সুন্দরবন জুড়ে ফের দস্যু আতঙ্ক
১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:০৪ পিএম | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:০৪ পিএম
সুন্দরবন-সংলগ্ন জনপদের অন্য শিশু-কিশোরের মতো শৈশবেই বনে মাছ শিকার শিখেছেন আব্দুল আজিজ। এ পেশার আয়েই সংসার চালিয়ে আসছেন এতদিন। গত কয়েক মাসে তাঁর জীবনের দৃশ্যপট বদলে গেছে। সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামেই পরিবার নিয়ে থাকেন জলিল। শনিবার তিনি বলছিলেন, ‘কষ্ট হলিও দিনমজুরি কইরে খাব, ডাকাতির মাইর খাতি আর বাদায় যাইব না।’
আব্দুল আজিজের মতো শত শত জেলের মধ্যে ভর করেছে ডাকাত-আতঙ্ক। এসব বনদস্যু গত এক মাসে অর্ধশতাধিক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এ সময় টাকা আদায়ের জন্য তারা জিম্মিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। এ কারণে বহু জেলে এখন বনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন।
সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের আড়ুয়া শিবসা এলাকা থেকে ৪ জানুয়ারি দস্যুরা তুলে নিয়ে যায় একই গ্রামের জেলে আবু মুসাকে (৩০)। তারা পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ তথ্য জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাড়িতে লুটিয়ে পড়েন আবু মুসার বাবা আব্দুল জব্বার। অচেতন অবস্থায় তাঁকে নেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। চিকিৎসক জানান, পথেই হৃদরোগে মারা গেছেন জব্বার। গতকাল শনিবার পর্যন্ত বনদস্যুর কবল থেকে মুক্তি পাননি তাঁর ছেলে আবু মুসা।
স্বজনেরা জানিয়েছেন, ২ জানুয়ারি আবু মুসা সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে মাছ ধরতে যান। ৪ জানুয়ারি আড়ুয়া শিবসা থেকে তাঁকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চায় দস্যুরা। এ ঘটনায় ‘মামা-ভাগনে বাহিনি’ নামের একটি বনদস্যু চক্র জড়িত বলে জানিয়েছেন তারা।
বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের রজব আলী ও রিয়াজুল ইসলাম নামের দুই সহোদরসহ পাঁচ জেলে সুন্দরবনে অপহরণের শিকার হন ২৭ ডিসেম্বর। এতে জড়িত রবিউল বাহিনির সদস্যরা মুক্তিপণ হিসেবে দেড় লাখ টাকা দাবি করে। তারা রিয়াজুলকে জিম্মি রেখে রজব আলীসহ অন্যদের ২ জানুয়ারি ছেড়ে দেয়। টাকা জোগাড় না হওয়ায় বনদস্যুদের কবল থেকে রিয়াজুলকে ছাড়াতে পারছেন না স্বজনরা।
শনিবার ওই গ্রামেই কথা হয় মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। ১০ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছেন এ জেলে। বনদস্যুর ভয়ে এখন ভ্যান চালাচ্ছেন তিনি।
মফিজুল বলেন, ‘কয়েক বছর বাদায় ডাকাতের কোনো উৎপাত ছিল না। এখন আবার শুরু হয়েছে। বাদায় ঢুকলি দুই-তিন পার্টির টাকা দিতি হয়। না হলি লোক তুলে নিয়ে নির্যাতন করে। তাদের দাবি মতো টাকা দিতি গেলি জাল-দোড়া বেচলিও সম্ভব হয় না। বাড়ির জাগা-জমিও নেই যে তা বেচে ডাকাতির টাকা দেব। তাই বাধ্য হয়ে ভ্যান চালাতিছি।’
স্বামীর মৃত্যুর পর বনের ওপরই নির্ভরশীল আকলিমা খাতুন। এখন বনদস্যুর ভয়ে সুন্দরবনে যেতে না পারায় সংসার অচল এই নারীর। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে বলে জানালেন আকলিমা।
এক মাসের মধ্যে বনদস্যুর কবল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন গাবুরা গ্রামের বেশ কয়েকজন জেলে। তাদের মধ্যে রজব আলী, ইমামুদ্দীন, মকবুল গাজীসহ অন্তত দশজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিম্মিদশা থেকে মুক্তির জন্য তাদের সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত দস্যুদের দিতে হয়েছে। এই জেলেদের সবারই বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) রয়েছে। তাদের অভিযোগ, দস্যুদের পেছনে ইন্ধন দিচ্ছেন কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ী। তারা সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকার খাল নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ কাজে জড়িত। সুন্দরবনে যাওয়ার আগে এসব মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি সারতে হয় জেলেদের। গোনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বনে ঢুকতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে শত শত জেলে সুন্দরবনে যেতে পারছেন না। এতে তাদের পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন আরও কয়েকটি গ্রামের জেলেরা জানিয়েছেন, এক মাস ধরে সুন্দরবনে ৪টি দস্যু বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করছে। তারা পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর মধ্যে ‘মামা-ভাগনে বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত শরীফ ও মাসুমের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাকোপ উপজেলার আওতাধীন শিবসা এলাকা। মজনু ও রবিউলের বাহিনী কয়রা উপজেলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ফিরে আসা জেলেরা জানিয়েছেন, প্রতিটি বাহিনীতে ১০-১২ জন সদস্য রয়েছে। তাদের সবাই আগ্নেয়াস্ত্রধারী।
শ্যামনগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আকবর হোসেন এ বিষয়ে বলেন, সুন্দরবনে হঠাৎ করে দস্যুতা বেড়ে যাওয়ার মাছ আহরণ কমেছে। জিম্মি হওয়ার ভয়ে জেলেরা বনের খালে ঢুকতে পারছেন না। বনদস্যুদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে সুন্দরবনকেন্দ্রিক ব্যবসায় ধস নামবে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, সুন্দরবনে ফের বনদস্যুদের আনাগোনো বেড়ে যাওয়ায় জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত। অনেকেই সুন্দরবনে যেতে পারছেন না। এক মাসে সুন্দরবনে অন্তত ৫০ জন জেলেকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এ মুহূর্তে বনদস্যুদের নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
এসব তথ্য জেলেদের মাধ্যমে পেয়েছেন সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সব ফরেস্ট স্টেশন ও টহল ফাঁড়িগুলোকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হতে পারে। এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ছাগলনাইয়ায় কোরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলো গায়ে হলুদ
সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে সচেতনতামূলক সভা
শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে খেলাধুলার বিকল্প নেই: এডিসি লুৎফুন নাহার
হাইওয়ে পুলিশের সার্বিক বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য কতটা প্রকট: সাধারণের অবস্থান কোথায়
কোরআন তেলাওয়াত আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি দান করে: কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ
ড. ইউনূসের ৫ মামলা বাতিলের রায়ে আইনি দুর্বলতা পাননি আপিল বিভাগ
শেরপুরে জামায়াতের দিনব্যাপী শিক্ষা শিবির অনুষ্ঠিত
চুয়াডাঙ্গা শহরের জান্নাতুল মাওলা কবরস্থান থেকে হাত-পা মুখ বাঁধা অবস্থায় এক অচেতন সেনা সদস্য উদ্ধার
আফগানিস্তানে এবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তানের
মাওলানা মামুনুল হক আমির জালালুদ্দীন মহাসচিব নির্বাচিত
বসুন্ধরায় ফ্যাশন ব্রান্ড ‘হিজাবিয়ানা’র আউটলেট উদ্বোধন
‘সরকার এতই যোগ্য যে, থানা থেকে ওসি পালিয়ে যায় কিন্তু টেরই পায় না’: মাহমুদুর রহমান মান্না
সাংবাদিকতা হতে হবে পুরো সত্য, আংশিক নয়: কাদের গনি চৌধুরী
জিয়া পরিবারের জন্য বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকে আছে - যুবদল নেতা রেজাউল কবীর পল
বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট
কুষ্টিয়ায় ৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত, আহত-৩
তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
২০২৪ সালে সড়কে নিহত ৭ হাজারের বেশি, দায় নিলেন সড়ক উপদেষ্টা
অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে