ব্যক্তিগত গাড়িতে সর্বনাশ
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৬ পিএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
রাজধানীতে দিন দিন বেড়েই চলেছে যানজট। এই যানজট বাড়ানোর পেছলে ভূমিকা রয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির। এসব ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে অফিসপাড়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কে বেশি যানজট সৃষ্টি করছে। এতে বিপাকে পড়েছেন রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন। রাজধানীর বহু এলাকায় যত্রতত্র ও এলোপাতারি গাড়ি পার্কিং চলছে। মতিঝিলের অফিসপাড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপরই রাখা হয় সারি সারি গাড়ি। বাণিজ্যিক এলাকা ও বাস টার্মিনালগুলোর আশপাশের সড়কজুড়েই দেখা যায় বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজি অটোরিকশার অবৈধ পার্কিং। ফলে দিনের বড় অংশজুড়ে এসব সড়ক ও এলাকায় তীব্র যানজট থাকে। এতে বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি।
মূল্যবান ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় গিলে খাচ্ছে প্রাইভেটকারের কারণে সৃষ্ট যানজট। রাজধানীতে কোনো গন্তব্যে যেতে দ্বিগুণ আবার কোনো ক্ষেত্রে তিন থেকে চারগুণ সময় বেশি লাগছে। আর এ জন্য ব্যক্তিগত গাড়িকেই দায়ী করছেন নগরবাসী। দীর্ঘ সময় থমকে থাকা, আবার কখনও ধীরগতি। রাজধানীর রাজপথের নিত্যদিনের চিত্র এমন। তবে যানজটে গণপরিবহনের মধ্য দিয়ে নজরকাড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি। রাস্তায় এত ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ার পেছনে অনুন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন নগর পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। ব্যক্তিগত গাড়ি সড়কে জায়গা দখল করে বেশি, যাত্রী পরিবহন করে খুবই কম। নগর এলাকায় টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা ও পথচারী ও সাইকেলবান্ধব শহর গড়ে তোলার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
নগরবাসী বলছেন, সড়কে এত প্রাইভেটকার। একটি প্রাইভেটকার শুধু একজনকে বহন করছে। কিন্তু গণপরিবহন তো অনেক যাত্রী বহন করতে পারে। আর তাই, প্রাইভেটকারের কারণে যানজটটা বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার প্রাইভেটকারের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তাতেই গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। একারণে রাস্তায় যানজট বেড়ে যায়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) তথ্য মতে, ঢাকার পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থায় উদ্বেগজনক হারে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, ঠিক তেমনি নগর এলাকায় পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থায় গণ পরিবহন ব্যবহারকারী ও পথচারীদের যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। টেকসই পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নগর এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করবার প্রয়াস সারা বিশ্বজুড়ে বেগবান হলেও বাংলাদেশে এই প্রয়াস সীমিত।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে বরং সাইকেল, হাঁটা বা গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে প্রতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে দিনটি উদযাপন করা হচ্ছে। তবে ২০১৬ সাল থেকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে এটি পালন শুরু হয়, যেখানে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) মুখ্য সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে এসেছে। বিশ্বের অন্যতম যানজটপ্রবণ ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকারিভাবে এই দিবসটি পালনের তেমন কোন উদ্যোগ এই বছর নেয়া হয়নি। বাংলাদেশে এই দিবসটি পালনের প্রায় দেড় যুগ পার হতে চললেও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ও ফলপ্রসূ পরিকল্পনা ও নীতির বাস্তবায়ন এখনো দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের ঢাকা শহর কি পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি ধারণ করতে পারবে, সেই বিষয়ে বিআরটিএ, ডিটিসিএ, ট্রাফিক বিভাগ, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের তেমন কোন বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা নেই। ঢাকা শহরে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন দিয়ে চলছে বিআরটিএ। নগর পরিকল্পনা ও পরিবহন পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় নেই, কর্তৃপক্ষসমূহের মধ্যে ও নেই কার্যক্রমের সমন্বয়। ফলে নগরে গাড়ির চাপ বাড়ছে, মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে যানজট। এমনকি উড়ালসড়কেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তাদের জন্য বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয় ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনুরূপভাবে কার লোনসহ বেসরকারি পর্যায়েও ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয়ে বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা শহরে লক্কর ঝক্কর বাস আর গণপরিবহনের জন্য ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের দুঃখকষ্টকে ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়া নীতিনির্ধারকগিণ উপলব্ধিই করতে পারেন না।
আইপিডি দাবি করছে, প্রতি মাসের প্রথম রোববার সকল ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ করবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে মন্ত্রী-আমলাসহ নীতিনির্ধারকদের গণপরিবহন ব্যবহার ও পায়ে হেঁটে চলবার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষেরা যে ধরনের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন, তা উপলব্ধি করবার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। এর ফলে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নগরের যানজট কমানোর সম্ভাবনা অনুধাবন করা সম্ভব হবে। নগর এলাকায় কার ফ্রি স্ট্রীট, কার ফ্রি স্কুল জোন, পার্কিং নীতিমালা, মানসম্মত বাস সার্ভিস, স্কুল বাস সহ বিশেষায়িত বাস সার্ভিস, মানসম্মত ফুটপাথ তৈরি প্রভৃতি পরিকল্পনা কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর মাধ্যমে টেকসই পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
আইপিডি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, মানসম্মত গণপরিবহন এর অভাবে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ায় এর সংখ্যা, ব্যবহার, ও যানজট বেড়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ এবং টেকসই পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নগর এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করবার পর্যায়ক্রমিক উদ্যোগ গ্রহণ এবং পথচারীবান্ধব নগর গড়বার জন্য ফুটপাথ নির্মাণ ও হাঁটার উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বাপার যুগ্ম সম্পাদক হুমায়ুন কবীর সুমন বলেন, বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে বিশ^ ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উদযাপন করা হলেও নীতি নির্ধারনী মহল থেকে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ বলেন, নীতিনির্ধারকদের দৈনন্দিন কার্যক্রম এবং প্রকল্প গাড়ি-কেন্দ্রিক হওয়ায় হাঁটা, সাইকেল ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের উন্নতির প্রতি তাদের উদাসীনতা রয়েছে। এলাকার অভ্যন্তরে পথচারীদের নিরাপত্তা বাড়াতে ব্যক্তিগত যানবাহনের গতি সীমিত করা এবং বেসরকারি ও সরকারি বিভিন্ন ধরণের সংস্থা তাদের কর্মীদের ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য যে সকল প্রণোদনা প্রদান করে, তা সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন।
বুয়েট-এর নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ এর সহযোগী অধ্যাপক সাদিয়া আফরোজ বলেন, হাঁটা, সাইকেলবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। এক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় বুয়েট সহযোগিতা প্রদান করবে। সেই সাথে শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ যাতায়াত পরিবেশ নিশ্চিতে নগর এলাকায় পরিকল্পনা মাফিক কার ফ্রি স্কুল জোন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, উন্নয়ন হতে হবে সাধারণ মানুষের জন্য। ফলে পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে গাড়িমুক্ত রাস্তা তৈরি করা, শহরের বিভিন্ন রুটের জন্য বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের সেবা ও পরিধি বৃদ্ধি, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পসমূহে বিনিয়োগ কমিয়ে গণপরিবহন তথা বাস, রেল ও নৌপথে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গবেষণা, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
খুলনায় জাতীয় পার্টির অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন
'বিশ্ব মঞ্চে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করছেন আনিকা আলম, প্রার্থনা করেছেন ভোট'
ধামরাইয়ে পুলিশ ক্যাম্পে ঝুলছে তালা
রাজশাহীতে ট্রেনের ধাক্কায় পিকআপ দুমড়ে মুচড়ে আহত-৫
কুষ্টিয়া র্যাবের অভিযানে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেফতার
মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল গাজা, ইউক্রেন ও সুদান যুদ্ধ প্রভাবিত করবে?
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট
নাজমা মোবারেক ইতিহাসে প্রথম নারী সচিব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে
ফুলপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আ'লীগ নেতা শশধর সেন গ্রেফতার
আখাউড়ায় সংঘর্ষে আহত নয়জন, পাল্টাপাল্টি মামলা
ভারতে হলে কিভাবে নির্বাচনী প্রচার চালাতেন ট্রাম্প-কমলা
রংপুরে হত্যা মামলায় ২ জনের মৃত্যু দন্ড, ১ জনের যাবজ্জীবন
ইবিতে ছাত্র আন্দোলন দমাতে আওয়ামীপন্থীদের যত তৎপরতা
পঞ্চগড়ে ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে শিক্ষক আটক
লাইসেন্স ফি কমানোর দাবিতে ফরিদপুরে অটো চালকদের বিক্ষোভ-মানববন্ধন
আটঘরিয়ার হস্তালিত তাঁতের তৈরি চাচকিয়ার লুঙ্গি এখন একটি ব্রান্ড
রংপুর মেডিকেল নতুন অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবিতে কর্মবিরতি
পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পেল দেশের আরেকটি প্রতিষ্ঠান
শ্যামপুরে গ্যাস লিকেজে বিস্ফোরণ : দগ্ধ একজনের মৃত্যু
টিউবওয়েলের পানিতে চেতনানাশক মিশিয়ে চুরি