বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর

Daily Inqilab সাঈদ আহমেদ

০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

বিদায় নিচ্ছে ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল। বছর জুড়ে আলোচনা-আবর্তিত হয়েছে বিচার বিভাগকে ঘিরে। সচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলো বিচার বিভাগের উচ্চ আদালত। বছরের মধ্যভাগে আলোচনার জন্ম দেয় সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের রায়। সেপ্টেম্বরে আলোচনার জন্ম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির প্রেক্ষিতে বিতর্কিত ১২ বিচারপতির বেঞ্চ প্রত্যাহার। ডিসেম্বরে আলোচিত হয় ৩ বিচারপতির স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। আরো ৩ বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তদন্ত। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল রায়, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃজীবীতকরণ, ‘জয় বাংলা’ জাতীয় শ্লোগানের রায় বাতিলসহ অনেক রাজনৈতিক ইস্যুতে উচ্চ আদালত ছিলো সরব। এর আগে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে সুপ্রিমকোর্ট বারের আইনজীবীরা ছিলেন সোচ্চার।

২০২৪ সনের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সরকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি দায়িত্ব নিয়েই জুলাই-আগস্ট গণহত্যার দ্রুত বিচার, অভ্যুত্থানকালে গ্রেফতারদের মুক্তি এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

অন্তর্বর্তীকালীন পরপরই আইন ও বিচারাঙ্গনে লাগে বড় ধরনের পরিবর্তনের ধাক্কা। হাসিনা নিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন পালিয়ে যান। তার নিয়োগ বাতিল করে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেয়া হয় সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: আসাদুজ্জামানকে। তিনি নিয়োগ লাভের পর পর্যায়ক্রমে হাসিনা সরকার নিযুক্ত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। তাদের স্থলে নিয়োগ দেয়া হয় নতুন আইন কর্মকর্তা।

১০ আগস্ট হাসিনার অনুগত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ফুলকোর্ট সভা ডাকেন। এ সভাকে ‘জুডিসিয়ারি ক্যু’ আখ্যা দিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ছাত্র-জনতার দাবির প্রেক্ষিতে ওইদিনই পদত্যাগের ঘোষণা দেন ওবায়দুল হাসান।

এ বছর ১০ আগস্ট পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি। ১১ আগস্ট প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সরকার পরিবর্তিত হওয়ার অন্তত দুই মাস পর (৮অক্টোবর) হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয় ২৩ অতিরিক্ত বিচারপতি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট বিভাগ পৃথক আবেদনের শুনানি নিয়ে ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ বাতিল করেন। একই সঙ্গে এ দিন সরকারি ছুটি সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাতিল করেন। ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগ বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করে রায় দেন। কাউন্সিল গঠনের পর হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। আরো তিন বিচারপতির দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগ এখন তদন্তাধীন রয়েছে।

বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাসের রায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও খালাসের আদেশ, বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা, সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের আদেশ বহাল, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৭ আসামিকে খালাসের রায়সহ আলোচিত অনেক আলোচিত রায় ও আদেশ দেন উচ্চ আদালত। এর মধ্যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের আদেশ ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সংক্রান্ত রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর বিধানের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার ফলে তিনটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়, যা জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এতে হাজারো মানুষের আত্মদান, হাজারো মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রেফারেন্সের ভিত্তিতে এবং জনগণের অভিপ্রায়ে। এখন জাতির প্রত্যাশা, এমন একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা, যেটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, নতুন গণতন্ত্র, নতুন স্বাধীনতা ও নতুন বাংলাদেশ কার্যকরভাবে নিশ্চিত করবে।

এদিকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে আ’লীগ সরকার ২০১০ সালে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর সরকার এ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করেন। হাইকোর্ট বিভাগ নবনিযুক্ত অতিরিক্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে বিচারপতি গোলাম মর্তুজাকে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় ১৪ অক্টোবর। এ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার শুরু হয় ১৭ অক্টোবর। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২টি মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনাল থেকে।

এ ছাড়া পরিবর্তনের পরশ লাগে আইনজীবী সমিতিগুলোতে। সুপ্রিমকোর্ট বারের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভকারী সম্পাদক আওয়ামী আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর লাপাত্তা হয়ে যান। অবশ্য শেখ হাসিনার আগেই লাপাত্তা হয়ে যান প্রধান বিচারপতিকে আদালত থেকে নামিয়ে দেয়ার দম্ভোক্তিকারী, ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। নৌকাযোগে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার হন হাসিনার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে আত্মগোপনে চলে যান হাসিনা অনুগত অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন। হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। গ্রেফতার হন সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক নূরুল ইসলাম সুজন, মাহবুব আলী।

হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিমকোর্ট বার থেকে লাপাত্তা হয়ে যান অনেক ডাক সাইটে আওয়ামী আইনজীবী নেতারা। ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ’র আহ্বায়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো: মামতাজউদ্দিন ফকির, সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল, অ্যাডভোকেট সানজীদা খানম, নাহিদ সুলতানা যুথি, তৌফিকা করিম, খুরশিদ আলম খান, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবু আব্দুল্লাহ, অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাদল, অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল।

৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে শুধু ফ্যাসিস্ট সরকারই উৎখাতই হয়নি। বিচারাঙ্গনও ফ্যাসিজম মুক্ত হয়। ওলটপালট হয়ে যায় আইন ও বিচারাঙ্গন। যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কোনো পট-পরিবর্তনের সময়ই ঘটেনি। এ হিসেবে ২০২৪ সালকে চিহ্নিত করা যায় বিচার ও আইনাঙ্গনে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার বছর হিসেবে।

 


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪
গর্জে ওঠে বীর চট্টলা
জান্তা বাহিনী-আরাকান আর্মি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
বাংলাদেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজার পিরোজপুরের নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজার
মাদারীপুর জেলার নামকরণে ‘শাহমাদার (রা:)-এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান ও স্বীকৃতি মেলেনি
আরও

আরও পড়ুন

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল