পাট ও পাটপণ্যের গুরুত্ব
০৬ মে ২০২৩, ০৮:০২ পিএম | আপডেট: ০৭ মে ২০২৩, ১২:০৩ এএম
প্রতি বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ) উদ্বোধনকালে একটি পণ্যখাতকে ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়ে থাকে। ইতোপূর্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, কৃষি ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং তথ্য প্রযুক্তি সেবা খাতকে যথাক্রমে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২২ সালের জন্য বর্ষপণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বর্ষপণ্য ঘোষণার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা সেক্টরের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা। এর উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে পণ্যটি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এবং টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। ডিআইটিএফ-এর ২৭তম সংস্করণের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সোনালি আঁশকে কৃষিপণ্য হিসেবে গণ্য করে বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত হয়। এভাবেই উন্নয়ন ও বৈচিত্র্যায়নের জন্য পাটপণ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে নেতৃস্থানীয় পাটকলের মালিকানা মূলত বাওয়ানী, আদমজী, ইস্পাহানি ও দাউদ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন সরকারি পর্যায়ে অনেক ছোট ছোট ইউনিটও ছিল। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে সরকার এসব পাটকল সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে দেশে অন্তত ২২০টি বেসরকারি পাটকল চালু রয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশের বাজারে রপ্তানি করার জন্য অনেক কোম্পানি পাটজাত পণ্য তৈরি করছে।
আমাদের স্কুল জীবনে শিক্ষকগণ বাংলাদেশের সোনালি আঁশের উপর অনুচ্ছেদ বা প্রবন্ধ লিখতে বলতেন। পরীক্ষার জন্য তা মুখস্থও করতে হতো। রপ্তানির বিপরীতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হিসাবে বিবেচিত হতো পাট। অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি শিক্ষামূলক গুরুত্বও ছিল বিধায় পাট পণ্যকে সুন্দর একটি নাম ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ মূল্যবান পণ্যটির রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। সারাবিশ্বে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে প্লাস্টিকের উত্থান পাটজাত পণ্যের অবস্থানকে ম্লান করে চলেছে। এই ধারা চলতে থাকলে আমরা স্বাস্থ্য, পরিবেশ বিপর্যয়সহ রপ্তানিতে দুর্বল টার্নওভার থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারব না।
পাটের সবকিছুই কোন না কোনভাবে ব্যবহার উপযোগী। পাট পাতা, ছাল ও পাট কাঠি এতটাই প্রয়োজনীয় যে গ্রামাঞ্চলে তা কারোর অজানা নয়। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ হতে পাট থেকে উৎপাদিত পণ্যের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ। পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজারের আকার ২০২২ সালে ২.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ১৪.৩% বার্ষিক চক্রবৃদ্ধির হারে ২.৫৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে মর্মে এক বাজার পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। করোনা মহামারির পর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবুও পাটজাত ব্যাগের বাজারের আকার ২০২৭ সালে ১০.৪% হারে বেড়ে ৩.৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে (ঔঁঃব নধমং এষড়নধষ গধৎশবঃ জবঢ়ড়ৎঃ-২০২৩)। বাংলাদেশের জিডিপিতে পাট শিল্পের অবদান ১% এবং সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে এর অবদান ৩%।
আমাদের দেশে সাদা পাট এবং তোষা পাট (গাঢ় রঙের) উভয় ধরনের পাটই জন্মে। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রথম অবস্থানে রয়েছে (২০২২)। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ পর্যন্ত যথাক্রমে ৯৫, ১০৮, ১৪৬, ১৩৩, ৭২, ৫৯, ৩১০ হাজার মেট্রিক টন পাট উৎপাদিত হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমঘন হওয়ায় এ খাতে উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনে কর্মসংস্থানের পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশ পাট থেকে ২৮৫টি পণ্য উৎপাদন করে এবং সেগুলো বিশ্ববাজারে রপ্তানি করছে। প্রধান প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা পাট, পাটের হেসিয়ান, ব্যাগ, বস্তা, দড়ি, জুট টুয়াইন, জুট ইয়ার্ন, কার্পেট, ক্যাপ, ম্যাট, কার্পেটের ব্যাকিং কাপড়, প্যাকিং সামগ্রী, মোড়কীকরণ কাপড়, ট্যাপেস্ট্রি, ফলের ঝুড়ি, ওয়ালেট, কলমদানি, মানিব্যাগ, পর্দা, চেয়ারের আচ্ছাদন, পাটের চাদর, পাটের সুতার বর্জ্য, তারপলিন, ক্যানভাস, হাইড্রোকার্বন মুক্ত পাটের কাপড়, জিওটেক্সটাইল, পাল্প ও কাগজ, গৃহস্থালী পণ্য এবং নন-ওভেন টেক্সটাইল ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলে পাট কাঠি জ্বালানির একটি বড় উৎস। পাট পাতা থেকে তৈরি স্বাস্থ্যকর পানীয় এখন একটি রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্য, যার উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে এ পানীয় কার্যকর মর্মে ইতোমধ্যেই পাথমিকভাবে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে পাট দিয়ে শাড়ি, শার্ট, পাঞ্জাবি, জুতা, স্যান্ডেল, ব্রিফকেস, ফাইল, ফোল্ডার, ডায়েরি ইত্যাদিও তৈরি হচ্ছে।
পাটজাত যে কোনো দ্রব্য এর ব্যবহারকারীকে দেয় প্রকৃতির ছোঁয়া। প্রকৃতিকে ভালবাসার অনুভূতি জাগায়। কচি চারাগুলো অত্যন্ত কোমল এবং সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। স্বাদ ও ঔষধি গুণ বিবেচনায় এ সব্জিটি বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। পাটের ব্যাগ এবং দড়ি খুব শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী পণ্য। পচনশীলতা ও জীবাণুবিয়োজ্যতা গুণসমৃদ্ধ হবার কারণে পাট মৃত্তিকা-বান্ধব এবং পাটজাত পণ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য। পাট গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এদের অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হয় না। পাটের তৈরি ফ্যাশনেবল পণ্য মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। পাট চাষের মৌসুমে এক হেক্টর জমির পাট ১১ টন পর্যন্ত অক্সিজেন নির্গত করে বায়ুকে বিশুদ্ধ করে। এটি মাটির গুণমান উন্নত করে এবং কীটপতঙ্গ ও রোগের ঝুঁকি কমায়। পাট চাষে খুব বেশি সার, ভেষজনাশক ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। ভবিষ্যতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, অধিক ও উন্নত উৎপাদনের জন্য শুধুমাত্র শস্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সুপারিশ করা হয়ে থাকে। পাট দিয়ে তৈরি চমৎকার স্যুভেনির দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়।
এবার দেখা যাক, কেন প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় করা উচিত। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর প্লাস্টিকজাত ব্যাগ তিমি, ডলফিন, কচ্ছপ এবং পেঙ্গুইনসহ প্রায় ১ লক্ষ জলজ প্রাণীকে হত্যা করছে। ভুলবশত তারা খাবার হিসেবে প্লাস্টিকের ব্যাগ গিলে ফেলে। প্লাস্টিকের ব্যাগ বায়োডিগ্রেডেবল নয়। এটা সম্পূর্ণভাবে পচতে ২ হাজার বছর সময় লাগতে পারে মর্মে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। এর অর্থ হলো আমাদের পরবর্তী ২০ প্রজন্মের জীবদ্দশায়ও কোন প্লাস্টিক পণ্যকে পচতে দেখা যাবে না। (চলবে)
লেখক: পরিচালক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈততা কাম্য নয়
সচিবালয়ে আগুন সন্দেহজনক
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি পরিকল্পিত নাশকতা: ইসলামী আইনজীবী পরিষদ
আশিয়ান সিটির স্টলে বুকিং দিলেই মিলছে ল্যাপটপ
‘প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ও সম্পদ দখল করে পতিত সরকারের শিল্পমন্ত্রীর কন্যা’
পরকীয়া প্রেমের ঘটনায় গৌরনদীতে উপ-সহকারী ২ কৃষি কর্মকর্তা এলাকাবাসীর হাতে আটক
সচিবালয়ে আগুন: গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করলো এবি পার্টি
বিএনপি মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী: শাহজাহান চৌধুরী
টিভিতে দেখুন
কোহলির ধাক্কা সামলে কনস্টাস বীরত্ব
বিজয় দিবসের খেলা
ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৫৩