নিরাপদ প্রজননের পরে ইলিশ আহরনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল
০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১০ পিএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১০ পিএম
নিরাপদ প্রাকৃতিক পরিবেশে ইলিশের নির্বিঘœ প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে টানা ২২ দিনের আহরন, পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল মধ্যরাতে। ফলে বরিশাল উপক’ল এলাকার জেলে পল্লী সহ মৎস্য আড়তগুলো আবার কর্ম চঞ্চল হয়ে উঠেছে। গত মধ্যরাত থেকেই জেলেরা নাও ভাসাতে শুরু করেছে উপক’ল সহ অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে। ইতোমধ্যে নৌকা, ট্রলার ও জাল সহ সব মৎস্য আহরন উপকরনও প্রস্তুত করেছে জেলেরা। আড়ৎদার ও মহানজনরা ইতোমধ্যে দাদন (অগাম মাছের দাম) দিয়ে জেলেদের সাগর ও নদীতে পাঠানোর কাজটিও চুড়ান্ত করেছে। বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য আড়তগুলোর নিরবতাও ভঙ্গ হয়েছে ইতোমধ্যে। পাশাপাশি আলীপুর-মহীপুর, হরিনঘাটা, পাড়েরহাট, চর মোন্তাজ, ঢালচর, চর কুকরী-মুকরী সহ উপক’লের সব মৎস্য আড়তগুলোও ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে। দেশে আহরিত প্রায় ৫.৮০ লাখ টন ইলিশের ৭০ভাগই বরিশাল অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও উপক’লীয় এলাকায় উৎপাদন ও আহরন হচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
তবে নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে বিগত বছরগুলোর মত এবারো বাংলাদেশের উপক’ল সহ সমুদ্র সীমায় ভারতীয় অনেক জেলে নৌকা ও ট্রলার অবৈধভাবে প্রবেস করে মাছ লুটে নিয়েছে। এবারো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে অন্তত ১০টি ভারতীয় ট্রলার আটকের পরে পুলিশের কাছে সোপার্দ করে বিধি অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে নিরাপদ প্রজননের ২২দিন এবং সাগরে মৎস্য আহরনে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ভারতীয় শত শত ট্রলার অবৈধভাবে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় প্রবেস করে মাছ লুটে নেয়ার ঘটনায়ও একাধিক ট্রলার আটক হয়েছে। পরবর্তিতে অবশ্য ভারত সরকারের অনুরোধে ঐসব লুটেরাদের বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছে সসম্মানে হস্তান্তর করা হয়।
ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘœ করতে দেশের উপক’লের ৭ হাজার ৩৩৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ইলিশ আহরন,পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয় গত ১৩ অক্টোবর মধরাতে। এবারো এ নিষেধাজ্ঞা কালীন সময়ে দেশের দক্ষিণ উপক’লের ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৫ জেলেকে মানবিক খাদ্য সহায়তা হিসেবে পরিবারপিছু ২৫ কেজি করে ১৪ হাজার ১৬৫ টন চাল বিতরন করা হয়েছে।
তবে এবছর বরিশাল সহ দক্ষিণ উপক’লে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মৎস্য আহরন প্রবনতাও অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী লক্ষ্য করা গেছে। যদিও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা ছাড়াও ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা সহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। এলক্ষ্যে পুলিশ ও র্যাব ছাড়াও কোস্ট গার্ড এবং নৌ বাহিনীও মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে। এমনকি এলক্ষ্যে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
মৎস্য অধিধপ্তরের মতে গত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে বরিশাল সহ উপক’লীয় এলাকায় প্রায় ১০ হাজার অভিযান ছাড়াও ২ সহশ্রাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে প্রায় ২ হাজার জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৭০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এসময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রায় ৬ কোটি মিটার জাল বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে ফেলা সহ বিভিন্ন মৎস্য উপকরন বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রী করে সরকারের আয় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অভিযানকালে প্রায় ৫৫ টন ইলিশ আটক করে বিভিন্ন এতিমখানা ও লিল্লøাহ বোর্ডিং-এ দান করা হয়েছে। এসময় আইন ভঙ্গের অভিযোগ আরো প্রায় ৩ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে জেলে সহ মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে। নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীগন পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় প্রায় ৫০ হাজার মৎস্য আড়ৎ, বাজার, মাছঘাট পরিদর্শন করে ইলিশ বিপনন নিয়ন্ত্রনে কাজ করেছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
মৎস্য অদিদপ্তরের মতে, সারা বিশে^র ৬০%-এরও বেশী ইলিশ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এর বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২.৫০%।
আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পরের ২২ দিন আহরন ও বিপনন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রজনন সময় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে এসময় কিছুটা হেরফের করা হচ্ছে।
‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’এর আওতায় ২০০৫ সালেই প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিন ও ২০১৬ সালে থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়েছে। এমনকি ইলিশ নিয়ে নানামুখি গবেষনা ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন একসময়ের ১.৯৮ লাখ টন থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৫.৬৫ লাখ টনে উন্নীত হবার পরে সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে তা ৫.৮০ লাখ টনে উনাœীত হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর আশাবাদী।
ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে ইতোমধ্যে নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজর্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি গত ২২দিনে মা ইলিশ যে ডিম ছেড়েছে তা থেকে লার্ভা হয়ে ইলিশ পোনা সংরক্ষণে গত ১ নভেম্বর থেকে ৮ মাসের জন্য জাটকা আহরন,পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এসময়ে বরিশাল উপক’লের ৬টি এলাকাকে দু মাস করে ‘অভায়শ্রম’ ঘোষনা করে সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে।
প্রতিদিন শ্রোতের বিপরিতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপক’লের ৭ হাজার ৩৩৪ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মূক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে বিচরন করে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। অভয়াশ্রমের ‘নার্সারী ক্ষেত্র’সমুহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকাসিষ্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে, তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষনায় দেখা গেছে, নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে ইলিশপোনা-জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। এমনকি ২০২২ সালের প্রজনন মৌসুমে দক্ষিণ উপক’ল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী। ফলে ঐ বছর ৪৩ হাজার কোটিরও বেশী জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ২০১৮-এর আহরন নিষিদ্ধকালে উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীন মূক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেলেও ২০১৭ সালে তা ৭৩% এবং ’১৮ সালে ৯৩%-এ উন্নীত হয়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০%-উন্নীত হয়।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেসিকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের
‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে তৈরি আছি: হাছান মাহমুদ
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে দলের কোনো নেতা-কর্মীকে ছাড় দেওয়া হবে না : যুবদল সভাপতি
ঢাকা মেডিকেলের সিসিইউতে ভর্তি শাজাহান খান
আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন কাল
ব্র্যাক ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার রিটেইল ডিপোজিট মাইলফলক
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় জোর দিতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শ
ব্রাহ্মণপাড়ায় জেলেকে পিটিয়ে হত্যা
কুয়াকাটায় দুই নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
কলারোয়ায় হাজার হাজার ছাগলের মৃত্যু
হত্যা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর প্রতিবাদ
শিয়ালের কামড়ে নারী ও শিশুসহ আহত ৯
লোহাগাড়ায় ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
বন্দরগুলোর অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা
পঞ্চগড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান
ধামরাইয়ে পুলিশ ক্যাম্পে ঝুলছে তালা
ভোগান্তির আরেক নাম আশাশুনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
যশোরে বিএনপি নেতার আদালতে আত্মসমর্পণ
যশোর শহরজুড়ে রাস্তার পাশে ময়লার ভাগাড়