দেশে নির্মিত হল হিজড়া জনগোষ্ঠীদের প্রথম মসজিদ

বিশেষ সংবাদদাতা, ময়মনসিংহ

৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৬ এএম

ময়মনসিংহ নগরীর ৩৩ নং চর কালীবাড়ী ওয়ার্ডের বড়ইকান্দী গ্রামে গড়ে উঠেছে দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীদের প্রথম মসজিদ। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে নির্মিত এই মসজিদে মুগ্ধ এলাকাসী। এতে হিজড়াদের সাথে নিয়মিত নামাজ পড়ছে এলাকার সাধারণ মানুষও।
শুক্রবার (২৯ মার্চ) বিকাল ৫টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে নবনির্মিত এই মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। এর আগে চলতি রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগে এই মসজিদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
সরেজমিনে দেখা যায়, এক কক্ষ বিশিষ্ট মসজিদটির দেয়াল ও চাল টিনের। সামনে ছোট্ট বারান্দা। পাশেই বসানো হয়েছে সাবমারসেবল পাম্প, ওজুখানা (নির্মানাধীন) ও বাথরুম। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ৩৩ শতক জমি বরাদ্দ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বানানো এই মসজিদের নাম দক্ষিণ চর কালিবাড়ি আশ্রয়ণ জামে মসজিদ।
স্থানীয় হিজড়া ও এলাকাবাসী জানান, বড়ইকান্দী গ্রামের পাশেই একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যেত ওই এলাকায় বসবাসকারী কয়েকজন হিজড়া। তখন মুসল্লীদের কেউ কেউ হিজড়াদের নিয়ে কটূ কথা বলে। এতে বিভ্রতবোধ করে হিজড়ারা তাদের নেতা তনু হিজড়াকে ঘটনাটি জানায়। পরে নিজেদের মধ্েয আলোচনা করে তারা এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
এই মসজিদের সভাপতি স্থানীয় বড়ইকান্দী গ্রামের বাসিন্দা মো: আব্দুল মোতালেব জানান, হিজড়াদের সাথে আমরাও একমত হয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করেছি। এতে স্থানীয় বাসিন্দারাও নিয়মিত নামাজ পড়ছে।
এ সময় কথা হয় উদ্েযাক্তাদের একজন স্থানীয় হিজড়া মো: এনামুল হক রাসেল ওরফে রাশি হিজড়ার সাথে। সে বলেন, এই এলাকায় আমরা ৪০ জন হিজড়া বসবাস করি। আমরাও নামাজ কালাম করতে চাই। কিন্তু পাশের এক মসজিদে আমাদের কয়েকজন নামাজ পড়তে গেলে অনেকেই হাসাহাসি ও কুটোক্তি করে। এজন্য আমরা বিভাগীয় কমিশনারের কাছ থেকে ৩৩ শতক জমি বরাদ্দ নিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। পাশাপাশি একটি মাদরাসা, তিনতলা মসজিদ কমপ্লেক্সসহ কবরস্থান ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠান বাস্তবে রূপ নিবে। সেই সঙ্গে বিভাগীয় কমিশনার আমাদের মসজিদের জন্য দুই লাখ টাকা দিয়েছেন, এটা দিয়েই আমরা এই মসজিদের প্রাথমিক কাজ করেছি।
রাশি আরও জানায়, বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হিজড়া জনগোষ্ঠী। এমনকি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও তাদের সুযোগ কম। তাই সরকারের দান করা জমিতে আমরা এই মসজিদ বানিয়েছি।
মো: রফিকুল ইসলাম ওরফে মুক্তা হিজড়া বলেন, ছোটবেলায় মাদরাসায় পড়েছি। এখন নিজেদের মসজিদে নামাজ পড়ি, কোরআন তেলাওয়াত করি। এতে আমাদের সাথে এলাকাবাসীও থাকে। এখন আমরা খুব খুশি। এখন থেকে কেউ আর হিজড়াদের এই মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে কুটোক্তি করতে পারবে না। জুই হিজড়া বলেন, আমরাও মুসলিম। সবাইকে মরতে হবে। আল্লাহর ভয় করে আমরাও নামাজ পড়ি। আমাদেরও কবরে সওয়াল জবাব হবে।
এই মসজিদের পাঁচওয়াক্ত নামাজের ইমাম হাফেজ মো: আ: মোতালেব বলেন, গত বিশদিন ধরে আমি এই মসজিদে পাঁচওয়াক্ত নামাজে ইমামতি করি। এতে হিজড়াসহ এলাকাবাসীও নামাজ পড়ছে। ভালোই লাগে, মনে শান্তি পাই।
স্থানীয় মুদি দোকানি মো: আজিজুল হক বলেন, নদের তীরে এলাকাবাসীর একটি মসজিদ ছিল। সেটি কিছুদিন ধরে ভেঙ্গে পড়েছিল। এরপর স্থানীয় হিজড়ারা একটি মসজিদ করতে চাইলে আমরাও তাদের সাথে যোগ দিয়ে এই মসজিদ করেছি। এখন সবাই একত্রে নামাজ পড়ি। ভালোই লাগে। আশা করছি এর মাধ্যমে হিজড়ারাও আল্লাহর পথে অনুপ্রাণিত হবে।

জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজীয়া বলেন, স্থানীয় হিজড়া জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্য আমার কাছে এসে মসজিদ ও কবরস্থানের জন্য জমি চাইলে তাদের ৩৩ শতক জমি সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরপর সম্প্রতি তারা মসজিদের ঘর নির্মাণের জন্য আমার কাছে সহযোগিতা চায়। পরে আমি তাদের জন্য একজন বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শুনেছি তারা এখন মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ পড়ছে। স্থানীয়রাও তৃতীয়লিঙ্গের এই জনগোষ্ঠীদের ইতিবাচকভাবে গ্রহন করে নিয়েছে, এটা ভালো কাজ।

বিভাগ : বাংলাদেশ