ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
কতিপয় দায়িত্বশীলদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ

জাটকা আহরন পরিবহন বিপনন নিষিদ্ধকালীন সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে আইন ভঙ্গের প্রতিযোগীতা

Daily Inqilab নাছিম উল আলম

১৫ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:৫২ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৫ পিএম

আহরন পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকলেও বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক জাটকার চালান যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশ পোনা জাটকা আহরন,পরিবহন ও বিপনন বন্ধ হচ্ছে না। আর এ কর্মকান্ডের সাথে কতিপয় জেলে, মৎস্যজীবী, মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সহ একটি বিশেষায়িত আধা সামরিক বাহিনীর কোন কোন কর্মীর উদাশীনতা সহ সংশ্লিষ্টাতারও অভিযোগ উঠে আসছে। তবে মৎস্য অধিদপ্তর সরাসরি এসব অভিযোগ অস্বিকার করে আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় নিয়মিত অভিযান ছাড়াও ভ্রম্যমান আদালত পরিচালনার কথাও বলছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৫.৬৫ লাখ টন ইলিশের ৭০ ভাগের উৎপাদন ও সহনীয় আহরন ছিল দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও সাগর মোহনায়। চলতি অর্থ বছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরন আরো বৃদ্ধির আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর। এমনকি নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর গবেষকগন আগামী অর্থ বছরের মধ্যে ৬ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন ও আহরন লক্ষ্য অর্জন কঠিন নয় বলে জানিয়ে এলক্ষে জাটকার অবৈধ আহরন বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন।
গত ১ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ইলিশ পোনা জাটকা আহরন,পরিবহন ও বিপনন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। এমনকি এ আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে জাটকা আহরনে নির্ভরশীল জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষে মাসে ৪০ কেজি করে ৪ মাসের জন্য দেশের ২০টি জেলার ৯৭ উপজেলার ৩ লাখ ৬১ হাজার জেলে পরিবারের জন্য ৫৭ হাজার ৭৩৯ টন চাল বরাদ্ব ও বিতরন করছে সরকার। যারমধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার ২ লাখ ৩০ হাজার ১৮৭ জেলে পরিবারের জন্য ৩৬ হাজার ৮২৯ টন চাল বিতরন চলছে।
কিন্তু এর পরেও জাটকা আহরন,পরিবহন ও বিপননের মত আত্মঘাতি কর্মকান্ড থেমে নেই। এমনকি যারা সরকারী খাদ্য সহায়তা গ্রহন করছে, সেসব জেলেরাও এখন জাটকা আহরনে সম্পৃক্ত বলে প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। যদিও বরিশালের হিজলা সহ কয়েকটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগন বিষয়টিকে গুরুত্বে সাথে বিবচনায় নিয়ে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রনয়নে একমত পোষন করেছেন। এমনকি অতি সম্প্রতি বরিশালে হিজলা-মেহেদিগঞ্জ এলাকার কয়েকটি নদীতে অবৈধ জাটকা আহরন বন্ধে অভিযানকালে স্থানীয় প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা হামলার শিকারও হয়েছেন।
কিন্তু এরপরেও জাটকা আহরন বন্ধ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় মাছ ব্যবসায়ী, প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরক্ষো মদতে জাটকা শিকার ও পাচার চলছে। জাটকা শিকার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির কাজীর হাট থানার নেতা মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কাছেও লিখিত অভিযোগে জড়িতদের নাম ঠিকানা উল্লেখ করে তিনবার আবেদন করেছেন। তবে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেও জানান হয়েছে। এমনকি প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ মন জাটকা জেলেদের কাছ থেকে কিনে তা বরিশালের তালতলী বাজার হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় প্রভাবশালী ব্যাবসায়ী দাদন বা আগাম অর্থ দিয়ে জেলেদের কাছ থেকে জাটকা কিনে বরিশাল মহানগরী সংলগ্ন তালতলী বাজার এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে এসব জাটকা ফরিদপুরের ভাঙ্গা বাজার হয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, কাওরান বাজার ও উত্তরা আব্দুল্লাহপুর এলাকায় পৌছে যায় সড়ক পথে। এছাড়া বরিশালেরই উলানিয়া উত্তর ও দক্ষিন ইউপির দায়িত্বশীলদের নেতৃত্বে প্রতিদিন উলানিয়া বাজার, গজারিয়া খালের মাথা, ঘোলপাড় খালের মাথা, চিকন খাল, ধোনের মুখ খাল, লালগঞ্জ বাজারের খালের মুখে জাটকা ও চাপলীর বাজার বসে। এখান থেকেও মাছ কিনে তালতলী বাজার হয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করা হচ্ছে।
এছাড়া ভোলার বাজার ও মোকামের বাইরে গড়ে তোলা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক মোকামগুলো থেকে নৌপথে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জাটকার চালান যাচ্ছে। তবে মাঝে মধ্যে অবৈধ জাটকার চালন আটকও হচ্ছে। সর্বশেষ ভোলার একটি লঞ্চ থেকে বিপুল জাটকা আটক করে স্থাণীয় লিল্লাহ বোর্ডিং-এর বিতরন করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে শণিবার মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালকের সেল ফোনে কথা বলা হলে তিনি জানান, আরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি জাটকা আহরন বন্ধে। সিমিত জনবল সহ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মৎস্য অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসন ও আইনÑশৃংখলা বাহিনীকে নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
তবে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, জাটকা সংরক্ষনের অংশ হিসেবে গত নভেম্বর থেকে ‘ বিশেষ কম্বিং অপারেশন’ চলছে। গত ৫ মাসে ৩ হাজার ২২৬টি অভিযান ছাড়াও প্রায় ১ হাজার মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে সাড়ে ৫ কোটি মিটার কারেন্ট জাল এবং ৭ সহশ্রধিক ক্ষতিকর বেহুন্দি জাল ছাড়াও ১২ হাজার ৪৭টি বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর জাল বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসময় জাটকা সহ প্রায় ৬২ টন বিভিন্ন ধরনের মাছ আটক করে এতিমখানা ও লিল্লøাহ বোর্ডিং-এ বিতরন করা হয়েছে। এসব অভিযানকালে আইন ভংগকারীদের বিরুদ্ধে ৪৫১টি মামলা দায়ের ছাড়াও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে প্রায় ১৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং প্রায় ৭০ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে। অভিযানকালে বাজেয়াপ্তকৃত নৌকা সহ অন্যান্য মালামাল নিলামে বিক্রী করে সরকারের প্রায় ১০ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে বলেও মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ইলিশ পোনা জাটকা আহরন, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধকালীন সময়ের মধ্যে দেশের ৬টি গুরুত্বপূর্ণ পরিভ্রমন এলাকা বা নার্সারি ক্ষেত্র চিঞ্হিত করা হয়েছে। ইলিশের বিচরন নির্বিঘœ করতে নভেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে দু মাস করে নার্সারী ক্ষেত্রকে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষনা করে সেসব এলাকায় সব ধরনের মৎস্য আহরন, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত ১ মার্চ থেকে বরিশালে দেশের ৬ষ্ঠ মৎস্য অভয়াশ্রম, হিজলা ও মেহদিগঞ্জের লতা, নয়া ভাঙ্গনী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় আগামী ৩০ এপ্রিল মধ্যরাত অবধি সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় ইলিশ পোনাÑজাটকা খাদ্য গ্রহন করে বেড়ে ওঠে, সেগুলোই ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। এরমধ্যে ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুুলিয়া নদীর ১শ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে ভোলার চর ইলিশা হয়ে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, শরিয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জের নিম্ন পদ্মার ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোট ৬টি অভয়াশ্রমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সব ধরনের মাছ আহরন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করায় ইলিশ সহ অন্যান্য মাছেরও উৎপাদন বাড়ছে।
কিন্তু জাটকা আহরন বন্ধের সাথে তার পরিবহন ও বিপনন আটকাতে না পাড়লে গত দুই দশকে ইলিশ নিয়ে যে অর্জন ও সাফল্য এসেছে, তা অব্যাহত রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মৎস্য বিজ্ঞানী সহ মৎস্যজীবীগনও।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা