ধূমপান বিষপান
৩০ মে ২০২৩, ০৮:১০ পিএম | আপডেট: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম
Health Survey of England-এ প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ায় ব্রিটেনে এক বছরে হার্ট অ্যাটাকের হার শতকরা ১০ শতাংশ কমে গেছে। স্কটল্যান্ডে কমেছে ১৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, ধূমপায়ীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের হার কমেছে ১৯ শতাংশ হারে আর অধূমপায়ীদের মধ্যে ২১ শতাংশ হারে। সে দেশের সরকার চাইছে প্রাইভেট কারেও ধূমপান নিষিদ্ধ করতে। অন্যদিকে বাড়িতে বাচ্চাদের সামনে বাবা-মায়েরা যেন ধূমপান না করে, সে প্রচারও তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা চলছে। থাইল্যান্ডে যেদিন তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হয়, সেদিন রাজধানীতে জমায়েত হয়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। গেয়ে উঠেছিলেন তামাক বিরোধী গান। সমাবেশের অদূরে, উচুঁতে রাখা হয়েছিল একটা ঘড়ি, তাকালেই জানা যাচ্ছিল প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে তামাকজাত নেশার মাধ্যমে আমদানি করা রোগের পরিণতিতে।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল সিডিসি-তে বলা হয়েছে, ধূমপায়ী শুধু নিজের ক্ষতি করে না, আশেপাশে যারা থাকে, তাদের মধ্যেও বিষ-প্রভাব ফেলে ধূমপান। এ রকম কোনো পরিবেশে যদি ৩০ মিনিট কাটায় কোনো অধূমপায়ী, তারও হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা ব্যাপক। সে হৃদয়াঘাত ভয়ংকর চরিত্রেরও হতে পারে। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি জারি করা হয়েছে, যে সব অফিস-আদালতে মানুষের ভিড় হয়, হৃদরোগের আক্রমণ তথা হৃদয়াঘাতে মৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে সে সব জায়গায় আর ধূমপান নয়। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল পরিসংখ্যান পেশ করে জানিয়েছে, সিগারেট নিষিদ্ধ করার পর হেলেনা, মোনটানায় হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা নিচের দিকে নামতে থাকে। দেয়াল, ছাদঘেরা পরিবেশে অর্থাৎ অফিস-আদালতে চত্বরে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক ফল মিলতে শুরু করে। হেলেনা হসপিটালের নথি বলছে, হার্ট অ্যাটাকের হার ৪০ শতাংশ কমে যায় ৬ মাসেই।
ধূমপান এবং স্বাস্থ্য-বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ, তাদের আর্জি, পরিবারে শোকের অন্ধকার যদি সত্যি সত্যিই ডেকে আনতে চান অবশ্যই হাতের সিগারেট বা বিড়িটা ধরান, এরপর আরো একটা। তারপর আরো। তারপর একদিন দেখলেন, তার আর পর নেই! নিকোটিনেরই কাজ কারবার সব। নিকোটিন পেতেই ব্রেন আপ্লুত হয়, ভাবে পুরস্কার পাওয়া গেছে। ব্যস, চলতে থাকে।
সিগারেট তথা ধূমপানের জন্য সিগারেট কতটা দায়ী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার চেরিয়ান বার্গিজ একবার কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, ‘৪০০ ভারতীয় চলচিত্রের উপর সমীক্ষা চালালাম। দেখলাম ৩০০ সিনেমাতেই নায়কের মুখে সিগারেট। জনমনে ধূমপানের প্রভাব বিস্তারে নায়করা যেভাবে যুক্ত, তাতে সে নায়কদের মুখ দিয়ে বলিয়েই সিগারেট ছড়ানো যাবে, এ ধারণা পুরোপুরি ভুল।’ ভার্গিজ জানাতে ভুলেননি খলনায়কের মুখে সিগারেটের দেখা মেলে কম সিনেমাতেই। অতএব, ভিলেনদের এক্ষেত্রে অন্তত কোনোভাবেই ভিলেন প্রতিপন্ন করা যাবে না। আমাদের দরিদ্র-পীড়িত বাংলাদেশেও একই অবস্থা। সিনেমা নাটকের প্রায় নায়কের বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখা যায়।
ধূমপানই নন্দ ঘোষ, মোটেও না। একা ধূমপানকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যিনি নস্য নিচ্ছে, সে খৈনি টিপে মাড়ির নিচের দিকে গুঁজছে-রেহাই নেই তাদেরও। মরণ ডাকছে। আমন্ত্রণলিপির বয়ান তৈরি। যারা গুটখা, পানপরাগ মুখে ফেলে ভাবছে, ভারি তো আর একটা প্যাকেট জিভে ঢাললাম, তাতে এমন আর কী ক্ষতি? ক্ষতি সামান্যই; সিগারেট, বিড়িতে থাকে ৪৩ থেকে ৪৫ রকমের ক্যানসার সৃষ্টির উপাদান। ক্যানসার হবে জানলে সেই মাছ বা মাংস কেউ খাবে? খান? কোনো সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেটা করে? ডুবে মরতে পারে আশঙ্কায় যে মানুষ পানিতে পর্যন্ত নামে না, সে মানুষও হিরোর মতো সিগারেট ফোঁকে। নস্য এবং খৈনির মধ্যে দ্রুত ক্যানসার কোষ ক্ষমতা রয়েছে যার, সে হলো নাইট্রোস অ্যামাইন। একে টোব্যাকো স্পেসিফিক নাইট্রোস অ্যামাইন বলে। বলার কারণ, তামাকে সুনির্দিষ্ট অনুপাতে এ কারসিনোজেনটি থাকবেই। কারসিনোজেনের ক্যানসার কোষ তৈরির তৎপরতা জানার পর থেকেই মশলার প্যাকেটসহ ঝকঝকে মোড়কে যেসব নুডলস্ বিক্রি হয় সে সব খেতে নিষেধ করছে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা। কারণ নুডলসের টক-ঝাল নুন এ মশলায় কারসিনোজেন থাকে।
ধূমহীন তামাক সেবনে মুখের ক্যানসারই হয় বেশি। মুখগহ্বরে, মাড়িতে, জিভে, গালে, মুখের উপরে, মুখের ত্বকের নিচেও। ধূমহীন তামাকজাত পণ্যে ক্যানসার উপহার দেওয়ার মতো আরো যা যা উপাদান থাকে, তার কয়েকটির নাম এরকম-এন নাইট্রোস অ্যামাইনো অ্যাসিড, ভোলাটাল তথা উদ্বায়ী, নাইট্রোস অ্যামাইন, বেনজোপাইরিন, ভোলাটাইল অ্যালডিহাইড, ফবমালডিহাইড, অ্যাসিটারডিহাইড, ক্রোটোনালডিহাইড, হাইড্রোজেন, আর্সেনিক, নিকেল. ক্যাডনিয়াম এবং পোলানিয়াম-২১০।
একটা সিগারেটে যতটা নিকোটিন মেলে, প্রতি দফায় ধূমহীন তাম্বাকু সেবনে মেলে তার ৩ থেকে ৪ গুণ। অতএব, শুধু খৈনি নয়, তামাকজাত যা কিছু এখনো গ্রহণ করা হচ্ছে সে সব ফেলে অবিলম্বে গরম পানিতে মুখটা কুলকুচো করে নিতে হবে। নস্যর রুমালটায় আগুন, কৌটাটা নর্দমায় ফেলতে হবে। দ্রুতগামী ট্রেন আসছে টের পেয়ে শেষ মুহুর্তেও লাইন থেকে জীবন নিয়ে উঠে আসতে পারে মানুষ, বন্যায় ভেসে যাওয়ার আগে গাছ বা খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করে মানুষ। ক্যানসার হলে কোনভাবেই বাঁচার উপায় নেই জেনেও আপনি সিগারেট, বিড়ি, পানমশলা, নৈস্য, খৈনি, জর্দাকে ব্যবহার করে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়তে চাইবে না।
বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কত? ১ কোটির উপরে হবে নিশ্চয়ই। অনুমানে বলা যায় ৮০ লক্ষ পুরুষ, ২০ লক্ষ মহিলা। ধূমপানের কারণে স্ত্রীর কাছে ‘অক্ষম’ প্রতিপন্ন হতে পারে ধূমপায়ী। সাফ কথা, যৌন আহ্লাদের তীব্রতা হনন করে ধূমপান। শরীরী সংখ্যার ‘উত্তেজনা’ নিয়ে, আকুতিটাকে মেরে ফেলে ধীরে ধীরে। পুরুষ, মহিলা উভয় ক্ষেত্রেই এ ‘অনুভূতি’ হনন প্রক্রিয়া চালায় তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন। যারা দিনে কুড়িটির বেশি সিগারেট খায়, আপাত দৃষ্টিতে কেউ কেউ তাদের ‘হিরো’ মানলেও শরীরী সখ্যের সময় এদের আবাহনের অনুভূতিটাই জিরো হয়ে যায়। যারা ধূমপান করে না, তাদের কারো কারো মধ্যে যে এ ধরনের ‘অক্ষমতা’ তৈরি হয় নাÑ এমন নয়। কিন্তু ধূমপায়ীদের মধ্যে এ অক্ষমতা তৈরি হয় অধূমপায়ীদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে।
কেন এমন হয়? তামাকের নিকোটিন ধূমপায়ীদের যৌনাঙ্গের ধমনিগুলোতে রক্ত সংবহনের ‘উচ্ছ্বাস’ হ্রাস করতে করতে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসে, তাতে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের সম্প্রসারণের পরিবর্তে সংকোচন ঘটে। স্বভাবত সুখ হাওয়া হয়ে যায় আচমকাই। আর নিকোটিন শুধু রক্ত সংবহনের গতি হ্রাস করে বা অতি-জমাট বাঁধিয়েই ক্ষান্ত হয় না, এটি ডিম্বাশয়েরও ক্ষতি করে, যার ফলে ঋতু¯্রাবে অনিয়মিততা, ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদন কমে যাওয়া, এসব ব্যাপারগুলো ঘটে থাকে। এর প্রভাব পড়ে ত্বকেও। দেখে মনে হয়, বয়স যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলছে। যৌনতা উপভোগের চেষ্টা মরে যেতে শুরু করে। সুখানুভূতি বোধটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ফুসফুসের প্রতিবন্ধকতা মানে দূষিত রক্তের আড়তে জীবন হাতড়ে বেড়ানো। তাই ধূমপায়ীরা টিবিতে আক্রান্ত হন সহজেই। ধূমপানের মাধ্যমে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ঢোকে শরীরে। এ অদৃশ্য বিষ-গ্যাস লোহিত রক্তকণিকাগুলোকে অক্সিজেন নিতে বাধা দেয়। সিগারেট, চুরুট, বিড়ি, যার মাধ্যমেই মনোক্সাইড ঢুকুক না কেন, এ গ্যাস রক্তের স্রোতের মধ্যে ৬ ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়ায়, আর লোহিত রক্তকণিকার অক্সিজেন আহরণের পথে নাগাড়ে বাধা দিয়ে চলে।
ধূমপানের মধ্যে আলকাতরা শুধু ফুসফুসেই ঢুকে না, ধূমপায়ী এবং তা আশে পাশে যারা থাকে, তাদের পোশাক-আশাকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাস-লরি-ট্যাক্সি ধোঁয়া ছাড়লে যেমন হয়, ততটা না হলেও এ ধরনের ময়লা-চিটচিটে ছবি দেখা যায়। ধূমপানের সময় তামাক থেকে বেরিয়ে আসা এ আলকাতরাই দাঁতে ছোপ ফেলে, আঙুলের নির্দিষ্ট এলাকায় ত্বকের রং পাল্টে দেয়। ধূমপায়ীদের অধিকাংশই চটজলদি ত্বকের নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এদের ত্বক থেকে দ্রুত উধাও হয়ে যায় লাবণ্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
'আনিকা আলমকে বিশেষ বার্তা দিলেন বলিউড অভিনেত্রী কারিনা কাপুর'
জিরো পয়েন্ট রাতেই দখলে নিল ছাত্র-জনতা
‘আওয়ামী অপশক্তির অপতৎপরতা নস্যাতে জামায়াত প্রস্তুত’
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজশাহীতে বিক্ষোভ
ইউক্রেনকে আর সহায়তা না করার ইঙ্গিত ট্রাম্পের পরামর্শকের
জিরো পয়েন্টে আ. লীগের বিচার দাবিতে গণজমায়েতের ডাক শিক্ষার্থীদের
এসেই উইকেট নিলেন নাসুম
ক্ষমতার জন্য বিএনপি রাজনীতি করে না : মঈন খান
নাব্য সংকটে আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দৃষ্টি হারিয়েছে ৭০০, আহত ৩০ হাজার’ : স্বাস্থ্যসেবা সচিব
ড. ইউনূসসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ করলেন লন্ডনে পলাতক আনোয়ারুজ্জামান
পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অফিস চালাচ্ছেন আওয়ামী কর্মকর্তারা !
পাঠ্যবইয়ে মুসলমানদের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে
সম্মানসূচক ডক্টরেট অর্জন করেছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশী সমাজকর্মী ফয়েজ উদ্দিন এমবিই
শরণখোলায় বিএনপি.র আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
'ডিডি একা নয় হলিউডে এমন অসংখ্য রাঘব-বোয়াল রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে'
সিলেটে ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের পরীক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত
প্রথম আঘাত তাসকিনের
আধুনিক কৃষিযন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক কর্মীদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন
আলেম সমাজ সামাজিক শক্তির প্রতিভূ : ধর্ম উপদেষ্টা