পুণ্যময় মাহে রমজান
১২ মার্চ ২০২৪, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:১৬ এএম
সিয়াম সাধনা ও আত্মশুদ্ধির বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। এ মাসে আল্লাহতায়ালা মুত্তাকি পরহেজগার বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য সব আয়োজন করে রাখেন। অবারিত রহমত বর্ষণ করেন। ফযিলতের দিক থেকে এ মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রথমাংশে রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত আর তৃতীয়াংশে নাজাত তথা দোজখ থেকে মুক্তি।’ তৃতীয়াংশে অর্থাৎ শেষ দশকে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’। আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহম্মাদির লাইলাতুল কদরের একরাত্রির ইবাদতকে পূর্ববর্তী উম্মতগণের এক হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ রাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে: ‘শবে কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’। সুতরাং শেষ দশকে আল্লাহভীরু মুসলমানরা আল্লাহর ঘরে এ’তেকাফ করে লাইলাতুল কদরের সন্ধান করে। আনুগত্য স্বীকার করে একনিষ্ঠভাবে ইবাদাত-বন্দেগির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস চালায়।
মাহে রমজানে সিয়াম পালন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ করা হয়েছে। ‘সাওম’ বা রোজা ইসলামের মূল ভিত্তিসমূহের মধ্যে অন্যতম। মাহে রমজানে সিয়াম পালন করা গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নাম ‘সাওম’। আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন: ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম, তথা রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পারো’। (সূরা বাকারা- ১৮৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সৎপথের ¯পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এই মাসটি পাবে, সে রোজা রাখবে।’ (সূরা বাকারা ১৮৫)।
এ মাসে প্রত্যেক মুসলমানের করণীয় হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম পালন করা। অন্যান্য ফরজ ইবাদাতসমূহ গুরুত্বসহকারে আদায় করা। সুন্নাত ও যাবতীয় নফল ইবাদাত পালনে যত্নবান হওয়া। বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। তাওবা-ইস্তেগফার, জিকির-আজকার ও মোনাজাত করা। হালাল গ্রহণ করা হারাম থেকে থেকে বেঁচে থাকা। কাউকে গালি না দেওয়া। গীবত না করা। চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি না করা। সন্ত্রাস, খুন, গুম, ধর্ষণ, যেনা-ব্যভিচার না করা। অশ্লীলতা পরিহার করা। সর্বোপরি এ মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা। এ মাসে সিয়াম পালনকারী একজন মুসলমান সত্যিকারের খাঁটি ইবাদতকারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে পাপি-তাপি বান্দাদের উদারচিত্তে ক্ষমা করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে সওম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি)।
বছরের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র রমজান মাস এলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আনন্দিত হন। প্রত্যেকেই দুনিয়াবি কাজকর্ম সংক্ষিপ্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, আফিস-আদালত ইত্যাদির সময়ও সংক্ষিপ্ত করা হয়। সকলেই তাক্বওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধির জন্য আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগিতে মশগুল হন। বাংলাদেশের মানুষ অধিক ধর্মপরায়ন। এ দেশের মানুষ ইবাদাতের বিশেষ উপলক্ষগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানোর প্রয়াস চালায়। বিশেষকরে রমজান মাস এলে এদেশের মুসলমানরা আল্লাহর বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করে। মসজিদগুলো মুসল্লিদের উপস্থিতিতে কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে চলতে থাকে তারাবিহ।
এ মাসে আল্লাহতায়ালা বান্দদের দোয়া কবুল করেন। গোনাহসমূহ মাফ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য অধিক পুণ্য অর্জনের বিশেষ সুযোগ নিয়ে আসে পবিত্র রমজান মাস। এ মাসের একটি ফরজ ইবাদাত সোয়াবের দিক থেকে অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজ ইবাদাতের সমান। একটি সুন্নাত ইবাদাত একটি ফরজ ইবাদাতের সমান। এছাড়া এ মাসে যে কোনো পুণ্যের কাজ করলে অন্য সময়ের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি সোয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘নিশ্চয়ই রোজা আমার জন্য, এর প্রতিদান আমিই দান করি’। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন: ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করল’। (বায়হাকি)
রমজান মাসের আগমন হলে রাসূল (সা.) অতিশয় আনন্দিত হতেন।
সাহাবায়ে কেরামদের বলতেন, বরকতময় মাস রমজান এসেছে। এ মাসের কিছু ফজিলত বর্ণনা করে তিনি বলতেন: ‘আল্লহতায়ালা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত, যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। (নাসায়ি)
রাসুল (সা.) বলেছেন: রমজান মাসে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ নিয়ামত দান করা হয়েছে, যা আগেকার উম্মতগণকে দেওয়া হয়নি। এই নিয়ামতগুলো হচ্ছে- ১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়ে বেশি ঘ্রানযুক্ত। ২. ইফতার পর্যন্ত রোজাদারের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন। ৩. রোজাদারের জন্য প্রতিদিন জান্নাতকে সজ্জিত করা হয়। ৪. শয়তানকে বন্দি করা হয়। ৫. রমজানের শেষ রাতে সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হয়।
আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। এ মাস থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং এ মাসের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। এ মাসে প্রত্যেক রোজাদারের প্রাণের দাবি হচ্ছে, যাবতীয় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বন্ধ করতে হবে। দিনের বেলা হোটেল রেস্তেরাঁ বন্ধ রাখতে হবে। সেহরী, ইফতার ও তারাবিহের সময় লোডশেটিং বন্ধ রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন আরব দেশে রমজান মাস আসার আগেই পণ্যের দাম অনেকটা কমিয়ে দেয়া হয়। মূল্য ছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এর ঠিক উল্টো। এখানে রমজান মাস আসার আগেই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। পণ্যে ভেজাল দিয়ে খাবারকে দূষিত করা হয়। ভেজাল খাবার গ্রহণের ফলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের এই অপকৌশল খুবই লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। ব্যবসা একটি সম্মানজনক ও মানবিক পেশা। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সৎ হতে হবে। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং অব্যাহত রাখতে হবে। পবিত্র মাহে রমজানে অসৎ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অপকৌশলের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।
একশ্রেণীর মানুষ আছে, যারা পাপিষ্ঠ শয়তানের ধোকায় পড়ে শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া রোজা ভঙ্গ করে অথবা রোজা থেকে বিরত থাকে। রমজানের রোজা ভঙ্গ করলে আল্লাহর দরবারে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কারণ ছাড়া ইচ্ছাপূর্বক রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করে সে যদি অন্য সময় সারা জীবন রোজা রাখে তবুও রমজানের একটি রোজার সমতুল্য হবে না।’ অনেকে সারাদিন কষ্ট করে রোজা পালন করে কিন্তু অজ্ঞতা বা অসর্তকতার কারণে তা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। রোজা রেখে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হন অনেকে। রমজানে রোজা পালন করা যেমন ফরজ, তেমনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করাও ফরজ। দেখা যায়, অনেকে সিয়াম পালন করে ঠিকই কিন্তু ফরজ নামাজ ঠিকমত আদায় করে না। নানাবিধ গোনাহের কাজে লিপ্ত হয়। এরকম সিয়াম পালনের দ্বারা আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জিত হবে না। খানাপিনা, যৌনাচার থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার নামই হচ্ছে রোজা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি)
সুতরাং মাহে রমজানে অন্যায়, অবিচার, পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মিথ্যা, গীবত, মারামারি, ঝগড়াঝাটি, গালাগালি, চুরি-ডাকাতি-দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। অবৈধ উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আত্মশুদ্ধির এ মাসে সিয়াম পালন ও অন্যান্য ফরজ ইবাদাতের পাশাপাশি সুন্নাত, নফল ইবাদাত, কোরআন তিলাওয়াত বেশি বেশি করা দরকার।
লেখক: প্রবন্ধকার ও কলাম লেখক
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের অনুমোদন দিয়েছে পাকিস্তান
সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া, ড. ইউনূসের সঙ্গে কুশল বিনিময়
সউদী আরবের ফ্যাশন শো নিয়ে যেসব কারণে ক্ষুব্ধ ইসলামী পণ্ডিতরা
‘সশস্ত্র বাহিনী দিবসে খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত’ : প্রধান উপদেষ্টা
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করেছিল -আ ন ম বজলুর রশীদ
বাংলাদেশে সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে চায় পাকিস্তান
দুর্গাপুরে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার।
রাজশাহী মহানগর বিএনপি যুগ্ম আহবায়ক বজলুল হক মন্টু ছুরিকাঘাত
নোয়াখালীতে ট্রাক চাপায় শিশু নিহত
আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসর ব্যারিস্টার সুমন দুই দিনের রিমান্ডে
মহাখালীতে এটিএম বুথ ভাঙচুর চালান ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা
শুধু আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাস লালনকারী দলটিরও বিচার হতে হবে - খেলাফত মজলিস
চাপ মেনে নিয়েই হুঙ্কার ছাড়লেন কামিন্স
৬ ঘণ্টা পর মহাখালীতে যান চলাচল শুরু, কমেনি যানজট
খাগড়াছড়িতে দুর্গম লম্বাছড়া গ্রামে স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মিত
ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করল রাশিয়া
সখিপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর হামলার মামলায় গ্রেফতার ২
সাফজয়ী ঠাকুরগাঁওয়ের তিন নারী ফুটবলারকে জেলা প্রশাসনের সংবর্ধনা
শিক্ষার্থীদের ওপর অটোরিকশা চালকদের হামলা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ এ পদার্পণ, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি