তামিমের স্মরণীয় ৩ ঘণ্টা
০৮ জুলাই ২০২৩, ১১:১৮ পিএম | আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০৫ এএম
আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরদিন চট্টগ্রামে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। নাটকীয় নানা ঘটনাপ্রবাহের পরদিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এরপর প্রত্যাহার করেন অবসরের ঘোষণা। আগেও নানা সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েক দফায় দেখা ও কথা হয়েছে তামিমের। তবে এবারের অভিজ্ঞতা তার জন্য অনন্য। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা দারুণভাবে স্পর্শ করেছে তাকে। অবসরের ঘোষণা প্রত্যাহার করা এই ব্যাটসম্যান বললেন, এই ভালোবাসা ও ভরসার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি পারফরম্যান্স দিয়েই।
গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা ও আলোচনার শুনুন তামিমের জবানীতেই :
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু এবারের দেখাটা অন্যরকম এবং দারুণ আনন্দের। সেটা শুধু অবসরের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার কারণেই নয়, আরও বেশি কিছু কারণে। খুবই সারপ্রাইজড হয়েছি। অবশ্যই ভালোও লেগেছে। সবকিছু তো বলা যায় না, তবে কিছুটা বলতে পারি।
চট্টগ্রাম থেকে সকালেই ফিরে আসি ঢাকায়। আগেই সেটি প্ল্যান করা ছিল। আমার ফোন কখনও বন্ধ, কখনও ‘আনরিচেবল’ অবস্থায় ছিল। সত্যি বলতে, অবসরের ঘোষণা দেওয়ার পর এত এত ফোন, ম্যাসেজ, এসব ভালো লাগছিল না। পরিবারের সঙ্গে একটু নিজের মতো থাকতে চাচ্ছিলাম। কখনও কখনও ফোন খুলেছি বটে, তবে কারও কল বা ম্যাসেজে সেভাবে সাড়া দেইনি।
তবে মাশরাফি ভাইেয়র কল তো ইগনোর করার কোনো উপায়ই নেই। সেটা আমি কখনোই করিনি। অবসরের ঘোষণার পর ভাইয়ের সঙ্গে ম্যাসেজে কথা হয়েছিল। আজকে দুপুরে আবার তার ফোন পেলাম। ভাই বললেন, ‘কীরে, প্রধানমন্ত্রী তোকে খুঁজতেছে, তোর কোনো খবর নাই!’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কালকেও এরকম একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, সাংবাদিকদের কয়েকজন আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি, কারণ আসলে এরকম কিছু হয়নি। আজকে মাশরাফি ভাই বলার পর বললাম, ‘কোথায়, আমি তো জানি না!’ উনি তখন বললেন যে প্রধানমন্ত্রী উনাকে বলেছেন। ভাই আমাকে বললেন দ্রুত রেডি হতে।
দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে আমরা যাই গণভবনে। কক্ষে পা দেওয়া মাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘কি তামিম, কী সব পাগলামো নাকি করছো! এসব করলে তো চলবে না। সবকিছু মাথা থেকে সরিয়ে ফেলো...।’ তিনি সবসময় এত আন্তরিক ও অধিনায়ক নিয়ে কথা বলেন, কোনো জবাব থাকে না। আমি শুধু হাসলাম। তার পর কথা চলল দীর্ঘক্ষণ। আমার জীবনের এটি অনেক বড় স্মরণীয় এক ঘটনা। যেটি বললাম, আগেও অনেকবার অনেক জায়গায় উনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু আজকেরটি অন্যরকম।
শুরুতে মাশরাফি ভাইয়ের সামনে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। পরে আলাদা করে কথা বলেছেন, সেখানে আমি আর আয়েশা ছিলাম শুধু। পাপন ভাই আসার পরও একসঙ্গে সবার কথা হয়েছে। তবে ২ ঘণ্টার বেশি সময় মনে হয় আলাদা করেই কথা বলেছেন আমার সঙ্গে। আমার অবসরের কারণ আমি ব্যাখ্যা করেছি উনার কাছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক কিছুও বলেছি, যতটা সম্ভব। উনি সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে সব শুনেছেন, প্রশ্ন করেছেন, নিজে থেকে অনেক কিছুই জানতে চেয়েছেন। খুব আন্তরিকভাবেই সব কিছু শুনেছেন, কথা বলেছেন।
ফিটনেস নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলার প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। আমি পাপন ভাইয়ের সামনেই বলেছি যে, ‘আমি তো কোচের সঙ্গে কথা বলেই সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে কথা বলেছি। কোচ তো কনভিন্সড ছিলেন। এরপর যদি কিছু হয়ে থাকে, পাপন ভাই একটি মিডিয়াকে যেভাবে বলেছেন, সেটা আমার খারাপ লেগেছে। তাকে হয়তো কেউ ভুল তথ্য দিয়েছে।’ পাপন ভাইও হয়তো সেটা তখন বুঝতে পেরেছেন।
তবে পাপন ভাইয়ের সেই কথাই যে অবসরের কারণ নয়, প্রধানমন্ত্রী তা বুঝতে পেরেছেন। উনি বলেছেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খেলায় ফিরতে হবে।’ শুধু তা-ই নয়, চট্টগ্রামে যে লোকে মিছিল করছে, অনেকে কান্নাকাটি করেছে, এসব ছবি-ভিডিও দেখে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘দেখো, শুধু আমার কথা নয়, মানুষের কথা ভাবো। কত মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। সেটির মূল্য দিতে হবে না?’ দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এভাবে বলেন, এরপর তো আর কিছু বলার থাকে না।
আমি অন্তত তিন দফায় বলেছি, ‘আপনি সবই শুনলেন, এখন এই অবস্থায় আর ফিরতে চাই না।’ কিন্তু উনি বলেছেন যে ফিরতেই হবে। সেখানে তো ‘না’ করার উপায় নেই।’ তবে আমি বলেছি যে আমার একটু নিজের মতো সময় লাগবে এক-দেড় মাস। উনি বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই। আমার যে কিছু অসুস্থতা আছে, সেসবের জন্য কোথায় কোন ডাক্তারের কাছে গেলে ভালো হবে, সেসব পরামর্শও দিলেন। এই সময়টায় কীভাবে কী করতে পারি, এসব কথাও বললেন। উনার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ।’
অধিনায়কত্বের কথা আমি কিছু বলিনি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও কিছু বলেনি। উনি বলেছেন যে, ‘তোমাকে বিশ্বকাপে মাঠে থাকতে হবে, আার কোনো কথা নেই।’ মাত্রই এত কিছু হলো, এখনই ভাবতে চাই না যে অধিনায়কত্ব করব নাকি শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে থাকব। ফেরার পর সেটা নিয়ে ভাবব।
প্রধানমন্ত্রী অনেক ব্যক্তিগত গল্পও করেছেন। ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে গিয়েছিলাম আমি আর আয়েশা। সেই কথা উনাকে বললাম। তখন উনি বঙ্গবন্ধু ও তাদের পরিবারের অনেক কথা বললেন। কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কান্না করে ফেললেন। তার অনুভূতিগুলো আমাদেরও টাচ করেছে খুব। আয়েশার সঙ্গেও অনেক কথা বলেছেন উনি। আয়েশাকে মাঠে নিয়ে যাই না, খেলা দেখতে নিয়ে যাই না বলে আমাকে বকাও দিলেন বেশ! পরে আয়েশাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘এরপর যদি তামিমের মাথায় কোনো উল্টাপাল্টা ভাবনা আসে, তুমি সরাসরি আমাকে ম্যাসেজ দেবে আর ওকে নিয়ে আসবে আমার আছে।’ উনার এই ধরনের অনেক গল্প আমি শুনেছি, এবার নিজের সঙ্গে হলো। অনেকের কাছে এসব অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু তার যে আন্তরিকতা, তা অসাধারণ।’
আমি চেষ্টা করব উনার এই ভালোবাসার সম্মান যেন রাখতে পারি। গতকাল (গতপরশু) থেকে সবার যে ভালোবাসা পেয়েছি ও জানতে পেরেছি, তাতেও আমি অনুপ্রাণিত। সাফল্যের গ্যারান্টি তো দিতে পারি না। তবে চেষ্টায় কমতি রাখব না, এটা কথা দিতে পারি।’
‘ফিট হয়ে খেলায় ফেরা তামিমের দায়িত্ব’
‘আমার দায়িত্ব ছিল তামিমকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া, ব্যস। আর কিছু জানি না...’, শুরুতে আলোচনার গভীরে যেতেই চাইছিলেন না মাশরাফি বিন মুর্তজা। পরে অবশ্য প্রেক্ষাপট কিছুটা শোনালেন বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক। পাশাপাশি তিনি বললেন, সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণের দায় এখন তামিমেরই। প্রধানমন্ত্রীর সামনেই সেটা তিনি তামিমকে বলেছেন বলেও জানালেন মাশরাফি।
মাশরাফির মাধ্যমেই তামিমকে গতপরশু গণভবনে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আলোচনার পর অবসরের ঘোষণা প্রত্যাহার করন তামিম। পরে দেশের শীর্ষস্থানীয় ঐ নিউজ এজেন্সির সঙ্গে আলাপচারিতায় এই বৈঠকের পেছনের গল্প শোনালেন মাশরাফি, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিলেন। তামিম তো সবকিছু থেকে দূরে ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাই আমাকে বলেছেন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি তাকে বলেছি যে, ‘তামিমকে আমি নিয়ে আসছি আপনার কাছে।’ তামিমকে আমি বলেছি যে, ‘তুই গিয়ে মনের কথা বল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে কথা আছে, সেটা তিনি বলবেন। তারপর যে সিদ্ধান্ত হওয়ার, হবে।’ আমার দায়িত্ব ছিল ওকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া। আমি নিজে এখানে কী চাই, সেটা ভিন্ন জিনিস। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। তিনি কথা বলবেন, দিক নির্দেশনা দেবেন, সবকিছু করবেন। এই তো। আমার ভূমিকা কেবল নিয়ে যাওয়া।’
শেষ পর্যন্ত সবকিছু যেভাবে শেষ হলো, তাতে স্বস্তিই অনুভব করছেন বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক, ‘এর চেয়ে ভালো সমাধান আমি আশা করিনি। তামিম বিরতি চেয়েছে, সেটা নিক। পুরো ফিট হয়ে, মানসিকভাবে তরতাজা হয়ে ফিরুক। কিন্তু এভাবে অবসরের মানে নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক কিছুই হয়। কোচের সঙ্গে ঝামেলা হতে পারে, বোর্ডের সঙ্গে হতে পারে। আমার ২০ বছরের ক্যারিয়ার আর অধিনায়কত্বের ৫-৬ বছরে তো কম হয়নি এসব। সব দলেই কম-বেশি এসব হয়। এসব সামলেই চলতে হয়।’
মাশরাফির মতে, এই অধ্যায়ের আপাতত সমাধান হলেও মূল চ্যালেঞ্জটি সামনে। অবসরের ঘোষণা তুলে নিলেও আপাতত এক-দেড় মাসের বিরতি নিচ্ছেন তামিম। ফিরবেন তিনি এশিয়া কাপ থেকে। বাংলাদেশকে ৫০টি ওয়ানডে জয়ে নেতৃত্ব দেওয়া মাশরাফির আশা, জেদ ও পরিশ্রমের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে আরও খাঁটি হয়ে ফিরবেন তামিম, ‘আমার কথা হলো, সে যেন ট্রেনিং করে পুরো ফিট হয়ে আসে। দায়িত্ব এখন পুরোপুরি ওর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনেই ওকে বলেছি, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ হাজার রান করছিস, তোর ক্যারেকটারে সেই দাপট থাকা উচিত। এত আমতা আমতা করে, এত সংশয় নিয়ে ক্রিকেট খেলা যাবে না। ক্রিকেটে অভিমানের কোনো মূল্য নেই। এভাবে অবসর নিলে তিন মাস পর তোকে কেউ মনে রাখবে না। মনে রাখার মতো কিছু করতে হবে। এটাও বলেছি ওকে, “তুই বাংলাদেশের জন্য খেলছিস, এতে তোর গর্ব অনুভব করা উচিত। বাংলাদেশ তোর প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, তোর চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত দলের প্রতি। ১৫ হাজার রান করে যদি দলের ভেতরে-বাইরের চাপ নেওয়ার মানসিকতা না থাকে, তাহলে অবসর নেওয়াই ঠিক আছে।” এখন এসব কথায় ওর খারাপ লাগতে পারে, তবে ক্রিকেট খেলা এতটা সহজ নয়। তামিম আশা করি ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে।’
বিভাগ : খেলাধুলা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক