শষ প্রান্তে এসে মেঘনা অববাহিকা সহ পুরো বরিশাল অঞ্চল যুড়ে শেষ রাতে হালকা থেকে মাঝারী কুয়াশায় দিগন্ত ঢেকে গেলেও বেলা বাড়ার সাথে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈপরিত্যে জনস্বাস্থ্যের সাথে কৃষি এবং প্রকৃতিতেও নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়ার এ বিরূপ আচরনে বরিশাল অঞ্চল যুড়ে জ¦র সহ ঠান্ডাজনিত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধ সহ নানা বয়সের মানুষ।

এবার বর্ষা মৌসুম যুড়ে বৃষ্টির আকালের ফলে কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয়ের পরে শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের অতিবর্ষনেও ফসল নিয়ে বিপাকে কৃষিযোদ্ধাগন। পুরো বর্ষা মওসুম যুড়ে বৃষ্টির দেখা না মিললেও শরতের শেষপ্রান্ত থেকে হেমন্তের শেষভাগেও অসময়ের অতিবর্ষন কৃষিকে ঝুকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বরিশাল উপক’ল থেকে বিদায় হয়েছে আরো প্রায় কুড়িদিন আগেই।

কিন্তু এর পরেও ঘূাির্ণঝড় ‘দানা’য় ভর করে সদ্যসমাপ্ত অক্টোবরেও বরিশালে স্বাভাবিকের ৬২.১% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। হেমন্তের শেষ প্রান্তেও স্বাভাবিকের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বরিশাল অঞ্চল যুড়ে এইডস মশাবাহী রোগ ‘ডেঙ্গু’র দাপট অব্যাহত রয়েছে। পুরো বছর যুড়ে যে পরিমান রোগী সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, শুধু অক্টোবরেই তার প্রায় সমান ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এমনকি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যু হলেও শুধু অক্টোবরেই মারা গেছেন আরো ১৭ জন। চলতি মাসেও আক্রান্তের সাথে মৃত্যুর মিছিলেও যোগ হচ্ছে আরো নতুন নাম।

এমনকি হেমন্তের শেষভাগে শেষ রাতের কুয়াশার দাপট শীতের আগাম বার্তা দিলেও বেলা বাড়ার সাথে তাপমাত্রার পারদও স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাওয়ায় জনজীবনে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগের মতে হেমন্তের মধ্যবর্তি অক্টোবরে বরিশালে দিনের সর্বোচ্চ স্বাভবাবিক তাপমাত্রা ৩১.৬ ডিগ্রী থাকার কথা। কিন্তু গত মাসে তা ৩৫-৩৬ ডিগ্রীতেও উন্নীত হয়েছে। আবার চলতি নভেম্বরে বরিশালের দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেখানে ২৯.৬ ডিগ্রী থাকা কথা, সেখানে মাসের প্রথম দিনেই তা ছিল প্রায় ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মঙ্গলবার দুপুরেও বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ছিল প্রায় ৩৪ ডিগ্রীর কাছে। অপরদিকে চলতি মাসে দিনের সর্বনি¤œ তাপমাত্রাও ১৮.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের স্থলে তা প্রায় দিনই ২৫ ডিগ্রী ছুয়ে যাচ্ছে।

অথচ মূল বর্ষা মৌসুমে এবার বৃষ্টির আকালে দেশের প্রায় ৩০ ভাগ আবাদী এলাকার বরিশাল অঞ্চলে আউশের আবাদ লক্ষ্য ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টরের স্থলে মাত্র ১ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টরে সিমিত থাকলেও ঘূর্ণিঝড় রিমাল’এর প্রভাবে আরো আড়াই হাজার হেক্টরের ধান সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। ফলে পুরো এবার আউশ উৎপাদন লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় প্রায় ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল কৃষি অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় ধাক্কা লাগেছে। সদ্য সমাপ্ত খরিপ-১ মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আউশের উৎপাদন ৫ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরের স্থলে প্রকৃত উৎপাদন মাত্র ৩.৪৫ লাখ টনে নেমে এসেছে।
অপরদিকে বিগত ভাদ্রের পূর্ণিমার প্রবল বর্ষণ সহ ফুসে ওঠা সাগরের প্লবনের সাথে উজানের ঢলে পুরো গ্রীষ্মকালীন সবজি সহ আগাম শীতকালীন সবজির আবাদও যথেষ্ঠ বাধাগ্রস্থ করেছে।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির আকালে আউশ বীজতলা তৈরী ও রোপন যেমনি বাধাগ্রস্থ হয়েছে, তেমনি রোপা আউশও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গত মে মাসের শেষভাগে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’এ ভর করে প্রবল বর্ষণে। এমনকি গতমাসেও আশি^নের পূর্ণিমার প্রভাবে অতি বর্ষণ ছাড়াও ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ বরিশাল উপক’লের প্রায় ৫শ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতে উরিষ্যা উপক’লে আঘাত হানলেও তার প্রভাবে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসার গভীর সঞ্চালণশীল মেঘমালার প্রবল বর্ষণে উঠতি আউশ ধানেরও ক্ষতি হয়েছে।
এবার গত জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে বরিশালে কোন বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মার্চে ৩০ ভাগ এবং এপ্রিলে ৮৬% কম বৃষ্টির পরে ঘূর্ণিঝড় রিমাল-এর ভর করে মে মাসে স্বাভাবিকের প্রায় ৫০ ভাগ বেশী বৃষ্টি হয়। কিন্তু জুন মাসে প্রায় ৬০ ভাগ এবং জুলাই মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৩১ ভাগ কম বৃষ্টির প্রভাব পরে বরিশালের ফসলের মাঠে। আবার ভাদ্রের পূর্ণিমায় ভর করে লাগাতার প্রবল বর্ষণে আগষ্ট মাসে ৬২% বেশী বৃষ্টিপাতে উঠতি আউশ আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেপ্টেম্বর মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৫২% বেশী বৃষ্টির পরে অক্টোবরে স্বাভাবিক ১৭০ থেকে ২শ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হলেও বাস্তবে গত মাসে বরিশালে স্বাভাবিকের ৬২.১% বেশী, ২৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরেই ঘূর্ণিঝড়-প্লাবনের সাথে অস্বাভবাবিক বজ্রপাত সহ অসময়ের অতিভারি বর্ষণের সম্মুখিন হচ্ছে পুরো বরিশাল সহ সংলগ্ন উপক’লীয় অঞ্চল। তবে প্রকৃতির এ বৈরী আচরনকে ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব’ বলে মানতে চাচ্ছেন না নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞগন। কেউ কেউ একই মৌসুমে ঘন ঘন আবহাওয়ার পরিবর্তনকে ‘জলবায়ুর ভারসাম্যহীনতা’ বলে মনে করে প্রকৃতির এ অস্বাভাবিক আচরনকে ‘জলবায়ুর ধারবাহিকতার সাময়িক দৃশ্যমান বিচ্যুতি’ বলেও মনে করছেন অনেকে।