ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
ফিরে দেখা-২০২৩

চট্টগ্রামে বছরজুড়ে আলোচনায় শিশুর প্রতি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামে শিশুর প্রতি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা থামছে না। নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। খুনের পর গুম করা হচ্ছে লাশ। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। আগের বছরের মতো সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালেও চাঞ্চল্যকর শিশু খুনের ঘটনা ছিল আলোচনায়। পারিবারিক কলহ-বিরোধ, বাবা-মায়ের অনৈতিক সর্ম্পক কিংবা প্রতিবেশিদের লালসার শিকার হয়ে জীবন দিতে হচ্ছে শিশুদের। আবার কখনো কখনো পিতা-মাতা এমনকি সহপাঠি, খেলার সাথি, স্বজনের হাত রঞ্জিত হচ্ছে শিশুর রক্তে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়া সর্বোপরি বিচারহীনতার কারণে এমন ভয়ানক অপরাধ বাড়ছে।
গেল বছর নগরী ও জেলায় বেশ কয়েকটি শিশু খুনের ঘটনা ঘটে। কয়েকটি ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে খুন হয় পাঁচ বছরের শিশু মোহাম্মদ তাহমিদ। খেলার মাঠ থেকে নিখোঁজ হওয়ার দুইদিন পর বাড়ির কাছের একটি পুকুর থেকে তার রক্তাক্ত ভাসমান লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবারের সদস্যরা জানায়, তাকে তুলে নিয়ে হত্যার পর লাশ পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহমিদ উপজেলার পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মো. আলমের পুত্র। শিশু সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় তার পিতা-মাতা। পুলিশ খুনের কারণ ও ঘটনায় জড়িতদের সনাক্ত করতে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তোফায়েল আহমেদ।
১৩ ডিসেম্বর নগরীর ইপিজেড থানা এলাকায় সহপাঠির হাতে খুন হয় মাদরাসার পঞ্চম শ্রেণির কিশোর ছাত্র মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে কর্মরত বাবা-মায়ের কাছে বেড়াতে এসে নির্মম খুনের শিকার হয় এই কিশোর। পুলিশ বলছে, ছেলেটির বাবা-মা দুই জনেই কর্মজীবী। তারা কাজে যাওয়ার পর পাশের বাসার আরেক কিশোর ও তার এক সময়ের সহপাঠি মোহাম্মদ হাসানের বাসায় যায় আবদুল্লাহ। সেখানে ‘ফ্রি ফায়ার গেম’ খেলা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় তাদের। একপর্যায়ে তা মারামারিতে রূপ নিলে মোহাম্মদ হাসানের ঘুষিতে প্রাণ হারায় আব্দুল্লাহ। আর এ অবস্থায় সন্তানকে খুনের দায় থেকে বাঁচাতে লাশ গুমের চেষ্টা করেন হাসানের মা হাফিজা বেগম।
ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর খুনের রহস্য উদঘাটন হয়। হাসান ও তার মা হাফিজাকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় কারাগারে। হাসান স্বীকার করেছে মারামারির একপর্যায়ে আবদুল্লাহর গলার শ্বাসনালীতে জোরে ঘুষি মারে সে। সঙ্গে সঙ্গেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাথায়ও আঘাত পায় সে। তখন আবদুল্লাহ পানি খেতে চাইলে ওই কিশোর তাকে পানিও খাওয়ায়। এরমধ্যেই আবদুল্লাহ মারা যায়। পরে সে তার মাকে ফোনে বিষয়টি জানায়। এরমধ্যে ওই কিশোর আবদুল্লাহর বাবাকে কল দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে। মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে করতে যাতে পালিয়ে যেতে পারে সেজন্যই কল দিয়েছিল সে। টিভি সিরিয়াল দেখে সে এসব শিখেছে বলে জানিয়েছে। রাতে আবদুল্লাহদের বাসার পাশে বস্তাবন্দি লাশ ফেলে আনোয়ারায় পালিয়ে যায় হাসান।
৮ ডিসেম্বর একই থানার আকমল আলী রোডে দুই বছরের শিশু ওমর ফারুককে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় মোহাম্মদ ইয়ামিন নামে এক যুবককে। শিশুটির মা রওশন আরা বেগম ওই যুবককে তার তৃতীয় স্বামী বলে জানান। তার অভিযোগ আগের সংসারের শিশুপুত্র ওমর ফারুককে সহ্য করতে পারতেন না সৎ বাবা ইয়ামিন। ঘটনার দুইদিন আগে রওশন ইপিজেডে কাজে যাওয়ার পর শিশুটি ইয়ামিনের কাছে ছিল। সে শিশুটির গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়। এতে শিশুটি কান্নাকাটি করলে সে তার মুখ চেপে ধরে বাসার দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে আঘাত করে। এতে শিশুটি অচেতন হয়ে পড়ে।
বাসায় এসে সন্তানকে এমন অবস্থায় দেখে স্বামী ইয়ামিনকে সঙ্গে নিয়ে শিশুটিকে প্রথমে আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে বেসরকারি হলি হেলথ হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ জানতেন না রওশন আরা। কিন্তু শিশুটির লাশ গোসল দেওয়ার সময় তিনি তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ঝলসানো দেখতে পেয়ে ইয়ামিনকে চ্যালেঞ্জ করেন। এক পর্যায়ে ইয়ামিন শিশুটিকে নির্যাতন করে খুনের বর্ণনা দেয়। তখন স্থানীয়রা তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে ইয়ামিন আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়।
অপহরণের পর মুক্তিপণের দাবিতেও শিশু খুনের ঘটনা ঘটছে। নগরীর চান্দগাঁও থানার পশ্চিম মোহরা এলাকায় এগারো বছর বয়সী মো. শফিউল আলম রহিম নামে এক শিশুকে অপহরণের পর পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অপহরণের চারদিন পর বালি ও ইটচাপা দিয়ে পুঁতে রাখা ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশু রহিম পশ্চিম মোহরার মো. সেলিম উদ্দিনের ছেলে। সে মোহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তাকে তুলে নেওয়ার পর তার বাবার কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। গ্রেফতার অপরাধীরা জানায়, তাদের মধ্যে একজন শিশুটির প্রতিবেশি ছিল। তাকে চিনে ফেলায় ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে শিশুটিকে ২৯ এপ্রিল রাতে বাটাম দিয়ে আঘাত করে তারা হত্যা করে লাশ গুম করে।
একই থানার মৌলভী পুকুরপাড় এলাকায় এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণের পর শ^াসরোধে হত্যা করা হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। শিশুটির বাবা-মা দুইজনেই কর্মজীবী হওয়ায় শিশুটি বাসায় একা ছিল প্রতিদিনের মতো। আর এই সুযোগে প্রতিবেশি যুবক রাকিবুল ইসলাম মুন্না তাকে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণের পর হত্যা করে। লাশ ফেলে রক্তমাখা পোশাকে পালানোর সময় প্রতিবেশিরা তাকে ধরে পুলিশে দেয়।
নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও খুনের শিকার হচ্ছে শিশুরা। নগরীর মেহেদীবাগ এলাকার দারুস সুফফাহ তাহফিজুল কোরআন মাদারসার শৌচাগার থেকে সাবিব সাইয়ান নামে ওই শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। সে মাদারসাটির চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। শিশুটি মাদরাসার অদূরে বাগমনিরাম পল্টন রোডের আবদুল কাদের চৌধুরী বাড়িতে পরিবার সঙ্গে থাকত। প্রথমে এই ঘটনাকে পুলিশ আত্মহত্যা বললেও পরে জানা যায়, তাকে হত্যা করেছে তারই এক সহপাঠি।
দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী শিশু আবিদা সুলতানা আয়নী খুনের ঘটনা ঘটে নগরীর পাহাড়তলী থানার মুরগি ফার্ম আলম তারাপুকুর পাড় এলাকায়। ২১ মার্চ নিখোঁজ হওয়ার আটদিন পরে আয়নীর লাশ ও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো। এ ঘটনায় মোহাম্মদ রুবেল নামের স্থানীয় এক তরকারি বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়। আয়নীকে ধর্ষণের পরে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন মো. রুবেল।
আয়নী স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মা গার্মেন্টসে চাকুরি করার সময় নানীর সঙ্গে থাকতো আয়নী। তরকারি বিক্রির সুবাদে নানী বিবি খাদিজার সঙ্গে রুবেলের পূর্ব পরিচয় ছিল। বিড়ালছানা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শিশুটিকে ডেকে নেয় রুবেল। এরপর একটি খালি বাসায় তাকে ধর্ষণের পর গলটিপে ও বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে। পরে তার দেখানো মতে, আলমতারা পুকুরের পাশে ডোবা থেকে মাটিচাপা দেওয়া গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনা ছাড়াও গেল বছর নগরী ও জেলায় আরও বেশ কয়েকটি শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা