তৃতীয়বারের মতো অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল বিশ্বকাপ জিতলো উত্তর কোরিয়ার নারী দল। কীভাবে এই খেলায় উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারছে বিচ্ছিন্ন এই দেশ? জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এবার জুড়লো উত্তর কোরিয়ার নাম। তিনবার অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবল বিশ্বকাপ জিতলো তারা। ২০২৪ সালে উত্তর কোরিয়ার নারীরা অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছে। অক্টোবর মাসে এই দেশেরই অনূর্ধ্ব-১৭ টিম তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে যাবে।

জাতিসংঘের মতে, ‘‘বর্তমান বিশ্বে উত্তর কোরিয়ার মতো আর কোনো দেশ নেই।'' তবুও তারা কীভাবে যুব ফুটবলে এমন ভেলকি দেখাচ্ছে? এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা ও নীতি বিষয়ক অধ্যাপক ড. জুং ভু লি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও পরিচিতি বোঝানোর হাতেগোনা কয়েকটি পন্থার একটি আন্তর্জাতিক খেলার ময়দান। ফলে তাদের প্রেক্ষিত থেকে, এই ধরনের বড় সাফল্য আসলে আন্তর্জাতিক দর্শকের সামনে জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারার একটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। একই সাথে, নিজের দেশের ভেতর উত্তর কোরিয়া তাদের নেতৃত্বকে মহিমান্বিত করার জন্য খেলাধুলাকে প্রোপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে।''

স্পষ্ট ও সুচিন্তিত কৌশল

উত্তর কোরিয়ায় ফুটবল রীতিমত জনপ্রিয়, কিন্তু তারা জানে যে সিনিয়র ফুটবলের শীর্ষ স্থানে পৌঁছাবার তুলনায় যুব লেভেল ফুটবলের শীর্ষে পৌঁছানোর যাত্রা কিছুটা সহজ। ফলে, তাদের নজর ঘোরে যুব নারী ফুটবলের দিকে, যেখানে এই যাত্রা আরো সহজ। কিন্তু এই কারণেই যুব নারী দলের পারফর্মান্স থেকে লাভবান হয়নি দেশের সিনিয়র দল, কারণ এই নীতির লক্ষ্য তা নয়। লক্ষ্য, শুধুই জয়।

ড. জুং ভু লি বলেন, ‘‘তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত ও উঠতি ক্লাবগুলির মাঝের ফারাকও অনেক, কারণ, বেশ কিছু ইউরোপিয়ান দেশে পেশাদার লিগ থাকে, আর তারা নানা মহল থেকে সাহায্য পেয়ে থাকেন। যুব ফুটবলের দুনিয়ায় আমার মতে, ইউরোপিয়ান স্পোর্টস সংস্থাগুলি আসলে আনন্দ পাবার পেছনে বেশি জোর দেয়। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ায় ১৩-১৪ বছর বয়সি হলেও, তারা খুব নিয়ম মেনে, অনুশাসনের সাথে পেশাদার ট্রেনিং করে, যাতে কম বয়সেই বেশি সফল হতে পারে।''

সেকারণেই হয়তো এই বছর গ্রীষ্মে কলোম্বিয়াতে উত্তর কোরিয়ার অনূর্ধ্ব-২০ নারীরা আর্জেন্টিনাকে ৬-২ ও কোস্টারিকাকে ৯-০ গোলে হারিয়ে দেয়। তারপর যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে। পিয়ংইয়ং আন্তর্জাতিক ফুটবল স্কুলে অল্প বয়সেই মেয়েদের বাছাই করা হয়, তাদের কড়া প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই স্কুলের সাহায্যেই উত্তর কোরিয়ার জয়যাত্রা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

এই জয়ে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট ব্যবস্থাও লাভবান হচ্ছে। ড. জুং ভু লির মতে, ‘‘উত্তর কোরিয়া কিন্তু এখনও খুব কড়া একটি সোশালিস্ট ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থা মেনে চলে। বিশেষ করে কিম জং উনের অধীনে, তারা সবসময় ক্যাপিটালিস্ট ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে তুলনা করে চলে, যেখানে কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে দেখানো হয় উন্নততর হিসাবে। তাছাড়া, যখন আমি উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমে উত্তর কোরিয়া দলের খেলার খবর দেখি, তারা বারবার এটা বলে যে এমনটা হয়েছে কমিউনিস্ট ব্যবস্থার কারণে, কারণ শারীরিকভাবে পরিশ্রান্ত হলেও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।''

তিনি আরো যোগ করে বলেন, ‘‘তারা সরাসরি এই চিন্তাধারাকে ক্যাপিটালিস্ট দেশের সাথে তুলনা করে। ক্যাপিটালিজমের দুনিয়ায় অ্যাথলিটরা শারীরিকভাবে আহত হলে ও ক্লান্ত হলে পারফর্ম করার কোনো সুযোগ থাকে না। কোচের সাথে মিলে ঠিক করতে হয় নিজেকে। কিন্তু সোশালিস্ট ব্যবস্থায় কোনো কোচ বা মেডিকেল স্টাফের কথার তুলনায় তাদের চাওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই উত্তর কোরিয়া নিজেদের ব্যবস্থাকে উন্নততর বলে দাবি করে।''

এই চিন্তাধারা দলের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করলেও জয়ের পথে দৃঢ় থাকার জন্য আরেকটি বিষয় কাজ করে: বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তি। এবিষয়ে বুঝিয়ে বলেন ড. জুং ভু লি। তিনি বলেন, ‘‘যদিও উত্তর কোরিয়াকে আমরা বেশ অনুন্নত ও রীতিমত কৃষিপ্রধান দেশ বলেই চিনি, যেখানে মানুষ অনেক কষ্টে দিন কাটায়, রাজধানী পিয়ংইয়ং এর চিত্র কিন্তু আলাদা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।'' ভালো খেলার পুরস্কার হিসাবে অনেক সময় খেলোয়াড়দের দেয়া হয় ‘রেসিডেন্স সার্টিফিকেট' যা থাকলে রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে ঢুকতে পারবেন তারা। একই সাথে, খেলোয়াড়দের অ্যাপার্টমেন্টে বাসাও দেয়া হয়।

এমন পুরস্কার উত্তর কোরিয়ার বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ফেলনা নয়। দেশটির প্রান্তিক অঞ্চলে জীবন যেমন কঠিন, তেমনই খাবারের অভাব ও অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবাও রয়েছে। ফলে বড় শহরে জীবনের আকর্ষণ অনেকটাই। ড. লি বলেন, ‘‘জীবন বদলানোর এটা একটা উপায়। অনেকটা লটারি জেতার মতো।''

প্রতিভাবান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কেমন?

উত্তর কোরিয়ার ১৭ বছর বয়সি খেলোয়াড় চোয় ইল-সনসেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব জেতার পর প্রশ্ন ওঠে, কোন ক্লাবে খেলতে দেখা যাবে তাকে? কিন্তু অনেকেই ভুলে যান কোন বাস্তবতা থেকে খেলার মাঠে নামেন ইল-সন।

বিদেশের মাটিতে তার খেলার সম্ভাবনা বিষযে ড. লি বলেন, ‘‘আমার মতে তা একেবারে অসম্ভব না হলেও খুব একটা সহজও নয়। প্রথমত, উত্তর কোরিয়ার ওপর নানা ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাছাড়া, যখনই উত্তর কোরিয়ার কোনো খেলোয়াড় ইউরোপের কোনো লিগে খেলেছে, বাস্কেটবলে কিছু উদাহরণ আছে যখন তার প্রাপ্য টাকা খেলোয়াড়ের নিজস্ব অ্যাকাউন্টের বা এজেন্টের বদলে সরাসরি সরকারের অ্যাকাউন্টে যায়, ফলে সেই জটিলতাও রয়েছে।''