ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১

তালিকাভুক্ত মাদক নয়, তবুও ড্যান্ডির কবলে রাজধানীর পথশিশুরা

Daily Inqilab নিজস্ব প্রতিবেদক

২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:১৪ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:১৪ এএম

গায়ে ছেড়া জামা, ময়লা প্যান্ট,উসকো খুসকো চুল, চোখে ঘুমঘুম ভাব রাজধানীর বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায় ঘুরছেন বেশ কয়েকটি পথ শিশু। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- তারা ড্যান্ডি নামক মাদকের নেশায় আসক্ত। তাদের মত হাজারো শিশুর দেখা মেলে শহরে অলিগলিতে। সস্তা ও সজলভ্য হওয়ায় ছিন্নমূল এই শিশুদের মাঝে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে এ নেশার বিস্তার। ড্যান্ডি কেনার টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।

তালিকাভুক্ত টলুইন মাদক দিয়ে ড্যান্ডি নামক আঠা তৈরি হয়, যা সাধারণত মেলে হার্ডওয়ারের দোকানে। এটি সংগ্রহের নেই কোনো বিধিনিষেধ। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরও নেই কোনো মাথা ব্যাথা।

 

রাজধানীর, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা, মহাখালী, ফার্মগেট, গুলিস্তান, খিলগাঁও, কমলাপুর, মালিবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা এলাকা ঘুরে মতো আরও পথশিশুদের এভাবেই নেশা করতে দেখা যায়। পথশিশুদের কেউ কেউ দিনের বেলা নেশা করলেও বেশিরভাগই নেশা করে রাতে। কেউ একা, আবার কেউ কেউ গোল হয়ে বসে সংঘবদ্ধ হয়ে নেশা করে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও নিজের পরিধেয় জামায় ড্যান্ডি গাম লাগিয়ে নেশা করে তারা। কিছুক্ষণ পর পর ঘ্রাণ নিয়ে নেশায় বুদ হয়ে যায় সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা।

 

 

উত্তরা এলাকায় প্লাস্টিকের বোতল, কাগজ কুড়ায় সাগর (ছদ্মনাম)। এই কাজে তার প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয়। তবে আয়ের প্রায় পুরো টাকাই ব্যয় করে এই ড্যান্ডির পিছনে। তার সাথে দেখা যায় আরও দুজনকে। সবাইমিলে কাজ করে যে টাকা করে তার পুরো টাকাই উড়ে জায় ড্যান্ডির পিছনে।

 

সদরঘাটে কুলির কাজ করে ১৪ বছর বয়সের আনিস। রাত তখন ৯টা। কথা হয় তার সঙ্গে। তখন হাতে পলিথিনের মধ্যে ড্যান্ডি নিয়ে মুখ ঢুকিয়ে সেবন করছেন আনিস। তার সেথে ছিল আরও দুজন। নাম জানতে চাইলেও বলেনি।

কথা বলতে চাইলে তারা জানায়, তারা সবাই বন্ধু। একসাথে কাজ করে। এই কথা বলার মাঝে মাঝেই পলিথিনে মুখ ঢুকিয়ে সেবন করছিলেন ড্যান্ডি। তাদের।চোখে ঘুম ঘুম। জানালো এই ড্যান্ডি খেলে ঘুম ঘুম লাগে। নিজেদের রাজা মনে হয়। আকাশে উড়ে বেড়ানো যায়।

কথা বলার সময় আনিস বলে, নেশার জন্যই তারা কাজ করে। যহন কাম করি তহন বাদে প্রায় এই ডান্ডি খাই।

 

ড্যান্ডি একধরনের আঠা। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট নামের আঠাটিকেই মাদক সেবীরা ডান্ডি বলে চেনে। এই আঠা দিয়ে নেশা করে তারা। আঠায় থাকা কার্বন-ট্রাই-ক্লোরাইড, টলুইন, অ্যাসিটোন ও বেনজিন স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই বাষ্পে পরিণত হয়। এসব রাসায়নিক শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে মাদকসেবি পথশিশুরা।

 

চিকিৎসকরা জানান, ক্রমশ ব্যবহারের কারণে মাদকটি ধীরে ধীরে চরম আসক্তিতে পরিণত হয়।

 

এ বিষয়ে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সৈয়দ ফাহীম সামস বলেন, পথশিশুদের ড্যান্ডি গ্রহণ করার একমাত্র কারণ এটি সস্তা ও সহজলভ্য। অন্য মাদকের চেয়ে ড্যান্ডির পার্থক্য হলো এটি অন্য ধরনের এক অনুভূতির সৃষ্টি করে, যা আবেগকে ভিন্নভাবে পরিবর্তিত করে। যে কারণে পথশিশুদের মধ্যে এটি জনপ্রিয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে গুরুতর মানসিক সমস্যার পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক জটিলতাও সৃষ্টি হয়।

 

গুলিস্তানে বেশ কয়েকজন মাদকাসক্ত পথশিশুর কথা হয়। তারা জানায়, নেশা করার জন্য আঠাটি তারা কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মুচির কাছ থেকে কিনে নেয়।

বেশ কয়েকজন মুচির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আঠাটি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয়।

 

এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন হার্ডওয়্যারের দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামের আঠাটি ভারত থেকে আসে। এই আঠা দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, চামড়া সহ বিভিন্ন পণ্য জোড়া দেয়ার কাজ করা হয়। কৌটায় এবং টিউবে দুইভাবেই বিক্রি করা হয় আঠাটি। টিউবের আঠাটির দাম ৪০-৫০টাকা। তবে কৌটায় পরিমাণে বেশি থাকায় দামও বেশি হয়।

 

এদিকে, ২০২২ সালে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) একটি গবেষণায় বলা হয়, দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশুর বয়স ১০ বছর হওয়ার আগেই মাদক গ্রহণ করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুই গাঁজা সেবন করে। ড্যান্ডিতে আসক্ত ১৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু।

 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক গবেষণা ও ইউনিসেফের বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী ঢাকাতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার।

 

গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মানজুরুল ইসলাম ইনকিলাব অনলাইনকে বলেন, এই ড্যান্ডি বা আঠা আমাদের ঢাকায় পথশিশুরাই বেশি সেবন করে। এখন সে সংখ্যাটি নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। মূলত ৫-১০ বছর বয়সী পথশিশুদের মধ্যেই ড্যান্ডি গ্রহণের প্রবণতা বেশি।

 

মাদকাসক্ত পথশিশুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে থাকলেও মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য তাদের কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। যার ফলে চিকিৎসা নিতে মাদকাসক্ত পথশিশুদের মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রেই যেতে হয়।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মাদকাসক্তদের জন্য দেশে সর্বমোট ৩৬২টি নিরাময় কেন্দ্র আছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা চারটি।

বেসরকারি কেন্দ্রে ৪ হাজার ৮৪৬টি শয্যা থাকলেও সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা মাত্র ১৭৯টি; যা প্রয়োজনের তুলনায় ভীষণ অপ্রতুল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র ব্যয়বহুল হওয়ায় পথশিশুদের সেখানে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ থাকে না।

 

পথশিশুদের ড্যান্ডি গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে জনসচেতনতাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে মানছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

 

এবিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মানজুরুল ইসলাম ইনকিলাব অনলাইনকে বলেন, ড্যান্ডি এখনো মাদক হিসেবে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়নি। এই আঠাটি কাঠ মিস্ত্রি, সাইকেল রিকশা, ভ্যান, জুতারদোকানিসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যাবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর এই আঠা যারা বানায় এবং দোকানী যারা বিক্রি করে তাদের ও লাইসেন্স আছে। তাই এটা নিষিদ্ধ করাও সম্ভব নয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তের এই কর্মকর্তা বলেন, রিকশা মেকানী অন্যান্য যারা এই আঠা ব্যবহার করে তাদের তো লাইসেন্স লাগে না। তাই এই আঠা বিক্রির যাদের লাইসেন্স আছে তারা যেন যাচাই-বাছাই করে বিক্রি করে।

 

মানজুরুল ইসলাম আরও বলেন, অনেক সময় শিশুরা রিকশা মিকার বা জুতার দোকানের কাজের মিথ্যা বলে আঠা কিনে আনে। সেক্ষেত্রে
বারবার বলছি তারা যেন কোনভাবেই শিশুদের কাছে এটি বিক্রি না করেন। এক্ষেত্রে সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, এই আঠায় পথশিশুরা বেশি আসক্ত। আমরা মাঝে মাঝেই এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। যেসব পথশিশু এই আঠা সেবন করে তাদের নিয়ে এসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তে চিকিৎসা করানো হয়।
পথশিশুরা যেন কোনভাবেই ড্যান্ডি না পায় তাই আমরা নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি বলেও জানান এই কর্মকর্তা।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স