ইসলামের সেবায় বঙ্গবন্ধু
১৭ মার্চ ২০২৩, ১২:৪২ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৮ পিএম
শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপূরুষ ‘দরবেশ শেখ আউয়াল’ যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) এর সাথে ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় এলাকায় আগমন করেন। এই বংশের ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তন ব্যক্তিগণ ছিলেন সকলেই বুযুর্গ, দরবেশ, ওলী এবং সর্বক্ষেত্রে ইসলামপ্রিয় ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর রক্তধমনিতে এই মহান দরবেশ এবং ওলীগণের রক্ত প্রবাহিত ছিল। যুগেযুগে এই শেখ পরিবার ইসলামের সুমহান খেদমতে অতুলনীয় অবদান রেখেছে। বর্তমানেও সেই রক্তের উত্তরাধিকারধন্য প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ইসলাম এবং মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গিত করে বিশ^বাসীর নিকট ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান নামটি ইসলামের একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ নাম। আরব জগতে ‘শেখ’ বলে তাপস বা বযুর্গ ব্যাক্তিকে, যিনি সর্বদাই আল্লাহর ধ্যানে ব্যস্ত থাকেন। আর ‘মুজিবুর রহমান’ এর অর্থ হলো: রহমানের ডাকে সাড়াদানকারী ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিজীবন, শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিকজীবন এবং প্রশাসনিকজীবনে একজন উল্লেখযোগ্য এবং অতুলনীয় মুসলিম ছিলেন। তিনি বাল্যকাল থেকে ধর্মপরায়ণ ছিলেন। মুসলিম ছিলেন বলেই তিনি শিক্ষাজীবনে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন করেন।
তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে একদা বলেছিলেন, ‘আমি মুসলিম, আমি কমিউনিষ্ট নই’। বঙ্গবন্ধুর এসকল কথা প্রমাণ করে যে, তিনি একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন। তিনি আল্লাহর প্রতি ভরসাকারী একজন মুমিন ছিলেন।
তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও কুচক্রী মহল তাঁর দলের ইসলামে বিশ্বাস নেই বলে অপপ্রচার চালাতো। এর জবাবে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগমুহূর্তে তিনি এক বেতার ভাষণে বলেন: ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ^াসী নই। একথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাসধারী ইসলামে বিশ^াসী নই, আমারা বিশ^াসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে কারীম (সা.) এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফেকদের বিরুদ্ধে, যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা শায়েস্তা করার জন্য।’
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য তাঁর সমালোচকদের উচিৎ জবাবই শুধু নয়, তাঁর খাটি মুসলমান হওয়ার দলিলও। যে মানুষটির জন্ম শেখ তথা বুযুর্গ পরিবারে, যার পূর্বপূরুষগণ দরবেশ এবং অলিউল্লাহ ছিলেন। তারা বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। তিনি পীর-ওলী, বুযুর্গদের প্রাণভরে ভালবাসতেন। তার প্রমাণ হলো যে, তিনি ১৯৭৪ সালে ওলীকুল স¤্রাট বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর মাযার যিয়ারত করেন।
বঙ্গবন্ধু হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, কিংবদন্তি জননেতা এবং বাঙালি জাতির মুক্তিদূত। তিনি দেশ, জাতি এবং ইসলামের জন্য যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তাঁর কোনো তুলনা হয় না। তিনি এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মূল ধারার ইসলামের সূচনা করেন। এদেশের মুসলিমদের কল্যাণে এবং ইসলামের উৎকর্ষের নিমিত্তে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এতে ইসলামের দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। আর তা হলো: ‘ইসলামিক ফাউন্ডশনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো মসজিদ, ইসলামীকেন্দ্র, একাডেমী ও ইনিস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত করা।’ তিনি তাঁর জীবদ্দশায় বায়তুল মোকাররমকে জাতীয় মসজিদ ঘোষণা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাতে নানাবিধ ইসলামসম্মত কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে এখন পক্ষকালব্যাপী পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) উৎযাপিত হয় এবং দেশের প্রখ্যাত ও বিদগ্ধ আলেমগণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোর্কারমে আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতা হয়। এছাড়াও শবে-ই-বরাত ও শবে-ই-ক্বদর সহ পবিত্র মাহে রমাদ্বানে এর অঙ্গণে ইসলামী বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ৫৬০টি মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করছেন, যা এককভাবে কোনকালে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
