উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করা অন্যায় চিকিৎসক সমাজ
২৭ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:৪৫ পিএম
সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকদের এফআরসিএস, এমআরসিপি ও এমআরসিএসসহ অন্যান্য কোর্সের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বিদেশ ভ্রমণের জন্য আবেদন না করার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্তের কারণে অদৃশ্য ক্ষোভে ফুঁসছে দেশের চিকিৎসক সমাজ। দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক এমনকি চিকিৎসক নেতারাও এমন সিদ্ধান্তে সমালোচনামুখর। তারা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত উচ্চশিক্ষার রুদ্ধ করেছে, এর মাধ্যমে চিকিৎসকদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।
গত মার্চ মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ ভ্রমণের জন্য আবেদন না করার নির্দেশনা দেওয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। নির্দেশনায় বলা হয়, বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সরকারি চিকিৎসকরা এফআরসিএস, এমআরসিপি ও এমআরসিএসসহ অন্যান্য কোর্সের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বিদেশ ভ্রমণের জন্য আবেদন করেছেন কিন্তু অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী এ ধরনের আবেদন অনুমোদনের সুযোগ নেই।
মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অর্থ বিভাগ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এফআরসিএস, এমআরসিপি ও এমআরসিএসসহ অন্যান্য কোর্সের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে অগ্রায়ন না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহেদ রাফি পাভেল বলেন, বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে যখন একজন চিকিৎসক দেশে ফিরে আসবেন তখন দেশের জনগণই সুফল ভোগ করবে। বিডিএফ মনে করে, তাদের এই উচ্চতর ডিগ্রির পথ রুদ্ধ করা কোনোক্রমেই ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এর মাধ্যমে চিকিৎসকদের প্রতি খুবই অন্যায় করা হয়েছে। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাব যে, এই প্রজ্ঞাপন যেন অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, রয়েল কলেজ থেকে ডিগ্রি নিতে বাংলাদেশ থেকে যে চিকিৎসকরা যায়, এরা সবাই নিজ অর্থায়নে পড়াশোনা করে। তারা কিন্তু সরকারি অর্থায়নে পড়াশোনা করে না। রয়েল কলেজের যে ডিগ্রি, সেটি সারা বিশ্বেই অ্যাক্রেডেট। অর্থাৎ আপনি যে দেশেই যান না কেন, এই ডিগ্রির একটা ভ্যালু আছে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই তো আমাদের চিকিৎসকরা চাইবে আন্তর্জাতিক মানের একটা ডিগ্রি অর্জন করতে। এটাতে আমাদের কেন বাধা দিতে হবে? এতে করে তো তাদের স্কিলড (দক্ষতা) অর্জন হবে।
বিডিএফ চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ভাবতে হবে যে, শতকরা কত শতাংশ চিকিৎসক রয়েল কলেজে ডিগ্রির জন্য যেতে পারে? এছাড়া এখানে কোয়ালিটিরও একটা ব্যাপার আছে। যেকোনো চিকিৎসক চাইলেই তো রয়েল কলেজে ডিগ্রি নিতে যেতে পারবে না। এক্ষেত্রে যেসব চিকিৎসক নিজ যোগ্যতা বলে এই প্রতিষ্ঠানটিতে ডিগ্রি নিতে যায়, সেই সংখ্যাটি তো অনেক কম। তাহলে এই কয়জন মেধাবী ছেলেকে কেন আটকাবেন?
অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যেখানে সরকারি অর্থায়নেই নিয়মিত বিদেশ সফর করছেন, সেখানে চিকিৎসকদের কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. পাভেল বলেন, এটার পেছনের কারণ যাই হোক না কেন, আমাদের তো মানতে হবে যে, একজন চিকিৎসক পড়াশোনা করবে, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করবে, এটা তার মৌলিক অধিকার। তার যতটুকু পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে, তাকে করতে দিতে হবে। যদিও সে সরকারি চাকরিতে আছে কিন্তু সে তো তার নিজের টাকা খরচ করেই ডিগ্রিটা করতে যাচ্ছে। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য তো সরকারি চাকরিজীবীদের ছুটির বিধান আছে। এর বাইরেও যদি কোনো চিকিৎসকের অতিরিক্ত ছুটির প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রেও সরকারের নিয়ম আছে। কোনোভাবেই তার পথ রুদ্ধ করার কোনো নিয়ম মন্ত্রণালয়ের নেই।
নির্দেশনা প্রত্যাহার করা না হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে বিডিএফ চেয়ারম্যান বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি চিকিৎসকদের স্বার্থক্ষুণ্ন করে তাহলে হয়ত আমাদেরকে আইনগতভাবে প্রতিহত করতে হবে। আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে আমরা বিষয়টি নিয়ে বসব। চিকিৎসকদের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রয়োজনে আমরা প্রচলিত আইনের দারস্থ হব।
চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেস্পন্সিবিলিটিজের (এফডিএসআর) উপদেষ্টা ও চিকিৎসক নেতা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, সরকারিভাবে আমাদের চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক আসন নেই। এমনকি যথেষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই। প্রতি বছর আমাদের ১০ হাজারেরও বেশি চিকিৎসক বের হয়, এই ডাক্তাররা যদি উচ্চশিক্ষা নিতে চায়, তাহলে তারা কোথায় নেবে?
তিনি বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসকদের পদোন্নতিতে উচ্চশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাধ্যবাধকতা যদি থাকে, তাহলে তো চিকিৎসকদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করে দেওয়া সরকারের কর্তব্য। কিন্তু এটি সরকার করতে পারছে না। যে কারণে অনেক চিকিৎসক দেশের বাইরে চলে যায় অথবা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেয়।
ডা. তুষার বলেন, আমি তো মনে করি কেউ যদি নিজ খরচে গিয়ে বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসে, এটি বরং রাষ্ট্রের উপকার। আমাদের রোগীরা এমনকি সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যায়। তার মানে হলো, তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ডাক্তারদের কাছেই চলে যান। এমনকি তারা প্রতি বছর রোগী হিসেবে গিয়ে হাজার হাজার ডলার দেশের বাইরে রেখে আসছে। আমরা যদি এই অবস্থাটা বন্ধ করতে চাই, বাংলাদেশের ডাক্তারদের বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে আসাটা জরুরি।
চিকিৎসক নেতা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, এফআরসিপি, এমআরসিএস, এমআরসিপিসহ বিভিন্ন বিদেশি ডিগ্রিগুলো যারা করতে চায়, তাদের বাংলাদেশে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বাধ্য হয়েই তাদের বিদেশে যেতে হয়। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশে কিন্তু চিকিৎসকরা এই পরীক্ষাগুলো দিতে পারে, আমাদের দেশে এই ব্যবস্থাটা নেই। বাংলাদেশ থেকে যারাই পরীক্ষার জন্য বিদেশ যায় তারা কিন্তু সম্পূর্ণ নিজ খরচেই যাচ্ছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার পরীক্ষা দিতে চিকিৎসকরা যখন নিজের অর্জিত ছুটিগুলো চাইছে, সরকার সেটা দিতে চাইছে না। এখানে তো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো ডলার খরচ হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এখন সরকারি কর্মকর্তারা পুকুর কাটা শিখতে বিদেশ যায়, লিফট দেখতে বিদেশ যায়, মাছের চাষ দেখতে বিদেশ যায়, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ যায়। এমনকি আমাদের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় চিকিৎসা করাতে যায়। কিন্তু ডাক্তারদের বেলায় দেখা যায় যত বজ্র আঁটুনি। এখন আমরা যদি চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করি, এতে ক্ষতিটা কার হবে? জনগণের হবে আর সরকারের হবে।
দেশের স্বনামধন্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করাটা অন্যায়। আমি মনে করি, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং তাদের স্বাগত জানানো উচিত। আমাদের চিকিৎসকরা নিজের পয়সায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে, বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে দেশে আসবে, এটা আমাদের জন্য খুবই মঙ্গলের হতো। কিন্তু তা না করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। এর কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না।
তিনি বলেন, কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অনেক চিকিৎসক ডিগ্রি নিয়ে আর দেশে আসতে চান না। আমি মনে করি, তাদের মধ্যে কেউ যদি দেশের বাইরে থেকেও যায়, এতেও তো আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। এই অজুহাতে তাদের আটকানোর কোনো যুক্তিই আমি দেখি না। এতে করে তো সরকারের কোনো পয়সা নষ্ট হচ্ছে না। দেশের জনগণেরও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, আমি সবসময়ই চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের পক্ষে। চিকিৎসকদের আরও সুযোগ করে দেওয়া উচিত, যাতে তারা নিজেদের অভিজ্ঞ, দক্ষ ও পারদর্শী করে গড়ে তুলতে পারেন। ভালো বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি হয়ে দেশে এসে মানুষকে বিশেষায়িত সেবা দিতে পারেন। আমি মনে করি, এটা খুবই ইতিবাচক।
দেশের প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যারা এই পথটি রুদ্ধ করেছে, এটি অন্যায় করেছে। আমি চাই জরুরি ভিত্তিতে যেন এই নিষেধাজ্ঞাটি বাতিল করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, সুযোগ পেলে আবারও কথা বলব। আমি যতটুকু জানি, বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে, হয়ত খুব শিগগিরই নতুন কোনো নির্দেশনা আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তটি সাময়িক একটি সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে মূলত বৈশ্বিক সঙ্কট বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এছাড়াও এর আগে অসংখ্য চিকিৎসক উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে আর দেশে ফিরে আসেনি। এ বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য সচিবের সমন্বয়ে এক মিটিংয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে চিকিৎসকদের চাহিদা বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত আবার পরিবর্তনও হতে পারে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়
ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান