ইসলাম ধর্ম প্রচারক, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাধক, বঙ্গের বিখ্যাত সুবক্তা, সমাজ সংস্কারক, বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক ছিলেন মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। তিনি সমাজ সংস্কার ও জনকল্যাণকর কাজে জড়িত ছিলেন। আজ ২৬ ডিসেম্বর মুসলিম জাগরণের অগ্রপথিক মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৬৩তম জন্মদিন।
মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ দৌহিত্র কর্নেল (অবঃ) মুন্সী মেহের মহব্বত হোসেন বলেন, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪ টায় প্রাচ্য সংঘ যশোরের ‘মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ জীবন ও কর্ম’ উপরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া জানুয়ারী ৩তারিখে বাদিয়াটোলা গ্রামে ‘মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ প্রাইমারী’ স্কুল প্রাঙ্গনে জন্মজয়ন্তী উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এবং ১৫ জানুয়ারিতে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ হলে জন্মজয়ন্তী পালন করা হবে।
মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম মুন্সী মোহাম্মদ ওয়ারেস উদ্দীন। অল্প বয়সে পিতার অকাল মৃত্যু এবং দারিদ্রতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ হয়নি তার। তিনি পেশায় সামান্য একজন দর্জি ছিলেন। তবে জ্ঞান অন্বেষণে তার প্রবল ইচ্ছা শক্তি ছিলো। মুন্সী মেহেরুল্লাহ শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর গভীর জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানোর অভিপ্রায়ে নিজগৃহ ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি মোসহাব উদ্দীন এবং মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন নামে দুজন শিক্ষকের কাছে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা শিক্ষালাভ করেন।
ছোটবেলা থেকে তার সাহিত্যের প্রতিও ছিলো এক অসামান্য টান। তাই তিনি আরবি- ফারসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও করতে থাকেন। তিনি তার কাব্যের মাধ্যমে অসামান্য প্রতিভার নিদর্শন রেখে গেছেন।
ইংরেজদের শোষণ, দমন-পীড়ন এবং খ্রিষ্টান পাদ্রিদের ইসলাম বিদ্বেষী বক্তৃতা বঙ্গের মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও অতিষ্ঠ করে তোলে। এমন অবস্থা মহামারি ধারণ করে উনিশ শতকের শেষের দিকেও। মানুষ বিভ্রান্ত ও ঈমানহারা হয়ে অনেকেই খ্রিষ্টানদের প্ররোচনায় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। এ সময় মুন্সী মেহেরুল্লাহর একজন সহযোগী মুন্সী জমির উদ্দীনও ধর্মত্যাগ করে নবী ও ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে থাকলে তিনি দেখলেন এমন অবস্থা চলতে থাকলে বাংলায় ইসলাম ধর্ম টিকিয়ে রাখা অসাধ্য হয়ে উঠবে। তিনি তার তেজদীপ্ত কন্ঠে আওয়াজ তোলেন এবং খ্রিষ্টান পাদ্রিদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হাতে কলম তুলে নেন।
তখন মেহেরুল্লাহ সাপ্তাহিক ‘সুধাকর পত্রিকায় ‘ইশায়ী বা খ্রিস্টানী ধোঁকা ভাজন’ শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রবাদ প্রকাশ করে। তারপর ‘আসল কোরান সর্বত্র’ শীর্ষক ভিন্ন রচনায় এই বিতর্কের অবসান ঘটান। খোদ জমিরুদ্দিন রণে ভঙ্গ দিয়ে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন। দু’য়ের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব হয় এবং মেহেরুল্লাহ জমিরুদ্দিনের ইসলাম গ্রহণ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মুন্সী মেহেরুল্লাহকে বলা হয় মুসলমানদের রামমোহন। কেননা রাজা রামমোহন রায় উনিশ শতকের প্রথমে হিন্দু সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তুলে বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করে সমাজ সংস্কারে অবদান রেখেছিলেন। তেমনি উনিশ শতকের শেষের দিকে মুন্সী মেহেরুল্লাহ বিভ্রান্ত দিশেহারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদেরকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুন্সী মেহেরুল্লাহর লিখিত ‘হিন্দুধর্ম রহস্য ও দেবলীলা, বিধবা গঞ্জনা, বিষাদ ভান্ডার, মেহেরুল এসলাম, মুসলমান ও খ্রীষ্ঠান তর্কযুদ্ধ’ বইগুলো সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবে তার হিন্দুধর্ম রহস্য ও দেবলীলা এবং বিধবা গঞ্জনা বইদুটি তৎকালিন সরকার কতৃক বাজেয়াপ্ত হয়। মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ সালে ৭ মে মৃত্যু বরণ করেন।
যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টাউন হল ময়দানকে ‘মেহেরুল্লাহ ময়দান’ এবং তার গ্রামের উপরে স্থাপিত চুড়ামনকাটি রেলওয়ে স্টেশনকে ‘মেহেরুল্লাহ নগর নামকরন করা হয়।