তাহিয়ার জন্মদিনেই পাশবিক নির্যাতনে লাশ হয়ে ফিরলো বাবার কোলে

Daily Inqilab ফরিদপুর সংবাদদাতা

১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৮ পিএম | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৮ পিএম

সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে তাহিয়া। খুনসুটিতে মাতিয়ে রাখতো সারাঘর।মা-বাবার কলিজার ধন তাহিয়া ছিল দাদা-দাদিরও চোখের মণি। তাহিয়ার সপ্তম জন্মদিন ছিল ১০ ডিসেম্বর।

 

দিনটিতে কত কী করবে বলছিল। রাজমিস্ত্রি বাবাও মেয়েটার শখ-আহ্লাদ পূরণের কমতি রাখছিলেন না।

 

প্রতিবারের মতো এবারও তাহিয়ার জন্মদিন উদযাপনে তার মা, দাদি আর দাদার সঙ্গে কেনাকাটার হিসাব কষেন ৯ ডিসেম্বর রাতে। এরপর ঘুমিয়ে পড়েন।

 

পরদিন মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সকালে সবাই যার যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের চরনাসিপুর গ্রামের প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া তাহিয়াও দুপুরের খাবার-দাবার সেরে বিকেলে সবার সঙ্গে খেলাধুলায় মশগুল হয়। এর মধ্যে তাকে খোঁজ করতে থাকেন মা-বাবা। কিন্তু তার খোঁজ মেলে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, সারা বাড়ি, আশপাশ তন্নতন্ন করে খোঁজা হতে থাকে তাহিয়াকে। রাত গড়ালেও মেয়েটার কোনো হদিস মেলে না।

স্থানীয়দের অভিযোগ পেয়ে পরদিন (১১ ডিসেম্বর) বুধবার কোতয়ালী থানার পুলিশ সেখানে যায়। এক পর্যায়ে তাহিয়াদের পাশের দূর সম্পর্কের দাদা হায়দার আলীকে (৫৫) সন্দেহ করা হয়। তখন পুলিশ তার বাড়ির মাচার নিচ থেকে বিদ্যুতের তার দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় তাহিয়ার বস্তাবন্দি মরদেহ করে।

হায়দার আলী শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছেন সন্দেহ থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয়রা। সন্ধ্যার দিকে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পুলিশ জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও বিক্ষুব্ধদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে পুলিশ তাহিয়া ও হায়দারের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

জন্মদিনেই যে ঘাতক তাহিয়ার প্রাণ কেড়ে নেবে, সে কথা ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন তার মা-বাবা। স্বজনরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না, এইটুকুন মেয়ে এমন পাশবিকতার শিকার হবে।

শিশুটির বাবা বলছিলেন, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে বড়, অনেক আদরের ছিল। ছোট একটা শিশুকে একটা মানুষ মারতে পারে, তা চিন্তাও করতে পারছি না। জীবনে আমি আমার মেয়েকে আর ফিরে পাব না। আমাকে বাবা বলে ডাকবে না। এ কষ্ট রাখার জায়গা নেই।

সরেজমিনে চরনাসিপুরে গিয়ে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে। তারা ইনকিলাব কে বলছেন, হায়দার আলীই তাহিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছেন বলে তারা মনে করছেন। সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে মেয়েটিকে বস্তাবন্দি করে লাশ গুম করার জন্য মাচার নিচে রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনকালে এলাকাবাসী ইনকিলাব কে বললেন ঘটনার দিন ছিল তাহিয়ার জন্মদিন। পিতা জন্মদিন পালনে বাজার করতে বাজারে গেলেন। ফিরে কন্যার লাশ কোলে নিলেন।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান তখন ইনকিলাবকে বলেন, নিখোঁজ মেয়েটির খোঁজে তদন্তে নেমে পাশের বাড়ির হায়দার (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে সন্দেহ করা হয়। পরে তার ঘরের ভেতর তল্লাশি চালিয়ে একটি বস্তার ভেতরে বিদ্যুতের তার দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় তাহিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শৈলেন চাকমা ইনকিলাব কে বলেন, হত্যার আগে শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না তা ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে। মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. ইউনুস আলী ইনকিলাব কে বলেন, ‘শিশু তাহিয়ার গোপনাঙ্গের ব্লাডিং (রক্ত) দেখে প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত হিসেবে মনে হয়েছে। মেয়েটি হত্যার আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এটা বলা যেতে পারে। তবে, কে ধর্ষণ করেছে এসব ম্যাচিংয়ের ব্যাপার রয়েছে, তাই বিস্তারিত এখনই বলা যাচ্ছে না। ’

 

‘অভিযুক্ত হায়দার জেলে খেটেছিলেন দেশ-বিদেশে, কাটাতেন একাকী জীবন’:-

চরনাসিপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ইসমাইল হোসেন, মো. আব্বাস মিয়া ও মো. মোতাহার হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ইনকিলাব কে

তারা জানান, অভিযুক্ত হায়দার চরনাসিপুর গ্রামের জহিরউদ্দিন মোল্লার ছেলে। তার বয়স ৫৫ বছর। তিনি ঘরে একাই থাকতেন।

ওই বাসিন্দাদের অভিযোগ, হায়দার ২১-২২ বছর বয়সের সময় তার বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে হত্যা মামলার আসামি হয়ে জেল খেটে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। ৩৩ বছর বয়সে কুয়ালালামপুরে ইন্দোনেশিয়ার তৃষা ত্রিপলী নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে তিন ছেলে মেয়ে আছে। সেখানেও মারিয়া নামের লেবাননের এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন হায়দার। এতে বিরোধ বাঁধে স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রীর মামলায় কুয়ালালামপুর কারাগারে যান হায়দার। দীর্ঘ নয় বছর জেল খাটার পর দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরলেও একাকী জীবন কাটাতেন।

এদিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হলেও হায়দার আলীর মরদেহ নিতে চাচ্ছে না চরনাসিপুরের কেউ। তারা ওই এলাকায় দাফনও করতে দিচ্ছে না হায়দারের মরদেহ। এমনকি তার আত্মীয়-স্বজন কেউও আসেননি মরদেহ নিতে। এজন্য মর্গে পড়ে আছে তার মরদেহ।

এ ব্যাপারে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক দীপক কুমার ইনকিলাব কে বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে আমরা মরদেহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে থাকি। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে পুলিশ।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) শৈলেন চাকমা (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) ইনকিলাব কে বলেন, আমরা ওই এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি হায়দার আলীর মরদেহ দাফনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। তবু মরদেহ যদি তারা না নিতে চান তবে আইনগতভাবে প্রয়োজনীয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সুদকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে : হাসনাত আব্দুল্লাহ
১৮ মামলার আসামি আ.লীগ নেতা আজমল গ্রেপ্তার
ছাত্রশিবিরকে গুপ্ত রাজনীতি পরিহার করার আহ্বান জাবির ১০ শিক্ষকের
জাবিতে ছাত্রলীগ নেতাকে বাঁচাতে ছাত্রদল নেতার তদবির, ২ জনকে পুলিশে সোপর্দ
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশের ভিসা
আরও

আরও পড়ুন

ভারতে ১২ মাওবাদীকে হত্যা

ভারতে ১২ মাওবাদীকে হত্যা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবিবার থেকে বন্ধ হতে পারে টিকটক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবিবার থেকে বন্ধ হতে পারে টিকটক

ভারত তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল করতেই মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে : নুরুল হক নুর

ভারত তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল করতেই মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে : নুরুল হক নুর

সুদকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে : হাসনাত আব্দুল্লাহ

সুদকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে : হাসনাত আব্দুল্লাহ

বাড্ডায় পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদককে গুলি

বাড্ডায় পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদককে গুলি

গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দল অভিমত নিতে চিঠি দিচ্ছে সরকার

গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দল অভিমত নিতে চিঠি দিচ্ছে সরকার

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন, কাল মুক্তি ৯৫ ফিলিস্তিনির

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন, কাল মুক্তি ৯৫ ফিলিস্তিনির

১৮ মামলার আসামি আ.লীগ নেতা আজমল গ্রেপ্তার

১৮ মামলার আসামি আ.লীগ নেতা আজমল গ্রেপ্তার

ছাত্রশিবিরকে গুপ্ত রাজনীতি পরিহার করার আহ্বান জাবির ১০ শিক্ষকের

ছাত্রশিবিরকে গুপ্ত রাজনীতি পরিহার করার আহ্বান জাবির ১০ শিক্ষকের

একমাত্র পথ লাল সন্ত্রাস: ঢাবি ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি

একমাত্র পথ লাল সন্ত্রাস: ঢাবি ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি

লাল সন্ত্রাসের ডাক : মেঘমল্লার বসুকে গ্রেফতার দাবিতে ঢাবিতে বিক্ষোভ

লাল সন্ত্রাসের ডাক : মেঘমল্লার বসুকে গ্রেফতার দাবিতে ঢাবিতে বিক্ষোভ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতাকে বাঁচাতে ছাত্রদল নেতার তদবির, ২ জনকে পুলিশে সোপর্দ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতাকে বাঁচাতে ছাত্রদল নেতার তদবির, ২ জনকে পুলিশে সোপর্দ

খুশদীলের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে রংপুরের আটে আট

খুশদীলের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে রংপুরের আটে আট

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশের ভিসা

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশের ভিসা

মেডিকেল কলেজে শিক্ষক বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার

মেডিকেল কলেজে শিক্ষক বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার

ছাত্রদলের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি আজ

ছাত্রদলের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি আজ

গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন

গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ইইউ

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ইইউ

ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান

ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান

সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না, দুই দেশে কলঙ্কিত টিউলিপ

সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না, দুই দেশে কলঙ্কিত টিউলিপ