লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে মেঘনার তীর সংরক্ষণ ও বেড়ীবাঁধ প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য ৩২কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্লক তৈরিতে নিম্নমানের পাথর ও বালি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। মেঘনার ভাঙ্গন প্রতিরোধে ৩হাজার ১শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় ২০২২সালের জানুয়ারি মাসে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) উপজেলার মতিরহাট থেকে বয়ারচর (টাংকি) পর্যন্ত প্রায় ৩১কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়।
বালির সংকট দেখিয়ে একাধিকবার কাজ বন্ধ হওয়ার পর ২০২৩সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের সম্পূর্ন নির্মান কাজ। তখনকার সময়ে সম্পন্ন হওয়া ১০শতাংশ কাজও বর্ষায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে পুরোদমে আবার কাজ শুরু করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজের শুরুতেই ব্লক তৈরিতে নিম্নমানের পাথর ও বালি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
উক্ত প্রকল্পের আওতায় ৯৯টি লটে কাজ চলছে বলে জানা যায়। কয়েকটি লটের কাজের সাইটে গিয়ে কোনটিরই দেখা যায়নি নির্মান তথ্যসম্বলিত সাইনবোর্ডও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঈগল কন্সট্রাকশন এর বিরুদ্ধে। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের চররমিজ ইউনিয়নের বিবিরহাট সংলগ্ন হুরিগো তেহমুনি মোড় এবং রঘুনাথপুর এলাকার ১কিলোমিটার অংশে। তিনটি লটে মোট এক কিলোমিটার অংশের ২০ থেকে ৩০জন শ্রমিক কাজ করছে বেশ কয়েকদিন ধরে। স্থানীয়দের অভিযোগ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ব্লক তৈরিতে খুবই নিম্নমানের পাথর ও বালি ব্যবহার করছেন। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ একাধিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানালেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বোধোদয় ঘটেনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিবিরহাট-রামগতি সড়কের হুরিগো পোলের গোড়ায় রাস্তার পাশেই ব্লক তৈরির কাজ করছেন শ্রমিকরা। এতে ব্যবহার করা হচ্ছে মরা ও বালিমিশ্রিত হলুদ রংয়ের পাথর। বালিতে মাটির সংমিশ্রণও রয়েছে। শ্রমিকদের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করলে তারা জানান, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে কাজ করছেন তারা।
জানা যায়, মেঘনা তীর সংরক্ষন বাঁধ প্রকল্পের বেড়ীবাঁধ নির্মানের এ এলাকার তিনটি লটে প্রায় এক কিলোমিটার অংশের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঈগল কন্সট্রাকশন। এ প্রতিষ্ঠানের কাজের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬সালের জুন মাসে। তিনটি লটে প্রায় সাড়ে ৪লক্ষ ব্লক তৈরি করা হবে।
অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ তদারকির অভাবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্বল্প শ্রমিক দিয়ে খুবই ধীর গতিতে কাজ করছেন। এর ফলে নির্ধাতির সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। তাছাড়াও বর্ষায় অতিরিক্ত জোয়ার এবং পানির কারনে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা সম্ভব হবেনা।
চররমিজ ইউনিয়নের হুরিগো তেহমুনি ও রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা আজাদ, সোহেল, সিরাজ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, পানি উন্নয়নের বোর্ডের কর্মকর্তারা মাঝে মধ্যে আসে আবার চলে যায়। এ সুযোগে ঠিকাদাররা নিম্নমানের কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও কাজের গতি খুবই ধীর। এভাবে চলতে থাকলে সামনের বর্ষায়ও আমাদের পানিতে ডুবতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দা ও মাহমুদা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহির উদ্দিন বাবর বলেন, ভালো মানের পাথর ব্যবহার করার কথা থাকলেও এখানে মরা ও রিজেক্ট পাথর এবং নিম্নমানের বালি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা চাই সরকার যেভাবে চায়, সেভাবে সঠিক কাজটি হোক। আলী হোসেন নামের একজন জানান, আমরা ইতিপূর্বে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া কাজও দেখেছি এখন এটাও দেখছি। কাজের মান খুব খারাপ। আমরা ভালো মানের একটি স্থায়ী বেড়ীবাঁধ চাই। এছাড়াও নদী তীর এবং পুরাতন বেড়ীবাঁধ থেকে মাটি নিয়ে নিয়ে নতুন বাঁধে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
প্রকল্প এলাকার একটি চা দোকানে আড্ডারত উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুই কার্য সহকারির নাম বলতে অস্বীকৃতি করলেও তারা জানান, সকাল-সন্ধ্যা দু বেলায়ই পালাক্রমে প্রকল্প কাজের দেখভাল করছেন তারা। পাথরের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, বাল্কহেড থেকে নামাতে গিয়ে মেশিনের পানির স্রোতের কারনে পাথরে বালির পরিমান বেশি দেখায়। এ বিষয়ে আরো কথা হয় উপ-সহকারি প্রকৌশলী/শাখা কর্মকর্তা (রামগতি পানি উন্নয়ন শাখা-১) আ.ম.ম নঈম এর সাথে তিনি জানান, নিম্নমানের পাথর ও পাথরের সাথে উচ্ছিষ্ট কনা ও রাবিশ (কাটিং ব্লক) ব্যবহারের কথা জানতে পেরে আমি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের শাসিয়েছি। তারা এগুলো নির্মানাধীন কাজের পাথরের সাথে এনে রেখেছিল। এখন সরিয়ে ফেলেছে। এখন থেকে দিনে-রাতে সব সময়ই ভালো পাথরে কাজ হবে। এ কাজ নিয়ে কোন অনিয়ম হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঈগল কন্সট্রাকশনের সাইট সুপারভাইজার আলমগীর হোসেন জানান, স্থানীয় কয়েকজনের জমি ও বাড়ির উপর দিয়ে বেড়িবাঁধের প্রকল্প কাজ পড়ায় তারা কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্তি চড়াচ্ছেন। অন্যদিকে ব্লক তৈরিতে মরা পাথর, বালিমিশ্রিত হলুদ পাথর ও কাটিং উচ্ছিষ্ট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান- এগুলো উচ্ছিষ্ট নয়, ব্লকের তৈরির সময় ফর্মা থেকে বাহিরে পড়ে যাওয়া পাথর কনা ছিলো। পরবর্তীতে এগুলো পুনরায় ব্যবহার করা হয়নি। কেবলমাত্র পাশে এনে রাখা হয়েছে। এখন এগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ব্লক তৈরির জন্য আনা পাথরের স্তুপের ভেতরে নিম্নমানের পাথর বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো ব্যবহার করা হবে না। আগামী পনের দিনের মধ্যে আমাদের এলসি পাথর আসবে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী (রামগতি পানি উন্নয়ন উপ-বিভাগ) ইমতিয়াজ মাহমুদ জানান, এ বিষয়ে সঠিক তদারকির জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিম্নমানের পাথর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের পাথর ব্যবহার করার সুযোগ নেই। তারপরেও ঠিকাদাররা সুুযোগ বুঝে কাজের মধ্যে হেরফের করে। আমাদেরকে দু চারটা দিন সময় দেন, আমরা কাজের মান ঠিক করে দেব। প্রয়োজনে আমরা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) টেস্ট করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১জুন মেঘনা তীর সংরক্ষণের জন্য প্রায় ৩২ কিলোমিটার নদীর বাঁধ নির্মানের জন্য ৩হাজার একশ কোটি টাকা প্রকল্পের আওতায় লক্ষ¥ীপুরের রামগতি উপজেলার বড়খেরী থেকে লুধুয়া বাজার এবং কমলনগর উপজেলার কাদির পন্ডিতের হাট থেকে মতিরহাট এলাকা পর্যন্ত মেঘনা নদীর ভাঙ্গন হতে রক্ষাকল্পে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহি কমিটি (একনেক)। এর আগে একই বিষয়ে ২০১৫ সালে প্রায় দুইশ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে ৬কিলোমিটার বেড়ীবাঁধের একটি প্রকল্প বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তদারকিতে বাস্তবায়ন করা হয়।