মহানবী সা.-এর বিদায় হজের ভাষণ বিশ্ব মানবতার মুক্তিসনদ

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৬ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দশম হিজরির জিলকদ মাসের পাঁচদিন বাকি থাকতে মহানবী মুহম্মদ সা. হজ পালনের উদ্দেশে মদীনা থেকে মক্কায় রওনা হন। বিপুল সংখ্যক মুসলমান তাঁর সঙ্গী হয়। পথে পথে আরো মুসলমান এই হজমিছিলে শামিল হয়। মহানবী সা. চলার পথে বিভিন্ন সময় তাদের লক্ষ্য করে ভাষণ প্রদান করেন। ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থসমূহে তার বিবরণ আছে। জিলহজ মাসের নবম দিবসে তিনি মক্কার কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত আরাফাত ময়দানে সমবেত জনতাকে সামনে রেখে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন, যা মহানবী সা.-এর বিদায় হজের ভাষণ নামে অভিহিত। ভাষণটি মানবতার সর্বোত্তম মুক্তিসনদ রূপে বর্ণিত হয়েছে। এত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যম-িত ভাষণ মুহম্মদ সা.-এর আগে ও পরে কেউ দিতে পারেননি।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা করার পর তিনি শুরু করেন ভাষণ। ভাষণে বলেন:
হে মানুষ!
তোমরা আমার কথা শোনো। এর পর এই স্থানে তোমাদের সঙ্গে আর একত্রিত হতে পারবো কিনা জানি না!
হে মানুষ!
আল্লাহ বলেন, হে মানবজাতি তোমাদের আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের নানা সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি; যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। অতএব শুনে রেখো মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। আরবের ওপর কোনও অনারবের, অনারবের ওপর কোনও আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনই সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদার কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী যে আল্লাহকে ভালোবাসে।

হে মানুষ!
শুনে রেখো, অন্ধকার যুগের সকল বিষয় ও প্রথা আজ থেকে বিলুপ্ত হলো। জাহিলি যুগের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো।
হে মানুষ!
শুনে রেখো, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরই বর্তায়। পিতা তার পুত্রের জন্য আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।
হে মানুষ!
তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম অর্থাৎ পবিত্র ও নিরাপদ করা হলো। আজকের এই মাস এবং এই শহর সকলের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ ঘোষণা করা হলো।
হে মানুষ!
তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে। কারণ ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সকল সদগুণ ধ্বংস করে ফেলে।

হে মানুষ!
নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করো না। তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে; তেমনই তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণের দিকে সবসময় খেয়াল রেখো।
হে মানুষ!
অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তোমরা নিজেরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে। নিজেরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।
হে মানুষ!

ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান, ধন এবং প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করে।

হে মানুষ!
ঈমানদাররা পরস্পরের ভাই। সাবধান! তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করবার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হবে না।
হে মানুষ!
শুনে রেখো, আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিন্যপ্রথা বিলুপ্ত করা হলো। কুলীন বা শ্রেষ্ঠ সেই যে ঈমানদার এবং মানুষের উপকার করে।
হে মানুষ!
ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে। কারুর সম্পত্তি কেউ যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারুর জন্য হালাল নয়। তোমরা কেউ দুর্বলের ওপর অবিচার করবে না।

হে মানুষ!
বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান। জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। কারণ, জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে তোমরা চিনেও যাবে।

হে মানুষ!
তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে। সালাত কায়েম করবে। যাকাত আদায় করবে। সিয়াম পালন করবে। হজ সম্পন্ন করবে আর সংঘবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে। তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
হে মানুষ!
শুনে রেখো। একজন কুশ্রী-কদাকার ব্যক্তিও যদি তোমাদের নেতা মনোনীত হয়, যদ্দিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, তদ্দিন তার আনুগত্য করা তোমাদের ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।
হে মানুষ!

শুনে রেখো। আমার পর আর কোনও নবী নেই। হে মানুষ, আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি, যদ্দিন তোমরা এ দুটো অনুসরণ করবে তদ্দিন তোমরা সত্যপথে থাকবে। এর একটি হলো: আল্লাহর কিতাব। অন্যটি হলো: আমার সুন্নাহ বা জীবনদৃষ্টান্ত।
হে মানুষ!
তোমরা কস্মিনকালেও দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, অতীতে বহু জাতি দীন নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে।

হে মানুষ!
প্রত্যেককেই শেষবিচারের দিন সব কাজের হিসাব দিতে হবে। অতএব সাবধান হও।
হে মানুষ!
তোমরা যারা এখানে হাজির আছো, আমার এই কথাগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেবে।
গুরুগম্ভীর ও আবেগমথিত বক্তৃতার পর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশে হাত উঁচিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে মানুষেরা! আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছি?’
উপস্থিত সকলে সমস্বরে জবাব দিলো, ‘জী হ্যাঁ।’ এরপর নবীজী সা. বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো। আমি আমার সকল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছি।’

 

 


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জাগ্রত ভয় মনের মাঝে
আর কেউ বেঁচে নেই
সময়
মার্চের পদাবলি
অপসৃয়মাণ রেলগাড়ি
আরও
X

আরও পড়ুন

ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে গাজা থেকে ছোড়া একাধিক রকেট

ইসরায়েলে আঘাত হেনেছে গাজা থেকে ছোড়া একাধিক রকেট

৫ বছর পর গোলহীন ম্যানচেস্টার ডার্বি

৫ বছর পর গোলহীন ম্যানচেস্টার ডার্বি

মার্কিন শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার প্রস্তাব ভিয়েতনামের : ট্রাম্পের জন্য কি তা যথেষ্ট হবে?

মার্কিন শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার প্রস্তাব ভিয়েতনামের : ট্রাম্পের জন্য কি তা যথেষ্ট হবে?

প্রতারণার দায়ে ইভ্যালির রাসেল-শামীমার তিন বছরের কারাদণ্ড

প্রতারণার দায়ে ইভ্যালির রাসেল-শামীমার তিন বছরের কারাদণ্ড

‘শূন্য শুল্ক পরিস্থিতি’ ও যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের’ পক্ষে ইলন মাস্ক

‘শূন্য শুল্ক পরিস্থিতি’ ও যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের’ পক্ষে ইলন মাস্ক

মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ নিজ প্রতিশ্রুতিতে অটল :স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ নিজ প্রতিশ্রুতিতে অটল :স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিপুল পরিমাণ গাঁজা পাচারের চেষ্টা ব্যর্থ : বেশ ক’জন গ্রেফতার

বিপুল পরিমাণ গাঁজা পাচারের চেষ্টা ব্যর্থ : বেশ ক’জন গ্রেফতার

মিয়ানমারের ভূমিকম্পে মৃত বেড়ে ৩ হাজার ৪৫৫ ইউএসএআইডির তিন কর্মী বরখাস্ত

মিয়ানমারের ভূমিকম্পে মৃত বেড়ে ৩ হাজার ৪৫৫ ইউএসএআইডির তিন কর্মী বরখাস্ত

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস নিয়ে আসিফ নজরুলের উদ্বেগ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস নিয়ে আসিফ নজরুলের উদ্বেগ

নির্বাচনের সব কাজ ভালোভাবে এগোচ্ছে : সিইসি

নির্বাচনের সব কাজ ভালোভাবে এগোচ্ছে : সিইসি

আওয়ামী লীগপন্থী ৭২ আইনজীবী কারাগারে, ১১ জনের জামিন

আওয়ামী লীগপন্থী ৭২ আইনজীবী কারাগারে, ১১ জনের জামিন

বাঁশখালীতে বিষ দিয়ে বোনের ধান ক্ষেত জ্বালিয়ে দিলো ভাই

বাঁশখালীতে বিষ দিয়ে বোনের ধান ক্ষেত জ্বালিয়ে দিলো ভাই

নতজানু ও দলকানা সাংবাদিকতা ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটায় -কাদের গণি

নতজানু ও দলকানা সাংবাদিকতা ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটায় -কাদের গণি

কুষ্টিয়ায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশুর ঘর পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ

কুষ্টিয়ায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশুর ঘর পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি -প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি -প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ

আসামিদের ছাড়িয়ে নিতে জীবননগর থানা ঘেরাও

আসামিদের ছাড়িয়ে নিতে জীবননগর থানা ঘেরাও

টাকার লোভে আ.লীগকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে কিছু রাজনৈতিক দল -নজরুল ইসলাম খান

টাকার লোভে আ.লীগকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে কিছু রাজনৈতিক দল -নজরুল ইসলাম খান

গফরগাঁওয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার

গফরগাঁওয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার

চুয়েটে লেভেল-১ স্নাতক কোর্সে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু ৯ এপ্রিল

চুয়েটে লেভেল-১ স্নাতক কোর্সে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু ৯ এপ্রিল

নাটোরে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা

নাটোরে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা