ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১
নজরুলের স্মৃতি বিজরিত বরিশালে গত কয়েক বছরে প্রকৃতিকে ধরে রাখার পরিবর্তে ধ্বংস করা হয়েছে

জাতীয় কবির নামে নগরীতে সড়কের নামকরনের দাবী

Daily Inqilab নাছিম উল আলম

২৪ মে ২০২৩, ০৩:৩৬ পিএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২৩, ০৩:৩৬ পিএম

কবি নজরুলের দেখা বাংলার ভেনিস বরিশাল থেকে অনেক আগেই খাল-নালা বিলুপ্ত হবার পরে সবুজায়ন ধ্বংশ করা হলেও প্রকৃতির কিছু অপরূপ রূপ এখনো সবার চোখ জুড়ায়।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বার্ষিকীতে তার স্মৃতি বিজরিত বরিশালে এবারো তেমন কোন কর্মসূচী নেই। শুধুমাত্র নজরুল স্মৃতি সংসদ জাতীয় কবির জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে যেনতেনভাবে এনগরীতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকে। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এমনকি এ মহাগরীতে কবির দেখা ও লেখার স্মৃতিগুলোর অস্তিতও¡ ইতোমধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হলেও তা নিয়ে কোন আরোচনা বা দাবী নেই। জাতীয় কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে এ নগরীতে তার নামে একটি রাস্তার নামকরনও হয়নি অদ্যাবধী। বৃটিসÑভারত যুগে কবি নজরুল দুবার বরিশালে এসে এ নগরীর অপরূপ প্রকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন। কবি বরিশালে এসে কির্তনখোলার ধারে বাঁধ রোডের পাশের ঝাউ বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে তার অমর উপণ্যাস ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় কির্তনখোলা নদী ও তার পাশের বাঁধ রোডের ধারে ঝাউ বাগানের বর্ণনা দিয়ে বরিশালকে সুধি সমাজে তুলে ধরতে ভোলেন নি।
নজরুলের বরিশালে এখনো রূপসী বাংলার চিরয়াত কিছু রূপ চোখে পড়লেও অব্যাহত নগরায়নে এ নগরীতে কবির দেখা ঝাউ ও পাম গাছ সহ প্রকৃতির অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। দলবাজ সুশীল সমাজ ও দলদাশ বুদ্ধিজীবী সহ কথিত পরিবেশবাদীরাও গত কয়েক বছরেও এসব বিষয়ে স্বরব হবার সময় পাননি। দাবীও তোলেন না কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার। এমনকি গত কয়েক বছরে এনগরীতে সবুজায়ন সম্প্রসারনের পরিবর্তে আরো ধ্বংশ করা হয়েছে। অতি সম্প্রতিও এ নগরীতে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যায়ে বরিশালÑফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাড়কের একাংশ দখল করে একটি পার্ক নির্মানের নামে বেশ কিছু পাম গাছ কেটে ফেলেছে নগর ভবন। কিন্ত কেউ টু শব্দটিও করেন নি।
এনগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাতে গোনা কয়েকটি পাম গাছ এখনো তাদের অস্তিত্বের জানান দিলেও গাছের সারি বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। সাবেক নগর পরিাষদ নগরীর কয়েকটি স্থানে ঝাউ বাগান সৃজন করায় তার কিছু এখনো দাড়িয়ে থাকলেও অযতœ অবহেলায় বেশীরভাগেরই অস্তিত্ব বিপন্ন। নগরীর পাশে বহমান কির্তনখোলা নদীর পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, আমতলার মোড়ের স্বাধিনতা পার্ক, গোড়াচাঁদ দাশ রোডের খৃষ্টান গোরস্থান এবং বিসিক রোডের ধারে মহাশষানের পাশে ঝাউগাছের যে বনায়ন হয়েছিল বিগত নগর পরিষদের সময়ে, এখন আর তার তেমন কোন যতœ নেই।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৃটিশ যুগে অবিভক্ত বাংলার গভর্ণর শের এ বাংলা একে ফজলুল হকের সাথে প্রথম বরিশালে এসেছিলেন ১৯২০ সালে। বরিশালের সন্তান ফজলুল হকের সাথে সেবার তিনি বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সভায় দেশাত্ববোধক গান পরিবেশন করেন। পরবর্তিতে ১৯৩০ সালের দিকে তিনি নোয়াখালী হয়ে আরো একবার বরিশালে এসে এনগরীর প্রকৃতির শোভায় মোহিত হয়েতার অমর উপণ্যাশ ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় বরিশাল শহরের প্রাকৃতিক শোভার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দিয়েছেন। কবি নাসির উদ্দিনের সম্পাদনায় ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় মৃত্যুক্ষুধা উপণ্যাসটি বাংলা ১৩৩৪-এর অগ্রহায়ন থেকে ’৩৬ সালের ফাল্গুন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। কবি বৃটিশ যুগে এ শহরের পাশে প্রবাহমান কির্তনখোলা নদী তীরে সুরকীর রাস্তা আর গাছ গাছালীর কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি ।
জাতীয় কবি লিখেছিলেন, ‘বরিশাল। বাংলার ভেনিস। আঁকাবাঁকা লাল রাস্তা। শহরটি জড়িয়ে ধরে আছে ভুজ-বন্ধের মত করে। রাস্তার দু-ধারে ঝাউ গাছের সারি। তারই পাশে নদী। টলমল টলমল করছেÑবোম্বাই শাড়ী পরা ভরা-যৌবন বধুর পথ-চলার মত করে। যত না চলে, অঙ্গ দোলে তার চেয়ে অনেক বেশী। নদীর ওপারে ধানের ক্ষেত। তারও ওপারে নারকেল-সুপারী কুঞ্জঘেরা সবুজ গ্রাম, শান্ত নিশ্চুপ। সবুজ শাড়ী-পরা বাসর-ঘরের ভয়-পাওয়া ছোট্ট কনে-বৌটির মত। এক আকাশ হতে আর-আকাশে কার অনুনয় সঞ্চারন করে ফিরছে। বৌ কথা কও, বৌ কথা কও। আঁধারে চাঁদর মুড়ি দিয়ে তখনো রাত্রী অভিসারে বোরোয়নি। তখনো বুঝি তার সন্ধ্যা প্রসাধন শেষ হয়নি। শঙ্কায় হাতের আলতার শিশি সাঁঝের আকাশে গড়িয়ে পড়েছে। পায়ের চেয়ে আকাশটাই রেঙে উঠেছে বেশী। মেঘের কালো খোপায় ভূতীয়া চাঁদরে গো’ড়ে মালাটা জড়াতে গিয়ে বেঁেক গেছে। উঠোনময় তারার ফুল ছড়ানো। .....।’
তবে নজরুলের দেখা ‘বাংলার ভেনিস’ বরিশাল’কে এখন আর খুজে পাওয়া যায়না। অপরিকল্পিত নগরায়নে জাতীয় কবির বরিশাল থেকে বেশীরভাগ খাল বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। ফলে এনগরীতে এখন আর জোয়ারÑভাটার পানি আসা যাওয়া করে না। খাল বুজিয়ে যেসব কংক্রীটের ড্রেন নির্মিত হয়েছে, তাতে পানি চলাচলের পরিবর্তে ময়লার ভাগারে ঠাশা। ফলে এক ঘন্টার বৃষ্টিতে ড্রেনের পানি রাস্তাকে সয়লাব করে দিচ্ছে। অপরদিকে নদী বন্দর সচল রাখার নামে অপরিকল্পিত ড্রেজিং-এ কির্তনখোলার পলি আবার নদীতেই ফেলায় নদী মোহনায় খালের মুখগুলোর তলদেশ ভড়াট হয়ে এ নগরী ক্রমাগত জলাবদ্ধতার কবলে।
তবে বিবেকহীন নানা কর্মকান্ডে এ নগরী থেকে প্রকৃতির অনেক দান বিলুপ্ত হলেও তাকে রক্ষা করা সহ ফিরিয়ে আনার সময় এখনো আছে বলে মনে করছেন পরিবেশবীদগন।
কবি নজরুল ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় যে স্থানের বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেটি নিঃসন্দেহে নগরীর বাঁধ রোডের ভাটার খাল থেকে স্টেডিয়ামের মধ্যবর্তি এলাকা। কির্তনখোলা নদী তীরে সে সময়ের বরিশাল শহর, আজকের মহানগরীর ঐ এলাকায় বাঁধ রেডের দুধারে তখন ঝাউ আর পাম গাছের সারি যেকোন পাষানেরও মন যুড়াত। নজরুলের দেখা বাঁধ রোডটি জাতীয় কবির নামে নামকরণের দাবীও রয়েছে সাধারন মানুষের।
কিন্তু অপরিকল্পিত ও বিবেকহীন নগরায়নের ধাক্কায় গত কয়েক যুগে নগরীর বাঁধ রোডের দুধার থেকে প্রকৃতির দান বিলুপ্ত হয়েছে। এ নগরীতে কোন পাম গাছেরই অস্তিত্ব আর চোখে পরছেনা। বাঁধ রোডে কির্র্তনখোলা তীরের ঝাউ বাগান পুরোপুরি বিলুপ্ত হবার পরে বছর দশেক আগে মুক্তিযোদ্ধা পার্কে যেসব ঝাউগাছ লাগান হয়েছিল, তা এখন মাথা উচু করে অতীত স্মৃতির জানান দিচ্ছে। তবে বাঁধ রেডে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পাশে যে কয়টি পাম গাছ সর্বশেষ তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল, তাও কয়েক বছর আগে কেটে ফেলা হয়েছে কথিত নিরাপত্তার অজুহাতে। যদিও বঙ্গবন্ধু উদ্যানের কোল ঘেষে বাঁধ রোডের ধারে কিছু সোনালু গাছ এখনো রঙ ছড়াচ্ছে। চোখ যুড়াচ্ছে ছোট-বড় সবার।
ইতোমধ্যে নিকট-দুরের হীমনীড়-এর ‘পদ্ম পুকুর’এর পদ্ম ফুলের বংশ সমুলে ধ্বংশ করারও একটি কর্মজজ্ঞ ইতোমধ্যে পরিচালিত হলেও সেখানে প্রকৃতিকে শেষ করা যায়নি। পদ্ম পুকুরের স্বেত পদ্ম’রা আবার ফিরে এসেছে। এ পদ্ম পুকুর, আর ফুল দেখতে এখনো দুর দুরান্ত থেকে বহু মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসেন।
কিন্তু পাম গাছ আর ফিরে আসেনি। বাঁধ রোডের ধারে বঙ্গবন্ধু উদ্যান বা বেল পার্কের পাশের সোনালু ফুল এ নগরীর শোভা বর্ধন করলেও পাম গাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। নগরীর ফজলুল হক এভেনিউ ও হাসপাতাল রোডের পাশের প্রায় সব পাম গাছ বিলুপ্ত হয়েছে গত দেড়দশকে। সবশেষে গত এক দশকে নগরীর সরকারী হাতেম আলী কলেজ মাঠ সংলগ্ন জাতীয় মহাসড়কের পাশে যেকয়টি পামগাছ স্থানীয়দের উদ্যোগে রোপন করা হয়েছিল, তাও ধ্বংশ করল নগর ভবনের বিবেকহীন দায়িত্বশীল (?) মহল।
নগর ভবন বা বন অধিদপ্তরও এ নগরীর সবুজায়ন সহ প্রকৃতির অতীত রূপে ফিরিয়ে আনতে তেমন কোন ভ’মিকা রাখছে না। এ অভিযোগ সাধারন নগরবাসীর। তবে চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে সিটি মেয়রের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন