সাইবার অপরাধের মাত্রা বাড়ছে
১৩ মার্চ ২০২৩, ০৭:৪৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৩৫ এএম
তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জীবন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর। এই প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনে অনেকাংশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার অপরাধ। দিন দিন বেড়েই চলছে এ অপরাধ। যেন কোনভাবেই এর প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সাইবার অপরাধ হলো মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক একটি অপরাধ। এই অপরাধের কারণে সমাজের নারীপুরুষ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে পরিলক্ষিত হয়েছে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হয়েছে। সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের জেন্ডারভিত্তিক পার্থক্য করলে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্য পুরুষের সংখ্যা ৪৩.২২ শতাংশ এবং নারীদের সংখ্যা ৫৬.৭৮ শতাংশ। এছাড়াও পুরুষের তুলনায় নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হয়েছে। অন্যদিকে নারীদের তুলনায় পুরুষরা মোবাইল ব্যাংকিং/এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ের শিকার বেশি হয়েছে এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছে।
দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশই নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি। ক্রমেই এই ধরনের অপরাধ বাড়ছে। এবারের জরিপে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী কিছুটা বেড়ে ৫০.২৭ শতাংশ হয়েছে, যা গতবারের প্রতিবেদনে ছিল ৫০.১৬ শতাংশ।
এবার দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন একাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যাবহার করে অপপ্রচার চালানো এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন একাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩.৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৮.৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় ৪.৫২ শতাংশ বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬.৩১ শতাংশ। এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮.৬৭ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় ২.৩৬ শতাংশ বেশি। এছাড়াও যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ গতবার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল। সেটা এবার বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা গতবারের প্রতিবেদনে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেলেও এবার তা ১ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড় গিয়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রপ্রচার বাড়ছে। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর, এই হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। হয়রানির শিকারের পর ভুক্তভোগীদের ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশই আইনের আশ্রয় নেয় না। এ ছাড়া আইনের আশ্রয় নেওয়া ভুক্তভোগীদের মাত্র ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ আইনি সেবার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, লোকলজ্জার ভয়সহ বিভিন্ন কারণে অপরাধের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা কোথাও অভিযোগ করেন না। সার্বিক পরিস্থিতিতে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ আটটি সুপারিশ তুলে ধরা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে। আমাদের দেশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি সাইবার হামলার শিকার বলেই বলা হচ্ছে, ব্যাংক খাতগুলোকে আইটি খাতে বেশি বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে, সাইবার নিরাপত্তার পেছন বিনিয়োগ জোরদার করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো অন্যান্য দেশের ব্যাংকের তুলনায় ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু আমাদের ব্যাংকগুলো তাদের নতুন নতুন ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি ঘটাতে একান্ত বাধ্য হয়েই আইটি খাতে বিনিয়োগ করছে। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এ বিনিয়োগের গতি আরো বাড়াতে হবে। ব্যাংকারেরা প্রায়ই অভিযোগ করে, তারা এ খাতে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তা খুঁজে পায় না। উদ্যোক্তারা বরং উল্টো বলে, এ খাতে বিনিয়োগ করে কী লাভ? আমরা নিজেরাই তো ব্যাংকে গেলে ঋণ পাই না। ব্যাংকারেরা ঋণ দেয় চালু ব্যবসায়গুলোতে।
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির আগের বছরগুলোর এবং পরের বছরের গবেষণা প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ সংঘটিত অপরাধগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য হারে বিগত চার বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রপ্রচার কমলেও গত বছর এই ধরনের অপরাধের প্রবণতা আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ফটোশপে ছবি বিকৃতির ঘটনাও নতুন করে বাড়ছে। সবচেয়ে শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে অনলাইন কেনাকাটায়। ই-কমার্স খাতে চার বছরে ধারাবাহিক অপরাধ বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
১৮-৩০ বছর এবং ১৮ এর চেয়ে কম বয়সের ভুক্তভোগীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাকিং বা তথ্য চুরির মতো সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে বেশি। আরেকটি আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগীদের বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় ৪.৬৪ শতাংশ বেশি এসেছে এবারের জরিপে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানে ৪৩.২২ শতাংশ। বাকি ৫৬.৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর দেশে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ভুক্তভোগীদের মধ্যে গত বছরের তুলনায় এই বছর ২১.০৭ শতাংশ কম ভুক্তভোগী তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানে।
পরিসংখ্যানে এও লক্ষণীয় যে, পুরুষ অভিযোগকারীদের তুলনাই নারী অভিযোগকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। নারী ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ১১.০৬ শতাংশ সমস্যা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছেন এবং ৪৫.৭৩ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে মাত্র ৭.০৪ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়ে আশানুরূপ ফল পেয়েছে এবং ৫৫.২৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পায়নি।
অভিযোগের পর প্রত্যাশিত ফল পাওয়ায় পুরুষ এবং নারীভেদে ভিন্নতা রয়েছে। অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে পুরুষের সংখ্যা ৮ জন বা ৪.০২ শতাংশ, সেখানে নারীর সংখ্যা মাত্র ৬ জন বা ৩.০২শতাংশ। অন্যদিকে, আশানুরূপ ফল না পাওয়া নারীদের সংখ্যা ২৮.৬৪ শতাংশ, যেদিকে পুরুষের সংখ্যা ২৬.৬৩ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল পেয়েছে মোট ভুক্তভোগীর ২২.২২ শতাংশ, যা ২০২২ সালের পরিসংখ্যানের তুলনায় ১৫.১৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, এবারের প্রতিবেদনে প্রত্যাশিত ফল পাওয়ার পরিমাণ অনেকাংশে কমে গেছে। প্রাপ্ত উপাত্তগুলোকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণের মধ্যে ভিন্নতা দেখা গেছে। বিষয়টিকে গোপন রাখতে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ ভুক্তভোগী। এছাড়া ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী সামাজিক ভাবমর্যাদা রক্ষার জন্য, ১৭ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানি পোহাতে হবে, ১৭ শতাংশ অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না ভেবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী। অন্যদিকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন আছে তা মনেই করেননি।
ব্যাপকভাবে সাইবার সচেতনতামূলক কার্যক্রম, জাতীয় বাজেটে সাইবার সচেতনতায় গুরুত্ব দেওয়া, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআরে সাইবার সচেতনতা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইবার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা, সাইবার স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি, সচেতনতামূলক কাজে রাজনৈতিক জনশক্তির সঠিক ব্যবহার, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও অংশীজনদের সম্মলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সাইবার অপরাধ একটি দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সাইবার অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকারকে আরও উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও আরও সচেতন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার যখন আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় তখন এই ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি জানতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিভাগ : আজকের পত্রিকা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫ শিশুসহ ৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত
প্রত্যর্পণের চাপের মধ্যেই হাসিনার ভিসার মেয়াদ বাড়াল ভারত
বগুড়ার টপ টেরর যুবলীগ নেতা আলহাজ শেখ গ্রেপ্তার
ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে লস অ্যাঞ্জেলেস
সাতক্ষীরায় অপহৃত তরুণী উদ্ধার, যুবদল নেতাসহ গ্রেপ্তার দুই
পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ইইউর সহায়তা চাইলেন- পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিদেশ সফর, দেশবাসীর নিকট দোয়া চাইলেন কায়কোবাদ
লক্ষ্মীপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করা সেই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার
লক্ষ্মীপুরে বেড়েছে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া হাসপাতালের ফ্লোরে ও বারান্দায় ঠাঁই হচ্ছে রোগীদের
সাতসকালেই ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু নিয়ে দূষণের শীর্ষে ঢাকা
সচিবালয়ের গেটে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া-পুলিশের ফাঁকা গুলি
ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদ মারি লা পেনের মৃত্যু
দুদক কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার তিন ভুয়া কর্মকর্তা রিমান্ডে, হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা সোহাগ রিমান্ডে,
শিগগিরই চালের দাম কমে আসবে : বাণিজ্য উপদেষ্টা
কুরস্কে ২৪ ঘন্টায় ইউক্রেনের ৪৮৫ সেনা নিহত
পশ্চিম তীরে বন্দুক হামলায় ৩ ইসরাইলি নিহত
ঢাবিতে হাসিনার ‘ডামি নির্বাচন’ প্রদর্শনী
জুলাই গণহত্যা: হাসিনাসহ ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল
শিগগিরই চালের দাম কমে আসবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ সহযোগিতা দিচ্ছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল সোসাইটি