দের ভাগ্য খারাপ

জান্তা বাহিনী-আরাকান আর্মি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

Daily Inqilab শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার থেকে

০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

এককালের সুজলা-সুফলা আরাকান রাজ্য ছিল বাংলাদেশের সাথে যুক্ত একটি উন্নত শান্তিময় জনবসতি। আরাকানের ধান-চালসহ হরেক রকম শস্য ও বিস্তীর্ণ চারণ ভূমির গবাদি পশুতে এই এলাকা ছিল স্বনির্ভর।

সমৃদ্ধ আরাকানে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অসংখ্য মানুষের ছিল কর্মসংস্থান। এ সুবাদে আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ছিল আত্মীয়তা ও পারিবারিক বন্ধন।

১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান স্বাধীনতার সময় আরাকান রাজ্য বাংলাদেশ থেকে আলাদা হয়ে তৎকালীন বার্মা, বর্তমান মিয়ানমারের সাথে যুক্ত হয়। সেই থেকেই আরাকানের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। মিয়ানমারের ইতিহাসে আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিভিন্ন ধরনের অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকলেও পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নেমে আসে শাসকগোষ্ঠীর জুলুম নির্যাতন ও জ্বালাও পোড়াও নীতি।

ইতিহাসে সাড়ে তিন শত বছর আরাকান শাসনে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকলেও পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গা জাতি আজ নিজেদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন নিপীড়ন, জুলুম ও জ্বালাও পোড়াও নীতির কারণে রোহিঙ্গারা আজ তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত।

আরকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারের মগ দস্যু ও জান্তা সরকারের বিভিন্ন অত্যাচারসহ রক্তক্ষয়ী অপারেশনের নামে বহুবার রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সেনাবাহনী ও দস্যুদের যৌথ উচ্ছেদ অভিযানে প্রাণ হারায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু ও নারী-পুরুষ। তখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আরাকান ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় গ্রহণ করে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশী সংস্থার হিসেবে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লাখ বলা হলেও বাস্তবে গত সাত বছরে এ সংখ্যা কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে।

এ বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উখিয়া-টেকনাফের বনভূমিতে ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বসবাসের স্থান করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। পরে দুইটি শিবিরকে একীভূত করায় এখন রোহিঙ্গা শিবিরের সংখ্যা ৩৩টি।

বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে শুধু বসে থাকেনি, সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরে তাদের ভরণ-পোষণ এবং মর্যাদার সাথে তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যতটুকু জানা গেছে, মিয়ানমারের অসহযোগিতা এবং অসমর্থনযোগ্য শর্তের কারণে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে রয়েছে।

এদিকে কক্সবাজারের মতো ছোট একটি জায়গায় অতিরিক্ত ১২ লাখ বা আনঅফিসিয়াল সূত্র মতে, ২০ লাখো মতো রোহিঙ্গার চাপ একটি মারাত্মক বোঝা। এসব রোহিঙ্গার অবস্থানের কারণে পরিবেশ প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের কারণে গোটা কক্সবাজার এলাকায় বিশেষ করে উখিয়া-টেকনাফে বিরাজ করছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের পক্ষ থেকে বিশেষ করে কক্সবাজারবাসীর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের দেশে প্রত্যাবাসন করা হোক।

কিন্তু এতদিন জান্তা সরকারের অসহযোগিতা ও অসমর্থনযোগ্য শর্তাবলির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঝুলে থাকলেও সম্প্রতি সৃষ্টি হয়েছে নতুন সমস্যা। আরাকানের সাথে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের যুদ্ধ চলমান থাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এ যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিস্তীর্ণ বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তেও বিরাজ করছে অস্থিতিশীলতা।

মনে করা হয়েছিল, জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করে ভিটে-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের দেশছাড়া করেছে। জান্তা বাহিনীর পতন হলে বা আরাকান আর্মি ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গাদের সুদিন আসবে। কিন্তু না, ‘সে আশায় গুড়েবালি’! আরাকান আার্ম রোহিঙ্গাদের জন্য আরো বিপদজনক হয়ে দেখা দিয়েছে। জান্তা বাহিনী আর আরাকান আর্মি যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

তাই রোহিঙ্গাদের ভাগ্য খারাপই বলতে হয়। সহসাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে (২৮ ডিসেম্বর) আয়োজিত ‘ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক সংলাপে অংশ নিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ চায় মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, তবে এরই মধ্যে দেশটির সীমান্তের প্রায় শতভাগ আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এখনই কথা বলা যাচ্ছে না। তাই আগামী দুই থেকে ছয় মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা নেই। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সেখানেও শান্তি থাকবে না।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪
বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর
গর্জে ওঠে বীর চট্টলা
বাংলাদেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজার পিরোজপুরের নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজার
মাদারীপুর জেলার নামকরণে ‘শাহমাদার (রা:)-এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান ও স্বীকৃতি মেলেনি
আরও

আরও পড়ুন

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল