ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪

Daily Inqilab রাজশাহী ব্যুরো

০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

রাজনৈতিক ঝড়-ঝাপটা আমি আর ডামি নির্বাচন দিয়ে যাত্রার হাওয়া স্পর্শ করেছিল শিক্ষানগরী রাজশাহীকেও। ২০২৪ সালের প্রথম দিনটির তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে হাড় কাঁপানো শীতে মানুষকে জবুথবু অবস্থায় ফেললেও রাজনৈতিক উত্তাপের পারদ ছিল চড়া। বিরোধী দল তথা বিএনপি নেতাকর্মীদের অত্যাচারের মাত্রার পারদ উঠেছিল চরম পয্যায়ে। কথিত জাতীয় সংসদ নির্বিঘœ করতে ঘরছাড়া আর জেলখানা ধারণ ক্ষমতার চারগুণের বেশি বন্দিতে ছিল উপচেপড়া। আমি আর ডামি নির্বাচন হলেও দলীয় প্রার্থী আর নিজ দলের বিদ্রোহীদের মধ্যেও সংঘর্ষ হানাহানির ঘটনা কম ছিল না। সাত জানুয়ারির নির্বাচনের দিন সাধারণ জনতা ভিন্নরকম বার্তা দিয়েছিল। বিশেষ করে ভোটের দিন স্বেচ্ছা ঘরবন্দি করে রেখেছিল। এর সব কিছু ছিল বন্ধ। ওয়াকার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক জোটসঙ্গী ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরে যান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে। আর অন্য প্রার্থীদের ঘোষণায় বিজয়ী দেখানো হয়। নির্বাচনের পর ফ্যাসিবাদীদের প্রতাপ আরো বেড়ে যায় নগর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত।

ফেব্রুয়ারি মাসে অজানা রোগে (ভাইরাস) দুই শিশু মুনতার (২), মুফসি (৪) মারা যায়। ভাইরাসটি ছিল অজানা। ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ঘটা করে রাজশাহী থেকে ভারতের মায়াঘাট পর্যন্ত (গোদাগাড়ী নৌঘাট) চালু হয়। কিন্তু পদ্মা নদীর নাব্য সঙ্কটের কারণে তা আর চলেনি। মার্চ মাসে কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এদের হাতে খুন হয় তিনজন। রেলস্টেশনে মাইনুল নামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে যায়।

মার্চ মাসে চাঞ্চল্যকর রাজশাহী পলিটেকনিক ছাত্র সনি হত্যার দায়ে ১০ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। সাইবার অপরাধও বেড়ে যায়। টানা খরার পর মৌসুমের সর্বোচ্চ এক দিনে বৃষ্টিপাত হয় ১৩৫ মি.মি। চন্দ্রিমা থানায় চেয়ারে বসে খামে পুলিশের টাকা নেয়ার ঘটনা ভাইরাল হয়।

জানুয়ারিতে তাপমাত্রার পারদ যেমন নেমেছিল ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবার জুন মাসে তা ওঠে ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এপ্রিল মাসে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বেশক’টি ঘটনা ঘটে। নদীতে ডুবে মারা যায় ১৬ জন। সেনাবাহিনীতে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণার সময় ভুয়া তিন সেনাসদস্য আটক হয়। জুলাই মাসে তানোরে স্বামীর পরকীয়ায় বাধা দেয়ায় সাথী বেগম নামে গৃহবধূকে স্বামী পুড়িয়ে হত্যা করে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাস কখনো ভুলবার নয়। অনেক বেদনা ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল শিক্ষা নগরীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে।

তাদের দমনের জন্য পুলিশকে সাথে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীÑ যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ বিভিন্নসহ অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, ডাবলু সরকারসহ নেতারা অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য লাঠি হাতে রুখে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজ। আন্দোলন দমাতে সমস্ত ক্যাডার বাহিনী নামে মাঠে। দুহাতে পিস্তল দিয়ে গুলি চালানো, রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। নগরীর সব ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়া হয়। মেয়েদের ছাত্রী নিবাসেও চলে নির্যাতন। ১৮ জুলাই পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশের গুলিতে আহত হয় ২০ জন। ২৭ জুলাই আটক করে নির্যাতনের পর প্রায় ৩০০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। আন্দোলনের প্রতিটি দিনে প্রচুর শিক্ষার্থী আহত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাপসপাতালে সেখানেও তাদের উপর হামলা করা হয়।

আগস্টের ৪ ও ৫ তারিখ ছাত্র-জনতা রাজপথে সোচ্চার হয়। রুয়েটের সামনে থেকে রেলগেট এলাকায় বিশাল মিছিল নিয়ে গেলে সেখানে ব্যাপক হামলার শিকার হতে হয়। ৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে বিশাল মিছিল নিয়ে তালাইমারি হয়ে নগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার এলাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বাঁধের ওপারে ওঁৎপেতে থাকা সন্ত্রাসী, সামনে পুলিশ, আওয়ামী বাহিনীর হামলার শিকার হয়। সাহেববাজার এলাকায় সংঘর্ষে নিউ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সাকিব আনজুম গুলিতে শহীদ হয়। আরো ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। তালাইমারি হয়ে আসা মিছিলে হামলায় স্বচ্ছ টাওয়ারের সামনে সবুজ নামে এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়। অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। আলুপট্টি মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ হয় রায়হান। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী শহীদ হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ছিল পঞ্চবটি এলাকায় বাঁধের ওপারে ওঁৎপেতে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এক ছাত্রীকে ধরে ধর্ষণের পর মেরে ফেলে নদীতে ফেলে দেয়। এমনি বহু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ৫ আগস্ট তিনজন শহীদ আর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বিকেলে স্বৈরাচারের পতনের খবর আসে। মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। কুমারপাড়া আওয়ামী লীগ কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর করে। সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়ে নগর ভবন। জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়। শেখ মুজিবের ম্যুরালেও ভাঙচুর হয়। ক্ষমতাসীনদের দোষর হয়ে গুলি ও নির্যাতন চালানোর জন্য রোষানলে পড়ে পুলিশ। পুলিশ কমিশনারের সদর দফতর, বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে মনের জ্বালা মেটায় বিক্ষুব্ধরা। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতাপশালী মেয়র, মন্ত্রী, এমপি, পাতি নেতা আর ছিচকে নেতারা লেজ গুটিয়ে গর্তে চলে যায়। এদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়লেও বেশির ভাগ রয়েছে অধরা। অক্ষত রয়েছে তাদের অর্থ ও অস্ত্রভা-ার। স্বল্প পরিসরে জুলাই-আগস্টের দিনগুলোর কথা তুলে ধরা সম্ভব নয়। প্রশাসনে পুলিশ কমিশনারসহ বেশ কিছু পদে রদবদল হয়। বিভাগীয় কমিশনার ডিসিও বদলি হয়। তবে এখনো বিভিন্ন দফতরে বসে আছে স্বৈরাচারের দোসররা।

রাজশাহীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অসিফা আক্তার জেলা প্রশাসক ও প্রথমবারের মতো রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার পদে (এসপি) যোগ দিয়েছেন ফারহানা ইসলাম।

বছরজুড়ে রাজশাহীতে নানা কর্মকা- ঘটলেও কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের মানুষ ব্যস্ত ছিল চাষবাস নিয়ে। ধান, আম, পান, আলুসহ বিভিন্ন শাকসবজি ব্যাপক আবাদ হয়। গবাদিপশু, মাছের উৎপাদনও ছিল লক্ষ্যমাত্রার অনেক উপরে। কিন্তু কৃষকরা তাদের ঘাম ঝরানো ফসলের দাম পায়নি। যে আলু ১০-১২ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছে সেটি সিন্ডিকেটের কবলে বন্দি হয়ে পাঁ-ছয় গুণ দামে ক্রেতাদের কিনতে হয়েছে। বাজারে সব পণ্যের মূল্যের উত্তাপ ছড়িয়েছে সবখানে। প্রত্যাশা ঘটনা-অঘটনের ২০২৪ শেষ হলো। জুলাই-আগস্টে যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ আবার স্বাধীনতার স্বাদা পেয়েছে আগামী বছর নতুন কোনো শুভ বার্তা নিয়ে এগিয়ে যাবে। মানুষ স্বস্তি পাবে।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর
গর্জে ওঠে বীর চট্টলা
জান্তা বাহিনী-আরাকান আর্মি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
বাংলাদেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজার পিরোজপুরের নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজার
মাদারীপুর জেলার নামকরণে ‘শাহমাদার (রা:)-এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান ও স্বীকৃতি মেলেনি
আরও

আরও পড়ুন

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল