অনাবৃষ্টি-খরায় সঙ্কটে কৃষি
১৩ মার্চ ২০২৩, ১০:৩৫ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:১১ পিএম
মার্চ মাসের অর্ধেক শেষ হতে চলেছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি কেটেছে খরায়। এরপর চলতি মার্চ মাস মিলিয়ে অনাবৃষ্টি ও খরা টানা পাঁচ মাসে পড়েছে। ‘নেই’ হয়ে গেছে বৃষ্টি। চার মাসে আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে ‘বৃষ্টিপাত’ (?) সারা দেশে গড়ে মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশই ঘাটতি। গেল ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা ও রাজশাহীর কিছু জায়গায় হঠাৎ বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত গুঁড়ি গুঁড়ি ‘বৃষ্টি’ হয়েছে। রাজশাহীর একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ জানান, ‘এই গুঁড়ি বৃষ্টিতে টিনের চালাও ঠিকমতো ভিজেনি’। রাজশাহী অঞ্চল তথা বরেন্দ্র জনপদে শেষ বৃষ্টি হয় গতবছর সেপ্টেম্বরে। ক্রমেই মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চল। গত সোয়া একশ’ বছরে এ ধরনের অস্বাভাবিক খরা-অনাবৃষ্টি দেখা যায়নি। আগামীকাল বুধবার শুরু হচ্ছে খরতাপের দহনের চৈত্র মাস।
বৃষ্টির আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। চাতক পাখির মতো আকাশপানে বৃষ্টির আশায় তাকিয়ে আছেন কৃষক, গৃহস্থী, খামারী। কিন্তু কোথায় স্বস্তির বৃষ্টি। দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে তাপমাত্রা। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও পার্বত্য রাঙ্গামাটিতে তাপমাত্রা উঠে গেছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে! রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও কোথাও কোথাও ২০ থেকে ২৩ ডিগ্রি সে. ছাড়িয়ে গেছে! বিভিন্ন জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু তাপপ্রবাহ। খটখটে শুষ্ক রুক্ষ আবহাওয়ায়, অনাবৃষ্টি-খরায় বিপন্ন এবং পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে কৃষি-খামার, পরিবেশসহ গোটা প্রাণ-প্রকৃতি। মাটির নিচে পানির লেয়ার আরও নিচের দিকেই নামছে। নদ-নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, পুকুর-জলাশয়, ঝিরি-ঝরণাসহ পানির অধিকাংশ উৎস শুকিয়ে গেছে। সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের সমগ্র কৃষি খাত।
এদিকে আমেরিকান আবহাওয়া-জলবায়ু গবেষণা সংস্থা ‘নোয়া’র বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে সিএনএন সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘লা নিনো’ বিদায় নিচ্ছে। ‘এল নিনো’ অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে আবহাওয়া। এরফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও এর কাছাকাছি স্থলভাগের একটি উত্তপ্ত বলয় তৈরি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে আবহাওয়ায়। এতে খরা ও তাপদাহের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। গেল বছর ২০২২ সালে বিশে^ রেকর্ড ছাড়ানো তাপপ্রবাহের চেয়েও এবার বাড়তে পারে গরমের তীব্রতা। ‘এল নিনো’ অবস্থা সৃষ্টির কারণে এবারের গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ও তীব্রতর হতে পারে।
‘এল নিনো’ সামুদ্রিক ও ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়ায় প্রভাব ফেলে। এতে ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাত বাধাগ্রস্ত এবং খরা-অনাবৃষ্টির আবহ তৈরি হয়। বিশ^ আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) মহাসচিব পেটেরি তালাস বলেন, এখন আবহাওয়া ‘এল নিনো’ অবস্থার দিকে যাওয়ার মানে হচ্ছে বৈশি^ক তাপমাত্রা আরও চড়াও হওয়া। গতবছরের চেয়ে এবার সবচেয়ে তপ্ত হয়ে উঠতে পারে পৃথিবী। আবহাওয়ায় ‘লা নিনা’ কিংবা ‘এল নিনো’ অবস্থা তৈরি হয় স্বাভাবিক প্রকৃতিগতভাবেই। তবে মনুষ্যসৃষ্ট তাবৎ কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলো বেড়েই চলেছে। যার পরিণতিতে বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আবহাওয়া-জলবায়ু ক্রমাগত চরম-ভাবাপন্ন আচরণ করছে।
‘নোয়া’র পূর্বাভাস উল্লেখ করে সম্প্রতি ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানায়, এবার গ্রীষ্ম মৌসুম থেকেই খরা-অনাবৃষ্টি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হয়ে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বৃষ্টিবাহী মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ ব্যাহত হতে পারে কমবেশি। আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ অবস্থার প্রভাবে এখনই প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গরম বাতাসের একটি ‘উষ্ণ বলয়’ তৈরি হয়েছে। সাধারণত তিন থেকে ছয় বছর ব্যবধানে এ অবস্থা তৈরি হতে পারে।
কৃষি অর্থনীতিতে খরা-অনাবৃষ্টির ঝুঁকি ও প্রভাব প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘এল নিনো’র প্রভাবে খরা এসেছে। কৃষি অর্থনীতিতে কঠিন অবস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও সেচ ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হওয়ায় কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা হলে সেচ-নির্ভর বোরোধান ফলনেও বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। মাঘ মাসের শেষ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত হালকা ধরনের ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাতও হয়নি।
এতে কৃষি-খামারের ক্ষতি হচ্ছে। এবার রাজশাহী অঞ্চলে আমে ব্যাপক মুকুল এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি না হলে আম, লিচু, কাঁঠালসহ ফল-মূলের গাছে গাছে মুকুল ও ফুল খরতাপে শুকিয়ে ঝরে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব পড়ছে সমগ্র প্রাণ-প্রকৃতিতে। এবারের যে আগাম খরা পরিস্থিতি তা প্রতিবছরই হতে পারে। খরা-অনাবৃষ্টির ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের সেচ সুবিধাকে যুগোপযোগী আরও উন্নত করতে হবে।
একই প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মনজুরুল হুদা বলেন, আবহাওয়া প্রকৃতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কৃষকের দিশাহারা অবস্থা। বোরো ফসলের গোড়ায় পানি নেই। ঘন ঘন সেচ দিতে হচ্ছে। সেচ খরচ পুষিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার অনেক নিচে নেমে গেছে। নলকুপে পানি উঠছে না। পানির অভাবে মাছ চাষ সঙ্কটে পড়েছে। কৃষি খাত অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদেরকে সেচবিহীন কিংবা কম সেচ-নির্ভর ফসল আবাদের দিকে যেতে হবে। রাজশাহীতে নিজের ফল-ফসল চাষে দুর্ভোগের কথা জানিয়ে এই কৃষিবিদ বলেন, সেপ্টেম্বরে শেষ বৃষ্টিপাত হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। আমে এবার প্রচুর মুকুল এসেছে। তবে লিচু গাছে তেমন মুকুল নেই। পানির অভাবে আম, লিচু, পেয়ারা, কাঁঠালের ফুল ও মুকুল শুকিয়ে ঝরে যেতে পারে।
তাপদাহ-কালবৈশাখী-বজ্র ও শিলাবৃষ্টির ঘনঘটা : ‘লা নিনো’ বিদায়ের সাথে ‘এল নিনো’র প্রভাবে আবহাওয়া চরম-ভাবাপন্ন ও এলোমেলো আচরণ করছে। খরা-অনাবৃষ্টিকে করছে দীর্ঘস্থায়ী। আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ কমিটির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে ইতোমধ্যে জানা গেছে, বিগত ৪ মাসের মতো চলতি মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসেও দেশে বৃষ্টিপাত হতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এ মাসে দেশে ২ থেকে ৩ দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে।
মাসের শেষের দিকে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২ থেকে ৩টি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশিই থাকতে পারে। আগামী এপ্রিল মাসে (চৈত্র-বৈশাখ) দেশে বজ্রবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টিসহ একাধিক প্রবল কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। বয়ে যেতে পারে তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ। তীব্র তাপপ্রবাহে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সে. ছাড়াবে। এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি নিম্নচাপ সৃষ্টি এবং এরমধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, অস্থায়ীভাবে আকাশ আংশিক মেঘলাসহ সারা দেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেট জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় বৃষ্টি-বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে বিরাজ করছে।
বিভাগ : আজকের পত্রিকা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সচিবালয়ের গেটে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া-পুলিশের ফাঁকা গুলি
ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদ মারি লা পেনের মৃত্যু
দুদক কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার তিন ভুয়া কর্মকর্তা রিমান্ডে, হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা সোহাগ রিমান্ডে,
শিগগিরই চালের দাম কমে আসবে : বাণিজ্য উপদেষ্টা
কুরস্কে ২৪ ঘন্টায় ইউক্রেনের ৪৮৫ সেনা নিহত
পশ্চিম তীরে বন্দুক হামলায় ৩ ইসরাইলি নিহত
ঢাবিতে হাসিনার ‘ডামি নির্বাচন’ প্রদর্শনী
জুলাই গণহত্যা: হাসিনাসহ ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল
শিগগিরই চালের দাম কমে আসবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ সহযোগিতা দিচ্ছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল সোসাইটি
ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি যুদ্ধ নাকি বন্ধুত্বের পক্ষে
মিথ্যা ন্যারেটিভ ভেঙ্গে দেয়া আমাদের ইতিহাসের দায়বদ্ধতার অংশ
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
এক-পঞ্চমাংশ এইচ-১বি ভিসাই ভারতীয় সংস্থাগুলোর কাছে
গ্রীনল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন ট্রাম্প জুনিয়র
মক্কা-মদিনায় ভারী বৃষ্টিতে বন্যা
ভারতে চীনের পরিবর্তে বাড়ছে জাপানি বিনিয়োগ
পশ্চিম তীরে ৩ ইসরাইলি নিহত
যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা একীভূত করার প্রস্তাব ট্রাম্পের
অস্ট্রিয়ায় সরকার গঠন করছেন অতি ডানপন্থি নেতা কিকল