ইসলামের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদানগুলো হলো: তিনি স্বাধীনতা উত্তর আলেম-ওলামার সমন্বয়ে মহানবী (সা.) এর জীবন ও কর্ম জনগণের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য ‘সীরাত মজলিস’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সীরাত মজলিসের উদ্যোগে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে বৃহত্তর আঙ্গিকে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে জাতীয় পর্যায়ে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে এই পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের পাশাপাশি শব-ই ক্বদর এবং শব-ই বরাত উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং উল্লেখিত দিনগুলোতে দেশের সকল সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছরে পাকিস্তানি শাসকরা মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করতে পারেনি। অথচ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শাস্তির বিধান জারী করেন। এটা ইসলাম ও মুসলমানগণ তথা গোটা জাতীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী কল্যাণ বয়ে এনেছে।
বঙ্গবন্ধু ইসলামী তাহজিব, তামাদ্দুন সংরক্ষণে এবং দেশের সর্বত্র ইসলামের সঠিক আকীদা ও বিশ^াস ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং ইসলামী শিক্ষা স¤প্রসারণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’কে পুনর্গঠন করেন। ইতোপূর্বে মাদ্রাসা বোর্ড স্বায়িত্তশাসিত ছিল না, বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’ নামকরণ করেন। তিনি জনগণের হৃদয়ে ধর্মীয় অনুভূতি জাগরুক করতে সর্বপ্রথম বেতার এবং টেলিভিশনে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও তাফসীরের ব্যবস্থাসহ নানাবিধ ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার অনুমোদন প্রদান করেন। তিনি দিবসের কর্মসূচী কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু করার এবং সমাপ্ত করার নির্দেশনা প্রদান করেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। তিনি বেতার-টেলিভিশনে আযান ও দোয়ার প্রচলন করেন। ইসলামের জন্য বঙ্গবন্ধুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান যেন স্বল্পব্যয়ে পবিত্র হজ্জ পালন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে তিনি ‘হিযবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হজ্জযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে হাজীদের অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ করেন। বিশ^ ইজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জমি বরাদ্দসহ কাকরাইলে মারকাজ মসজিদ স¤প্রসারণের জন্য জমি বরাদ্দ দেন। তিনি সর্বপ্রথম রাশিয়াতে ইসলাম প্রচারকদের একটি দল প্রেরণ করেন। বঙ্গবন্ধু ইসলামের খেদমতে অনন্য অবদান রাখতে ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেন এবং সেখানে যে বক্তব্য প্রদান করেন তাতে ইসলাম ও বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা সমুন্নত হয়। তিনি ওআইসি সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলিম বিশে^র নেতৃবৃন্দের সাথে ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের পক্ষ সমর্থন করে ১ লক্ষ পাউন্ড চা নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের জন্য এবং ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর এসব অনন্য অবদান তাঁকে দেশ ও বিশে^র মুসলিমদের মনি কোটায় অমর করে রেখেছে। তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যও অতুলনীয় অবদান রেখে চলেছেন, যা টুঙ্গীপাড়ার শেখ পরিবারের আদি ঐতিহ্য বহন করেছে।
লেখক: গভর্নর,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শারজাহতে ৩৪ বছরের অপেক্ষা ঘোচালেন শান্ত
প্রথম আঘাত তাসকিনের
সিলেটে ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের পরীক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত
'ডিডি একা নয় হলিউডে এমন অসংখ্য রাঘব-বোয়াল রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে'
শরণখোলায় বিএনপি.র আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
সম্মানসূচক ডক্টরেট অর্জন করেছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশী সমাজকর্মী ফয়েজ উদ্দিন এমবিই
পাঠ্যবইয়ে মুসলমানদের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে
যুক্তরাষ্ট্রের নারী প্রেসিডেন্ট কি অধরাই থেকে যাবে?
গণঅভ্যুত্থানের সাবলিমিটি : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন
গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে
পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অফিস চালাচ্ছেন আওয়ামী কর্মকর্তারা !
ড. ইউনূসসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ করলেন লন্ডনে পলাতক আনোয়ারুজ্জামান
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধে কাজ করতে আগ্রহী ট্রাম্প
হতাশ মার্কিনিরা দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন
সহিংসতায় ফের উত্তপ্ত মণিপুর নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা
‘সংখ্যালঘু’ তকমা ফিরে পাচ্ছে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়
মার্কিন মুল্লুকে ক্ষমতার হাতবদল অনিশ্চয়তায় নেতানিয়াহুর নীতি
জার্মানিতে অবিলম্বে আস্থা ভোট চান বিরোধীরা
জানুয়ারি থেকে বোরকা পরা নিষিদ্ধ সুইজারল্যান্ডে
যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ে অবৈধ অভিবাসীরা