১৯৭৫ থেকে থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে লেখক চিহ্নিত করেছেন সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের শাসন হিসাবে। তবে জিয়াউর রহমানের শাসনকে তিনি আরোপিত হিসাবে দেখেন না বলেই লেখক মন্তব্য করেছেন, শেখ মুাজিবের শাসনকালের ব্যর্থতা জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। লেখকের মতে, এই সময়ে সামরিক বাহিনী নিজ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। রক্ষী বাহিনী গঠন ও সামরিক বাহিনীর অবজ্ঞা পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার পরে তারা সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রয়াস চালান। তবে জিয়া সামরিক বেসামরিক শাসনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে নিজের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচেষ্টা করেন বলে মন্তব্য লেখকের।
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সময়ের সামরিক শাসনের ব্যাপারে লেখকের মূল্যায়ন আগের শাসনের চেয়ে বেশ আলাদা। জনপ্রিয়তা যেখানে জিয়ার শাসনের ভিত্তি ছিল, সেখানে এরশাদের ক্ষমতা ভিত ছিল রাষ্ট্র্রের সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চক্র। ফলে ক্ষমতার এই ভিতের নিচে মাটি সরার সাথে সাথে এরশাদের সামরিক সরকারের পতন ঘটে। এরশাদের ক্ষমতার অজপ্রিয়তার পরও বাইরের শক্তির সমর্থন বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে সহায়তা এটিকে ৯ বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছিল। এ প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত শেফারের একটি বক্তব্যের উল্লেখ করেন তিনি। লেখক নিজে এ সময়ে সক্রিয় সাংবাদিকতায় থাকায় তিনি নিজে অনেক ঘটনা নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন বলে মনে হয়।
সামরিক শাসনকে অনুন্নয়নের কাল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন আমীর খসরু। নিকোল বাল’র সাথে একমত হয়ে লেখক বলেছেন, তার উল্লিখিত চার শ্রেণী বাংলাদেশের সামরিক শাসন থেকেও লাভবান হয়েছিলেন। আর এটি হয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, বেসামরিক রাজনীতিবিদরে প্রজ্ঞা ও দক্ষতা নষ্ট করা, প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো আর আমদানি বৃদ্ধি ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির মতো পদক্ষেপ নিয়ে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা বাড়ানোর মাধ্যমে। এখানে লেখকের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে যে, সামরিক বা বেসামরিক যে শাসকই ক্ষমতায় থাক না কেন এ কাজ সব সরকারের সময়ই হতে পারে। বাংলাদেশে একটি জনশ্রুতি রয়েছে যে, দেশের সবচেয়ে অজনপ্রিয় সামরিক শাসক এরশাদও এখনকার বেসামরিক সরকারের সময়কার কর্তৃত্ববাদিতা ও অপশাসন দেখে লজ্জা পেতেন।
ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে এই বইয়ে। এই বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ধারণা দিতে গিয়ে লেখক সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, প্রিন্স সিহানুকের কম্বোডিয়া, রাজা মহেন্দ্র’র আমলের নেপাল প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন।
রাজনীতি থেকে সেনা শাসন অপসারণের চেষ্টা ও সুযোগ সম্বলিত দুটি পরিচ্ছেদ রয়েছে শেষাংশে। লেখক বলেছেন, রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীর দীর্র্ঘস্থায়ী প্রত্যাহার প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রমাণের পাশাপাশি একটি টেকসই ও স্থায়ী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেনা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা দখলকে প্রতিহত করতে পারে। সুসিয়ান পাইয়ের মন্তব্যটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দায়িত্ববান রাজনীতিবিদের। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর অভাবে বাংলাদেশের ওপর দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পরও ভর করে আছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
![বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727094352.jpg)
বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন
![বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727093432.jpg)
বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’
চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক
![বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727091817.jpg)
বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে
![জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727085854.jpg)
জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে
জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড
![ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/4634-20240727032845.jpg)
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড
![পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও
![বেতাগী দরবারে ওরশ আজ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
বেতাগী দরবারে ওরশ আজ
![সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা
![কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে
![নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/5-20240726212443.jpg)
নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি
![বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726212448.jpg)
বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ
![শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726212737.jpg)
শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী
![মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213356.jpg)
মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড
![গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213707.jpg)
গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা
![নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213859.jpg)
নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ
![তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726222840.jpg)
তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’
![মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726214708.jpg)
মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
![সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি