বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

গর্জে ওঠে বীর চট্টলা

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গর্জে ওঠেছিল বীর চট্টলা। জুনের শুরু থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। পরে তা গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পতন হয় জালিম শেখ হাসিনার। অবসান হয় তার সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের। এ আন্দোলনে শাহাদাত বরণ করেছেন ১১ জন শিক্ষার্থী। আহত হয়েছিলেন শত শত ছাত্র-জনতা। অনেকেই জীবনের তরে চোখ হারিয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন কেউ কেউ। আন্দোলন দমনে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও চলেছে মাফিয়া হাসিনার লেলিয়ে দেয়া গু-াবাহিনী ও আওয়ামী পুলিশের নিষ্ঠুরতম নির্যাতন। নির্বিচারে গুলি, বোমা, টিয়ারশেলের মধ্যে বুক পেতে দিয়েছে অকুতোভয় ছাত্র-জনতা। চট্টগ্রামের মাটি বিপ্লবীদের রক্তে ভেজা। জুলাই বিপ্লবেও রক্তে ভিজেছে বীর চট্টলার মাটি। তবুও মাথা নত করেনি এখানকার বীর সন্তানরা। জালিমের অবসান না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ দখলে রেখেছে লড়াকু জনতা।

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দান থেকে প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন হাবিলদার রজব আলী। মূলত তখন থেকেই আধিপত্যবাদী আর দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সূচনা। সাতচল্লিশের পাকিস্তান আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে পুরোভাগে ছিল চট্টগ্রাম। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাও এ মাটি থেকেই। স্বাধীনতার ঘোষণাও আসে কালুরঘাটের ঐতিহাসিক বেতারকেন্দ্র থেকে। এরপর শেখ মুজিবের বাকশালী শাসন, দুই দফায় শেখ হাসিনার জালিমতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা এ চট্টগ্রাম থেকেই। ভারতীয় নীলনকশায় ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রহসনের নির্বাচনে ২০০৮-এ ক্ষমতা দখল করে শেখ হাসিনা। এরপর আধিপত্যবাদী ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে দেশে কায়েম হয় মাফিয়াতন্ত্র। বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের হত্যা থেকে শুরু করে আধিপত্যবাদী বিরোধী কণ্ঠস্বরদের সাজানো বিচারে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো, নির্বিচারে গুম, খুন তথা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ছিল উচ্চকণ্ঠ। হাসিনার লেলিয়ে দেয়া গু-াবাহিনী ও র‌্যাব পুলিশের নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্যেও রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ছিল চট্টগ্রামের মানুষ। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ইসলামী সংগঠন রাজপথে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। আন্দোলন দমাতে নিষ্ঠুরতম ক্র্যাকডাউন চালানো হয়। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার করে কারাপ্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশ আর আওয়ামী ক্যাডারদের নির্বিচারে গুম, খুনের শিকার হন অগণিত রাজনৈতিক নেতাকর্মী। বাড়িঘর ছাড়া হন হাজার হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক।

এরপরও রাজপথ ছাড়েননি রাজনৈতিক কর্মীরা। বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচি পালিত হয়েছে সফলভাবে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর রাজপথে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাজপথে নেমে আসে। তবে আওয়ামী ছাত্রলীগের দস্যুবাহিনীর কাছে জিম্মি থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বদলে চট্টগ্রাম শহরে আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। নগরীর ষোলশহর ২ নং গেইট থেকে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে শরিক হন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এবং মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। ধীরে ধীরে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। শুরুতেই এ আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু শেখ হাসিনার নির্দেশে তার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের দমনে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের মাঠে নামিয়ে দেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিকৃষ্টতম দোসর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ক্যাডার বাহিনী যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে। পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। প্রথম দিনেই শাহাদাত বরণ করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরামসহ তিনজন। গুলিবিদ্ধ হন অগণিত ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনার খুনি বাহিনীর তা-বের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে পুরো চট্টগ্রাম। ছাত্রদের সাথে রাজপথে নেমে আসে সর্বস্তরের মানুষ। আন্দোলন মহানগর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা পর্যায়ে। রাজপথ, রেলপথ অবরোধসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। আন্দোলন যত তীব্র হয় খুনি হাসিনার রক্তপিপাসা ততই বেড়ে যায়। দলীয় ক্যাডার, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী খুনের নেশায় মত্ত হয়ে উঠে। সবকিছু উপেক্ষা করে রাজপথের লড়াইয়ে শামিল হয় সর্বস্তরের মানুষ। রাজধানী ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে চলে ক্র্যাকডাউন। পুলিশ বাহিনী দলীয় লাঠিয়ালের ভূমিকায় মাঠে নামে। গ্রেফতার করা হয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ শত শত ছাত্র-জনতাকে। রিমান্ডের নামে চালানো হয় বর্বরতম নির্যাতন। হত্যাকা- আর ধরপাকড়ের পরও রাজপথে বাড়তে থাকে জনতার মিছিল। আগস্টের প্রথম দিন থেকে নগরীর প্রতিটি সভা সমাবেশে লাখো মানুষের ঢল নামে। নিউমার্কেট চত্বরে ইতিহাসের নজিরবিহীন বিশাল সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। সেখান থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন। শেখ হাসিনার পতনের আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তখনই মরণ কামড় দেয় আওয়ামী দস্যু ও পুলিশবাহিনী। দমন-পীড়নে আরো বেশি গর্জে উঠে ছাত্র-জনতা। প্রতিরোধের মুখে একপর্যায়ে পিছু হটতে থাকে হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা। নিউমার্কেট চত্বর ছাড়িয়ে জনতার প্রতিরোধ আন্দোলন মহানগরীর অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। ৩ ও ৪ আগস্ট চট্টগ্রাম ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিলেন শুরু থেকে। ৫ আগস্ট আসে মহাবিজয়। শেখ হাসিনা তার প্রভুরাষ্ট্র ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরে গোটা চট্টগ্রাম উল্লাসে ফেটে পড়ে। লাখো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। নারী পুরুষ শিশু থেকে শুরু করে সব শ্রেণিপেশার মানুষ এককাতারে শামিল হন। বিজয়ের উল্লাসে আনন্দ অশ্রুতে ভাসেন চট্টগ্রামের বিপ্লবী জনতা। এক নতুন বাংলাদেশ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন সবাই। জালিম হাসিনার বিরুদ্ধে বিএনপির শুরু করা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন এমন অভ্যুত্থানে আধিপত্যবাদী মদদপুষ্ট হাসিনার মাফিয়া শাসনের অবসান হয়। অতীতের সব আন্দোলনের মতো জুলাই বিপ্লবে চট্টগ্রামবাসীর বীরত্ব গাঁথা ২০২৪ সালের আলোচিত ঘটনা। আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যের নগরী চট্টগ্রামের বীর জনতার এ আন্দোলন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

 


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪
বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর
জান্তা বাহিনী-আরাকান আর্মি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
বাংলাদেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজার পিরোজপুরের নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজার
মাদারীপুর জেলার নামকরণে ‘শাহমাদার (রা:)-এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান ও স্বীকৃতি মেলেনি
আরও

আরও পড়ুন

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

ব্রাইটনের বিপক্ষে আর্সেনালের হোঁচট

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

টানা দ্বিতীয় জয়ে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত সিটির

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রিকেলটনের মহাকাব্যিক ইনিংস,রান পাহাড়ের চাপে পাকিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

রহমতের লড়াকু সেঞ্চুরিতে জয়ের স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল