ঢাকা   মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২১ কার্তিক ১৪৩১

ই-ক্যাবে ফিরছে ফ্যাসিবাদের দোসররা

Daily Inqilab হাসান সোহেল

০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪১ এএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৫ পিএম

ই-কমার্স খাতের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব। সংগঠনটি আবার ফ্যাসিবাদদের দখলে যাচ্ছে। এতে সহযোগিতা করছে প্রশাসক মুহাম্মদ সাঈদ আলী নিজেই। যদিও তিনি বলেছেন সঠিক তালিকা পেলে ফাসিবাদীদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হবে। গত ৫ আগস্টে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি সহ অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। একইভাবে ই-ক্যাবের পরিচালনা পরিষদের ১১জন সদস্যই পদত্যাগ করেছে এবং সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট শমী কায়সারকে আর প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে ১১ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলীকে ই-ক্যাবের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করেছে অন্তবর্তী সরকার। কিন্তু তিনি জেনেশুনে সেই ফ্যাসিবাদকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন। অভ্যুত্থানের যে চেতনা ধারণ করার কথা তা তিনি হয়তো ভুলে গেছেন বলে অভিযোগ ই-ক্যাবের একাধিক বঞ্চিত উদ্যোক্তাদের। ই-ক্যাবের প্রশাসক হিসেবে বসার পর থেকে সাঈদ আলীর মধ্যে এই সংগঠনের জন্য কিছু একটা করার আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু সেটা ফ্যাসিবাদ হটানো নয়, এখানে যে তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তার কিছু ‘সিগনেচার’ রেখে যেতে চাচ্ছেন। এটা তিনি মুখে স্বীকার করছেন না, কিন্তু তার কাজ দেখে সংগঠনটির সদস্যদের তেমনটাই মনে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। আগামী ৮ নভেম্বর ই-ক্যাবের ১০ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। স্পন্সর জোগাড় করে আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে দিয়ে এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রশাসক সাঈদ আলী। এই স্পন্সর জোগাড় করার নামে ই-ক্যাবের পুরোনো মেম্বারদের একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যারা আওয়ামী লীগ আমলে নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে এসেছে। বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো থাকায় তাদের কথায় স্পন্সর আসছে। এর মধ্যে দিয়ে ওই গ্রুপটি অ্যাসোসিয়েশনে অবস্থান পাকাপোক্ত করার সুযোগ পেয়েছে। এদের কেউ কেউ ই-ক্যাবের আগের প্রেসিডেন্ট শমী কায়সারের নেতৃত্বধীন ‘অগ্রগামী’ প্যানেলের প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় সরাসরি জড়িত ছিল। কেউ কেউ ‘চেঞ্জ মেকারস’ প্যানেলের থেকে ভোট করলেও আসলে দুটি প্যানেলই তাদের নিজেদের বানানো ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ই-ক্যাবের এক সদস্য বলেন, ই-ক্যাবে নেতৃত্ব প্রদান করার মতো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা কখনও ছিল বলে মনে হয়নি। আগে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল, তারাই নিজেদের পছন্দের লোককে নেতা বানিয়ে নির্বাচনের জন্য গড়ে তুলতো। ফলে সকল দলমতের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ই-ক্যাবে ছিলনা বললেই চলে। আরেক সদস্য বলেন, ই-ক্যাবের অতীতের কিছু নেতার আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সরকারি বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতে মনোযোগ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ই-ক্যাবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের থেকে অপ্রতিষ্ঠিত ই-কমার্সের উদ্যোক্তাদের ঝোঁক বেশি ছিল। এই ধারার পরিবর্তন হওয়া দরকার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী সরকার দেশ ছেড়ে পালানোর পর গত ৬ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ই-ক্যাব’র ব্যানারে একটি গ্রুপ ই-ক্যাবের কার্যালয়ে যায়। এর পর থেকে ওই গ্রুপটি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও আগের প্রভাবশালী সদস্যদের সঙ্গেই হাত মেলাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, ই-ক্যাবের বর্ষপূর্তির আয়োজন করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসরদের তারা ই-ক্যাবে ডেকে নিয়ে এসেছেন অনুষ্ঠানের স্পন্সর করার জন্য। এর বিনিময়ে তারা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ গত ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের কমিটি গঠনের জন্য সভায় উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী অনেককেই কমিটিতে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর গত ২৭ অক্টোবর আবার একটি মিটিং হয়, সেখানে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটির নাম চূড়ান্ত করা হয়। সেই কমিটিতে এমন অন্তত তিনজনের ফেইসবুক প্রোফাইলে গিয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষে প্রচারণা চালাানোর প্রমাণ মেলে। একাধিক সদস্য অগ্রগামী প্যানেলের পক্ষে গত ২৭ জুলাইয়ের ই-ক্যাব নির্বাচনে ভোট চেয়ে প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন। এরাই এখন ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের নামে এই সংগঠনকে নিজেদের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে ১০-১২ লাখ টাকা স্পন্সর জোগাড় করে আগামী ৯ নভেম্বর ধানমন্ডীর বিজিবি ব্যাংকোয়েট হলে (সীমান্ত সম্ভার) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এই কমিটি। কিন্তু দেশের এমন অস্থির সময়ে এ ধরনের আনন্দ ফুর্তির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যেতে রাজি হননি। আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে চান না বলে জানিয়েছেন। এর পরও এই অনুষ্ঠান করার জন্য প্রশাসক মরিয়া হয়ে ওঠায় এ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। তিনি কী পুরোনো ফ্যাসিবাদীদের জায়গা করে দিচ্ছেন। তাছাড়া ই-ক্যাব সেক্রেটারিয়েটের কিছু কর্মচারির পরামর্শে প্রশাসক একটি মেম্বার ডিরেক্টরি বের করতে রাজি হয়েছেন। ওই ডিরেক্টরিতে প্রশাসকের নাম থাকবে, একটি সুভ্যেনির হিসেবে থেকে যাবে। সেখানে বিজ্ঞাপন নিয়ে ৫ লাখ টাকা খরচ করে এই ডিরেক্টরি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই বিজ্ঞাপন দেওয়ার নাম করে কিছু ফ্যাসিবাদদের আবার ই-ক্যাবে আসার সুযোগ হবে বলে মনে করছেন এর সদস্যরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, বর্তমান যুগে যেখানে ই-ক্যাবের সকল সদস্যদের নাম, ইমেইল, ফোন, কোম্পানির নাম ই-ক্যাবের ওয়েবসাইটে থাকে, তাছাড়া ইয়োলো বুক নামের একটি ওয়েবসাইটেও প্রায় সব ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেওয়া থাকে, সেখানে হার্ডকপি ডিরেক্টরির কোনো দরকার নেই। সর্বোচ্চ একটি সফটকপি বা পিডিএফ ভার্সন থাকতে পারে। সাধারন সদস্যদের অনেকেরই আশঙ্কা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটির হাত ধরে ধীরে ধীরে ই-ক্যাবে পুরোনো নেতৃত্ব চলে আসবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায, ই-ক্যাবের সদস্যদের মধ্যে জিসান কিংশুক হক, বিপ্লব রাহুল ঘোষ, আবু সুফিয়ান নীলভ, অন্তু করিম, খালিদ সাইফুল্লাহ, কাঞ্জন নাহার শান্তাসহ অনেকেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটিতে আছে। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ আমলে ই-ক্যাবের বিভিন্ন কর্মকা-ে সক্রিয়া ছিল। তাছাড়া ছাত্র-আন্দোলনের সময় এবং অভুত্থ্যানপরবর্তী সময়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা কৌশলী পোস্ট দিয়েছে। এর মধ্যে জিসান কিংশুক হক একজন। তিনি ছাত্র আন্দোলনের সময় রেমিট্যান্স শার্টডাউনের বিপক্ষে পোস্ট দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ওফা সিজিবির পাবলিসিটি সেক্রেটারির পদেও রয়েছেন। যা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের নেতৃত্বে চলছিল এতদিন। এছাড়া খালিদ সাইফুল্লাহ ও কাঞ্জন নাহার শান্তা শমী কায়সারের নেতৃত্বাধীন ‘অগ্রগামী’ প্যানেলের প্রার্থীদের প্রচারণায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এর প্রমাণ ইনকিলাবের হাতে রয়েছে। এছাড়া ই-ক্যাবের বিক্ষুব্ধ সদস্যদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটিতে থাকা আবু সুফিয়ান নীলভ, ফারুক হোসেন, বিপ্লব রাহুল ঘোষ, কাঞ্জন নাহার শান্তা জোটবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগ আমলেও বেসিস এবং ই-ক্যাবে সক্রিয় ছিল। অভুত্থ্যানপরবর্তী সময়েও তাদের জোটবদ্ধ ভূমিকা ই-ক্যাবে নতুন নেতৃত্বের পথ সংকূচিত করবে। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব ও ই-ক্যাবের প্রশাসক মুহাম্মদ সাঈদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, চেষ্টা করছি আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী দোসরদের বাদ দেওয়ার। সঠিক তালিকা পেলেই বাদ দেওয়া হবে।


বিভাগ : ব্যবসা-বাণিজ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মেসিকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের

মেসিকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে তৈরি আছি: হাছান মাহমুদ

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে তৈরি আছি: হাছান মাহমুদ

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে দলের কোনো নেতা-কর্মীকে ছাড় দেওয়া হবে না : যুবদল সভাপতি

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে দলের কোনো নেতা-কর্মীকে ছাড় দেওয়া হবে না : যুবদল সভাপতি

ঢাকা মেডিকেলের সিসিইউতে ভর্তি শাজাহান খান

ঢাকা মেডিকেলের সিসিইউতে ভর্তি শাজাহান খান

আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত

আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন কাল

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন কাল

ব্র্যাক ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার রিটেইল ডিপোজিট মাইলফলক

ব্র্যাক ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার রিটেইল ডিপোজিট মাইলফলক

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় জোর দিতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শ

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় জোর দিতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শ

ব্রাহ্মণপাড়ায় জেলেকে পিটিয়ে হত্যা

ব্রাহ্মণপাড়ায় জেলেকে পিটিয়ে হত্যা

কুয়াকাটায় দুই নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

কুয়াকাটায় দুই নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

কলারোয়ায় হাজার হাজার ছাগলের মৃত্যু

কলারোয়ায় হাজার হাজার ছাগলের মৃত্যু

হত্যা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর প্রতিবাদ

হত্যা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর প্রতিবাদ

শিয়ালের কামড়ে নারী ও শিশুসহ আহত ৯

শিয়ালের কামড়ে নারী ও শিশুসহ আহত ৯

লোহাগাড়ায় ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

লোহাগাড়ায় ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

বন্দরগুলোর অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

বন্দরগুলোর অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

পঞ্চগড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান

পঞ্চগড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান

ধামরাইয়ে পুলিশ ক্যাম্পে ঝুলছে তালা

ধামরাইয়ে পুলিশ ক্যাম্পে ঝুলছে তালা

ভোগান্তির আরেক নাম আশাশুনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ভোগান্তির আরেক নাম আশাশুনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

যশোরে বিএনপি নেতার আদালতে আত্মসমর্পণ

যশোরে বিএনপি নেতার আদালতে আত্মসমর্পণ

যশোর শহরজুড়ে রাস্তার পাশে ময়লার ভাগাড়

যশোর শহরজুড়ে রাস্তার পাশে ময়লার ভাগাড়