ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ইনকিলাব জাতীয় বিবেকের কণ্ঠস্বর

Daily Inqilab রূহুল আমীন খান

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম

১৯৮২ সালের কথা। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর শহর বাগদাদ শরীফে আহবান করেন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। তাতে যোগদান করেন বিশ্বের ৮২টি দেশের প্রতিনিধি। এ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের উলামা-মাশায়েখের একটি দল উপস্থিত হন বাগদাদ শরীফে। ওঠেন তাঁদের জন্য বরাদ্দকৃত একটি পাঁচতারকা হোটেলে। এই দলে ছিলেন ছারছিনার পীর সাহেবসহ অনেক খ্যাতনামা আলেম-ওলামা। সৌভাগ্যক্রমে আমিও ছিলাম তাঁদের সাথে। সেখানে বসেই ছারছিনার পীর ছাহেব মুহতারাম মাওলানা হুজুরকে প্রস্তাব দেন ইসলামী ভাবাদর্শের একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের। প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি দোয়ার আবেদন জানান পীর ছাহেব কিবলাকে। তিনি সবাইকে নিয়ে রাব্বুল আলামীনের দরবারে মুনাজাত করেন এর কবুলিয়াতের জন্য। সেখান থেকে ফেরার পথে আমরা মক্কা মুয়াজ্জমায় হাজির হই ওমরার নিয়তে। পবিত্র খানায়ে কাবার আঙ্গিনায়ও মাওলানা হুজুরের অনুরোধে পীর ছাহেব কিবলা দোয়া-মুনাজাত করেন সম্ভাব্য দৈনিক পত্রিকার জন্য।

ঢাকায় ফিরে এসে মাওলানা হুজুর (মাওলানা এম এ মান্নান) শুরু করলেন ইনকিলাব প্রকাশের প্রস্তুতি। তাঁর একান্ত ইচ্ছায় আমিও ছারছিনা দারুচ্ছুন্নাত আলীয়া মাদরাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম ঢাকায়, আত্মনিয়োগ করলাম এ উদ্যোগ সফল করার মহান খিদমতে। মাওলানা হুজুর ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আকাশ ছোঁয়া ব্যক্তিত্ব ও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী এক মহান কর্মবীর। নিয়মিতভাবে পত্রিকা প্রকাশের পথে যেন কোন বিঘ্নের সম্মুখীন হতে না হয় সেজন্য তিনি জমিন খরিদ করলেন, বহুতল বিশিষ্ট সুরম্য ভবন নির্মাণ করলেন, অত্যাধুনিক প্রিন্টিং মেশিন আমদানি করে ঐ ভবনে স্থাপন করলেন। এরপর সাংবাদিক ও কর্মচারী নিয়োগে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর পরিচিত প্রখ্যাত সাংবাদিকদের পরামর্শ নিয়ে নিয়োগ দিলেন চৌকস সাংবাদিক ও কর্মচারীদের। সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করলেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীনের ওপর, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে কিছুদিন আগেমাত্র বের হয়েছেন। বয়সে নবীন কিন্তু তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা, অপূর্ব কর্মদক্ষতা, দূরদর্শিতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও দার্শনিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক দক্ষতা সবাইকে মুগ্ধ করল। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সব আয়োজন সুচারুরূপে সম্পন্ন হলো। অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত শুভক্ষণ। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন হাতে হাতে উঠল ইনকিলাবের প্রথম সংখ্যা। প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাওলানা হুজুর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের বিভিন্ন বৈঠকে মোটামুটিভাবে জানিয়ে দিলেন ইনকিলাবের পলিসি। তাঁর ভাষায়: ‘আমরা ইসলামের ব্যাপারে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও স্বার্থের ব্যাপারে সর্বদা থাকব অটল, অবিচল, আপোসহীন। আমরা মুসলিম উম্মার যে কোন বিপদ মুসিবতে কলম সৈনিক হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াব। আমরা দায়বদ্ধ কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে। আমাদের লক্ষ্য হবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। আমরা জনগণের সমস্যা সংকটের কথা, অভাব অভিযোগের কথা, দুঃখ ও বেদনার কথা, আশা-আকাঙ্খা ও কল্যাণের কথা তুলে ধরব বলিষ্টভাবে। কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত হবো না। আমরা চরমপন্থী হবো না, মধ্যপন্থা অবলম্বন করবো। দেশের প্রতি থাকবে আমাদের গভীর ভালবাসা। দেশের আইনের প্রতি থাকবে শ্রদ্ধা ও আনুগত্য। জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের প্রতি থাকবে উদার দৃষ্টি ভঙ্গি, সম দৃষ্টিকোণ। এই আদর্শে অবিচল থাকলে নেমে আসবে আল্লাহর রহমত। ইনকিলাব সক্ষম হবে সৃষ্টি করতে আদর্শিক ইনকিলাব, ইনশাআল্লাহ্।’

এই ঘোষিত নীতি আদর্শকে ধ্রুব করে দীর্ঘ তিন যুগের বেশি সময় ধরে চলছে ইনকিলাবের পথ পরিক্রমা। এতে সত্যসন্ধ বন্ধুরা যেমন পেয়েছেন চিন্তার খোরাক, পথের দিশা, হয়েছেন উৎসাহিত, উৎফুল্ল, তেমনি যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে, কুমতলব হাসিলে যারা ব্যর্থ হয়েছেন, তারা হয়েছেন ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত। হেনেছেন আঘাতের পর আঘাত। কখনো দু’এক দিনের জন্য বন্ধ হয়েছে পত্রিকা, কখনো মেশিন রুমে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে তালা। কখনো লাঠিসোঁটা নিয়ে সরাসরি আক্রমণও হয়েছে ইনকিলাব ভবনে। ইনকিলাবের অসম সাহসী কলম সৈনিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছেন তার সার্থক মোকাবেলা। আবার কখনো সম্পাদক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলার পর মামলা, জারি হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। এত কিছুর পরও আল্লাহর মেহেরবানীতে স্তব্ধ করা যায়নি ইনকিলাবের কণ্ঠ। ইনকিলাব এগিয়ে চলছে সামনে।
ঘোষিত এ নীতিমালা বাস্তবায়িত করায় ইনকিলাব একটি ফিচার সমৃদ্ধ দৈনিকে পরিণত হয়। ক্রমে এর সাথে সম্পাদক মহোদয়ের সৃজনশীল আইডিয়া ধারণ করে আরও অনেক বিষয় যুক্ত হওয়ায় আরও বৃদ্ধি পায় ইনকিলাবের আকর্ষণ এবং সর্বশ্রেণির পাঠকসমাজের নিকট হয় নন্দিত।

‘দেশের প্রতি থাকবে গভীর মমত্ববোধ’- এ ঘোষণা শুধু নীতি কথায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ইনকিলাব বাস্তবেও এর প্রতিফলন ও উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন সময়ে।

যখন যেখানেই দেখেছে দেশের স্বার্থ বিপন্ন হতে, আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে দেখেছে, ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, কৌশল ও অপতৎপরতা চালাতে, দেখেছে তাবেদার বানানোর অপপ্রচেষ্টা, দেখেছে দাদাগিরি ও মোড়লী ফলানোর কসরত, প্রত্যক্ষ করেছে সাম্রাজ্যবাদী লোলুপ দৃষ্টি- (তা পূর্ব থেকে বিরাজিত থাকুক বা ইনকিলাবের জন্মের পরের হোক) সে সবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে ইনকিলাব। সজাগ ও সচেতন করেছে জনগণকে। আহবান জানিয়েছে প্রতিকার-প্রতিবিধানের। রায় মঙ্গল নদীর প্রবাহ, তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তার পানিপ্রবাহসহ গঙ্গা বেসিনের পানি লুণ্ঠন, টিপাইমুখের বাঁধ, তিনবিঘা করিডোর, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল, সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসম্পদ ইত্যাদির অনেক কিছুই উল্লেখ করা যায় এ প্রসঙ্গে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে এর কোন কোনটি সমাধান ইতোমধ্যে হয়েছে।) এজন্য অনেকেই ইনকিলাবকে বলেন জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর, জাতীয় স্বার্থের পাহারাদার।

বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল। সুফী সাধকদের দ্বারা প্রধানত এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। তাদের উদারতা, মহানুভবতা, মানবপ্রেমের প্রভাব এ ভূখন্ডের মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান। প্রতিবেশী দেশের উগ্রসাম্প্রদায়িকতা, মুসলিম নিধন, দাঙ্গা, মসজিদ ভাঙ্গা ইত্যাদির অশুভ প্রতিক্রিয়া কোন ক্রমেই যেন এখানে ছড়াতে না পারে, তেমনি জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাস ইত্যাদি ইসলাম গর্হিত কার্যকলাপ প্রশ্রয় না পায়, অনুরূপ ধর্মীয় কোন কোন বিষয় নিয়ে যে মত পার্থক্য বিদ্যমান তা নিয়ে যেন চরম প্রান্তিকতা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে সে নিয়ে বরাবরই লেখা-লেখি চালিয়ে আসছে ইনকিলাব। জানিয়েছে মধ্যপন্থা অবলম্বনের আহবান।

ইনকিলাব তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মুসলিম উম্মার ঐক্য, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ঐক্যের ডাক দিয়ে আসছে। পরস্পর হানাহানির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছে। আরবজাহান ভ্রমণকালে আমি দেখিছি, ইনকিলাবে প্রকাশিত অনেক নিবন্ধ আরবীতে ভাষান্তরিত করে প্রচার করতে। বসনিয়া, চেচনিয়ায় মুসলিম নিধন, উইঘুরে মুসলিম নির্যাতন, ফিলিস্তিনে ইয়াহুদীবাদী ইসরাইলের পৈশাচিক বর্বরতা, মানবাধিকার দলন, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়ামেনের ভ্রাতৃঘাতি লড়াই, ভারতের বিভিন্নস্থানে বিশেষভাবে কাশ্মীরে মুসলিম নিধন ও নির্যাতন, মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে হত্যা নির্যাতন ও উৎখাত ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কুরআনপাক, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে অবমাননা হয়েছে, ইসলামী প্রতিষ্ঠানের উপর যে হামলা হয়েছে ইনকিলাব তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এতে প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়েছে, এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে, ফলে কিছুটা হলেও তাদের টনক নড়েছে।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা