রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এমডি নিয়োগ নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র
২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ করতে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুমোদনকে বিতর্কিত করার পায়তারা করছে চক্রটি। অভিযোগ উঠেছে, এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নানা উপায়ে এমডি নিয়োগের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের পছন্দের লোকদের বসানোর চেষ্টা করছেন তারা। এই প্রচেষ্টায় যুক্ত আছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, আমলা ও ব্যাংক কর্মকর্তা- অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য। একমাসের বেশি সময় অপেক্ষার পর গত ২১ অক্টোবর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পায় ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ব্যাংকগুলোর এমডিদের চুক্তি বাতিল করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে এমডিশূন্য হয়ে পড়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক। শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পাশাপাশি কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থ-সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এই কমিটিতে রয়েছেন। ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের পর এমডি পদের জন্য ছয়জনের নাম প্রস্তাব করে এই কমিটি। এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রস্তাবিত এমডিদের নাম সহ সার-সংক্ষেপ পাঠায়। ওই সার-সংক্ষেপে ২০ অক্টোবর অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিতর্ক তৈরি করে এমডিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে একটা অসাধু চক্র। এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য নিজেদের পছন্দের লোকদের এমডি বানানো, এমন তথ্যই মিলেছে অনুসন্ধানে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিগত সরকারের সময়কার এই সিন্ডিকেটটি চাচ্ছিল নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের এমডি বানাতে। এজন্য তারা কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকারকে এমডি পদে বসাতে তদবির শুরু করেছিল। তারা যাদের জন্য তদবির করেছিল দেখা গেছে এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীর আস্থা-ভাজন হিসেবে চিহ্নিত। এদেরকে বাদ দিয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের বেছে নেওয়া হয়। নিজেদের লোক এমডি পদে না আসায় নিয়োগ প্রক্রিয়া বিতর্কিত করতে বিভিন্ন উপায়ে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে এই সিন্ডিকেট। এদের সঙ্গে কিছু বিতর্কিত ব্যবসায়ীও যুক্ত রয়েছেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এই কর্মকর্তার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে সা¤প্রতীক কিছু ঘটনা বিশ্লেষণে। ২১ অক্টোবর ৫টি ব্যাংকের এমডি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হলেও আটকে দেওয়া হয় রূপালী ব্যাংকের এমডির নিয়োগ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, রূপালী ব্যাংকের এমডি পদের জন্য প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পাওয়া মো. আব্দুর রহিম কবিতা লিখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে। তাই তার নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হয়নি। আব্দুর রহিম বর্তমানে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে উল্লেখিত দুইটি কবিতা ‘নিঃশেষে সৃষ্টি’ ও ‘বৃক্ষের শিক্ষা’ পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়া হয়। এই কবিতায় শেখ হাসিনা কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের কথা সরাসরি কিংবা রূপক অর্থেও পাওয়া যায়নি। একটি কবিতা গাছ নিয়ে লেখা, অন্যটি সময় নিয়ে লিখেছেন এই ব্যাংক কর্মকর্তা। কিন্তু কবিতা দুটি ‘মাসিক জনপ্রশাসন’ নামের যে সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে সেখানকার পৃষ্ঠা-সজ্জায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির অলঙ্করণ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাসিক জনপ্রশাসনের সম্পাদক ও প্রকাশক নঈম মাশরেকী বলেন, আসলে কবিতা দুটি না পড়েই মানুষ বিতর্ক করছে। আমার ম্যাগাজিনে মো. আ. রহিমের যে কবিতা ছাপা হয়েছে সেখানে বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার কোন প্রসঙ্গ নেই। আমার ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার জন্য আগেই তার কাছ থেকে কবিতা নিয়ে রেখেছিলাম। সামনে আগস্ট মাস আসলে আমরা আগস্ট সংখ্যায় কবিতা দুটি প্রকাশ করি। আর আগস্ট সংখ্যা হওয়ায় কবিতার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক না হলেও ভুলবশত বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে পৃষ্ঠা-সজ্জা করা হয়। এই কবিতা বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখাতও দূরে থাক, আগস্ট সংখ্যার জন্যও কবিতা দুটি আমাকে দেননি আ. রহিম। তিনি নিয়মিত কবিতা লিখেন আমি জানতাম। তাই তার কাছ থেকে আমি নিজেই কবিতা চেয়ে নিয়েছিলাম। প্রকাশিত কবিতায় অপ্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠাসজ্জার কারণে এমডি নিয়োগ আটকে যেতে পারে কি না- জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, এর কোনও যৌক্তিকতা নেই। কারণ কী লিখবে সেটার নিয়ন্ত্রণ থাকে লেখকের হাতে। কিন্তু লেখাটা কিভাবে ছাপা হবে সেটির নিয়ন্ত্রণ থাকে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র বা সাময়িকীর কর্তৃপক্ষের হাতে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসিক ও রাকাবের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অনেক খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে চাপ প্রয়োগ করে ব্যাংকের টাকা আদায় করেছেন আ. রহিম। এতে চলতি বছরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুনাফার মুখ দেখেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হওয়ায় কিছু ব্যবসায়ী আ. রহিমের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। পাশাপাশি দুটি ব্যাংকেই তিনি ব্যায় সংকোচন করায় অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা ও পরিচালকরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কিছু কর্মকর্তার করা তদবিরও ডিএমডি থাকাকালে তিনি রাখেন নি। এতে আমলারাও ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন আ. রহিমের ওপর। এরা সবাই এখন আ. রহিমকে এমডি হওয়া থেকে ঠেকাতে একাট্টা হয়েছেন। গত ২১ অক্টোবর এমডি পদে নিয়োগ পেয়েছেন এমন একজন ব্যাংকার আ. রহিম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, গত ২৬ বছর আ. রহিমের সাথে একত্রে চাকরি করেছি। এ সময় তার মধ্যে ন্যূনতম অসততা দেখিনি। এমনকি কখনো রাজনীতির প্রতিও আগ্রহ দেখিনি। নিজের পেশাগত কাজ আর লেখালেখিতেই সবসময় মনোযোগী দেখেছি তাকে। এমডি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন আটকে যাওয়া প্রসঙ্গে মো. আব্দুর রহিম বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। তবে এমডি নিয়োগের বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত দিবে সেটাই মেনে নিবেন বলে জানান তিনি।
এদিকে সোনালী ব্যাংকের নবনিযুক্ত এমডিকে নিয়েও ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা চলছে। এখানে নিয়োগ পেয়েছেন কৃষি ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. শওকত আলী খান। ২১ তারিখের প্রজ্ঞাপনের পর সোনালী ব্যাংকের পরিষদ শওকত আলীকে নিয়োগ দিয়েছে। এদিকে শওকত আলীকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে গুজবের ডালপালা ছড়ানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টে তার বিষয়ে বলা হচ্ছে, তিনি টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। কিন্তু এই অভিযোগের কোনও সত্যতা মেলেনি অনুসন্ধানে। টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শওকত আলী খান নামে আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা কেউ নাই। তবে শওকত শিকদার নামে একজন আছেন যিনি সখিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিতেও শওকত শিকদারের নাম রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, শওকত আলী খান ও শওকত শিকদারের বাড়ি একই উপজেলায় হওয়ায় ভুলবশত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত-ভাবে তাকে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। শওকত আলী খানকে আওয়ামী ট্যাগ লাগিয়ে প্রচারের বিরোধীতা করেছেন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী। কাজী জহিরুল ইসলাম নামে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা লিখেছেন, শওকত আলী খান আপাদমস্তক একজন নির্দলীয়, সৎ ও নির্লোভ ব্যক্তি। তাকে একটি দলের লোক বলে চালানো ষড়যন্ত্র। জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, শওকত আলী খান একজন গুণী ব্যাংকার। আমার বাড়িও তার এলাকায়। তাই আমি স্পষ্টভাবেই জানি, ওনার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। শওকত শিকদার নামে একজন আওয়ামী লীগ নেতার নামের সাথে মিল থাকার সুযোগ নিয়ে শওকত আলী খানের নামে রাজনৈতিক পরিচয় জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে রূপালী ব্যাংকের ২০১৯ সালের বঙ্গবন্ধু পরিষদের ৩১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদে শওকত আলীর নাম থাকার কথা প্রচার করে তার নিয়োগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে শওকত আলী খান বলেন, আমি কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করিনি। কেউ যদি আমাকে না জানিয়ে কোনো উপদেষ্টা কমিটিতে নাম অন্তর্ভূক্ত করে, সেই দায়তো আমার না। দেখার বিষয় হচ্ছে, আমি নিজে ফরম পূরণ করে কোনও সংগঠনের সদস্য হয়েছি কি না। এমন কোনও ঘটনা কখনও ঘটেনি। এমডি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে অর্থ-সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
বিভাগ : অর্থনীতি
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গাজীপুরের শ্রীপুরে কারখানার গুদামে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট
খুবির উৎকর্ষ সাধনে পাশে থাকবে ইরান
বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নাম বদলে হলো ‘যমুনা রেলসেতু’
মানিকগঞ্জ-২ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের দাবি হরিরামপুর-শিবালয়বাসীর
গোয়ালন্দে সুইট হাট জাতের মিষ্টি কুমড়া চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের
হঠাৎ কেন দোয়া চাইলেন অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া!
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে ফেলছে : শিক্ষা উপদেষ্টা
এবার ৯৭ বলে অপরাজিত ২০১ রিজভির
উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুতে সোমবার রাষ্ট্রীয় শোক
বাংলাদেশী রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত, সমালোচনার ঝড়
ফ্রান্সের নতুন প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরুকে নিয়ে জনগণের অসন্তোষ
ইসরায়েলে হামলার জবাবে এবার ইয়েমেনে বিমান হামলা চালাল যুক্তরাষ্ট্র
কাপ্তাই লেকে জেগে ওঠা ভাসামান তীরে সবুজ ফসলের সমারোহ
বেনাপোলে ভারতগামী পাসপোর্ট যাত্রীর টাকা ছিনতাই, ৩ দালাল আটক
ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করলেন বিএসএমএমইউয়ের চিকিৎসকরা
বাধা না থাকলেও গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদকে মানুষ নির্বাচনে আসতে দেবে না : আখতার হোসেন
সালথায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চলছে ডাকাতির নাটক, বিব্রত পুলিশ!
শিল্পকলায় শুরু হয়েছে মাসব্যাপী ভাস্কর্য প্রদর্শনী
এনআইডির তথ্য বেহাত, কম্পিউটার কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলো ইসি
সোনারগাঁও বুরুমদী উচ্চ বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী উদযাপন