বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দায়িত্ব

Daily Inqilab ড. মো. কামরুজ্জামান

১৪ জুন ২০২৩, ০৮:০৭ পিএম | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম বা প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো ‘আল-কারাউইন’। এটি ৮৫৯ সালে মরক্কোর ফেজে স্থাপিত হয়। মুসলিম শাসক ফাতিমা আল-ফিহরি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রাচীনতম দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলো মিসরের আল আজহার। ৯৭০ সালে ফাতেমীয় শাসনামলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ফাতেমী সেনানায়ক জাওহর সিসিলি। আর ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলো অক্সফোর্ড। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৯৬ সালে।

প্রাচীন এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে। ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রতিষ্ঠাকালীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন। কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ধর্মচর্চাকে নির্দয়ভাবে নির্বাসনে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আধুনিক যুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলো, বিশ্বমানের পাঠদান ও গবেষণার মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি বৃদ্ধি করা। উৎকর্ষ, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে আকৃষ্ট করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্তব্য হলো, পা-িত্য ও গবেষণা দ্বারা নিত্য নতুন জ্ঞান আবিষ্কার করা। সময়োপযোগী শিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। জনসেবার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটানো। চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সব ধরনের বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি ও সংরক্ষণ করা। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৌলিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করা। বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন এক পরিবেশ যেখানে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষ আগমন করবেন। তারা এক জায়গায় থাকবেন। ব্যাপকভাবে ভাবের আদান-প্রদান করবেন। তাদের একে অপরের জ্ঞান ও মনের সঙ্গে মতান্তর সৃষ্টি হবে। আর এ মতান্তরের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে নতুন জ্ঞান। এখানে পুরোনো জ্ঞানের ব্যাপক বিশ্লেষণ হবে; হবে চুলচেরা বিশ্লেষণ, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। এখানে অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীর যৌথ পা-িত্য মিলে আবিষ্কার হবে নতুন জ্ঞান। সৃষ্টি হবে নতুন গবেষণা। আর পুরোনো জ্ঞানকে ঘষে মেজে করবেন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। আর এসব কিছুর নেপথ্যের কারিগর হবেন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ।

সংক্ষেপে বর্ণিত এসব লক্ষ্য এটাই প্রমাণ করে যে, উন্নত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলে দেওয়ার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। ভালো মানুষ তৈরির এক উন্নত কারখানার নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। জাত আর পেশা ভুলে যোগ্য মানুষ তৈরি করার প্রতিষ্ঠান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। নিজ দেশের মান ও গৌরব বৃদ্ধির অবিরাম সাধনার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। দিনের পর দিন নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় থাকার নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। জগৎবিখ্যাত নতুন ফর্মুলা তৈরির নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। মহাকাশের নতুন যান ডিজাইনের সূত্র আবিষ্কার করার নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সৃজনশীল গবেষক তৈরি করার নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্রের নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়। আর শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব শুধু পাঠগ্রহণ নয়। যুগ সন্ধিক্ষণের চাহিদা পূরণের উপায় বের করাই হলো তাদের প্রধান দায়িত্ব। শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন সাধন করাই হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মৌলিক দায়িত্ব। জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা হবে অনবদ্য ও অনন্য।

বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি দেশের জন্য নয়, বিশ্বসমাজের জন্য এটি এক আলোকবর্তিকা। আর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ হলেন সমাজ, দেশ, জাতির জন্য আলোর দিশারী। তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার মাধ্যমে তারা দেশ ও জাতিকে আলোকিত করবেন। নিত্য সমস্যার সমাধানে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। যুগ সন্ধিক্ষণের দাবী পূরণে তারা নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আজ সে পথে হাঁটতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিপরীতমুখী স্রোতের অনুকূলে তারা আজ ঘৃণ্য রাজনীতির বৃত্তে বন্দী হয়ে গেছেন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একেবারে হয় না বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রাজনৈতিক পরিচয়েই তার পদ অলংকৃত করে থাকেন। এ পদে নিয়োগ পেতে একজন উপাচার্যকে সর্বপ্রথম দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। ফলে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি আর একাডেমিশিয়ান থাকেন না। তিনি একজন ঝানু পলিটিশিয়ানে পরিণত হন! শিক্ষা ও গবেষণায় তিনি আর মনোযোগী হতে পারেন না। তাঁর মাথা থেকে শিক্ষা ও গবেষণা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়!

উপাচার্য যেহেতু একজন পলিটিশিয়ান বিধায় তার অনুসারী শিক্ষকগণও হয়ে পড়েন অতিমাত্রায় দলবাজ। গবেষণা বাদ দিয়ে সম্মানিত অধ্যাপকগণ অনৈতিক দলবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন! এ দলবাজির মূল উদ্দেশ্য থাকে অর্থ ইনকাম, স্বার্থোদ্ধার আর ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার লোভে তারা সংকীর্ণ দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যান। এ বন্দিত্ব থেকে তারা আর বের হয়ে আসেন না। এসময় একজন শিক্ষক অতি রাজনীতিবিদ হয়ে পড়েন। এসব কারণে বর্তমানে দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে এখন আর কাঙ্খিত একাডেমিক পরিবেশ নেই। সামগ্রিকভাবে আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলো থেকে একাডেমিক পরিবেশ বিলিন হয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে আমার প্রিয় ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। এ বিশ^বিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতার বয়স ২১ বছর চলমান। বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ দেখে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি যে, শ্রেণীকক্ষে পড়ায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এটেনডেন্সের নম্বর পেতেই তারা ক্লাসে উপস্থিত হয়। তাদের বক্তব্য হলো, শিক্ষকগণ ক্লাসে গবেষণাধর্মী ও জীবনমুখী কথা বলেন না। তাঁরা গদ বাঁধা কিছু লেকচার দেন। ক্লাসরুমে শিক্ষকগণ নিজের ক্ষমতাটাকেই বেশি জাহির করেন। তিনি একাডেমিক মনোভাব বাদ দিয়ে রাজনৈতিক মনোভাবই বেশি প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীগণ আরো বলেন, আমরা অধিকাংশই গরীবের সন্তান। আমাদের প্রয়োজন কর্মমূখী শিক্ষা। কিন্তু আমাদের একাডেমিক পড়ার সাথে চাকরি জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। ৫/৬ বছর বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার পর চাকরির জন্য আবার আলাদা লেখাপড়া করতে হয়। এতে আমাদের দীর্ঘ ৫/৬ বছরের লেখাপড়া অনর্থক ও আনপ্রোডাক্টিভ হিসেবেই ব্যয় হয়! এসব কারণে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়া বাদ দিয়ে এখন চাকরির পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাদের হাতে থাকে বিসিএস গাইড আর নানা ধরণের শিট। এতে সচেতন একজন শিক্ষক হিসেবে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। শিক্ষা হলো জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু সেই মেরুদন্ড আমাদের দেশে আজ মৃত্যুদন্ডে রুপান্তরিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে ভালো রিজাল্ট করা। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য একটাই-বড়ো চাকরি করা, বড়োলোক হওয়া ইত্যাদি। তাদের কেউই ভালো লাগার জন্য পড়ে না। সুনাগরিক হতে কেউ লেখাপড়া করে না। এ কারণে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের ছিঁটেফোঁটাও নেই। শিক্ষকগণ তাদেরকে দেশপ্রেম ও সততায় উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন না। তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবেও গড়ে তুলতে পারছেন না। এটি একটি জাতির জন্য অশনি সংকেত। এটি সচেতন একজন শিক্ষকের জন্য লজ্জা ছাড়া আর কী হতে পারে!

বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের রাজনীতির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিও পরিপূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। ছাত্র রাজনীতি থেকে নৈতিকতা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। তিন দশক ধরে বাংলাদেশের জনগণ ক্রমান্বয়ে এর অবনতিই দেখতে পাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি এখন আর ছাত্রদের কল্যাণে পরিচালিত হয় না। এ রাজনীতি এখন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে পরিণত হয়েছে। ফলে বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, গবেষক ও আবিষ্কারক জন্ম নেয়নি। প্রতিবছর এখানে জন্ম নেন কিছু বিসিএস ক্যাডার। এ ক্যাডাররাই পরবর্তীকালে ক্ষমতাধর আমলায় পরিণত হন। আর তাদেরই ডিরেকশনে পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিষয়াদি। এসব কারণেই বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ^ র‌্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি। এ তালিকায় স্থান হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটেরও। এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও জায়গা হয়নি বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও।

আমাদের দেশে রাজনীতিই হয়ে পড়েছে যশ ও খ্যাতির মূল কেন্দ্রবিন্দু। মেট্রিক পাশ রাজনৈতিক ছোঁকড়া আজ ক্ষমতাধর সমাজপতি! তার ইশারাতেই চলে থানা, পুলিশ ও সমাজের আইন-কানুন! সে আজ টাকাওয়ালা প্রভাবশালী মাস্তান। অনৈতিক মাস্তানের কাছে লেখাপড়া আজ মূল্যহীন। পাশের বাড়ির ভার্সিটি পাশ করা ছেলেটি আজ বেকার। মেট্রিক পাশ নেতার কাছে সে আজ বড়োই অসহায়। অভাব অনটন আর হতাশায় তাকে ঘিরে ধরেছে। বয়স ৩৫ পার হলেও বিয়ে করতে পারছেনা!

চিন্তার বিষয় হলো, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের স্বাধীনতার বয়স ৫২ বছরে পৌঁছেছে। কিন্তু গবেষণা ও আবিষ্কারে বাংলাদেশ কোনো স্বীকৃতি পায়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায়ও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো পর্যন্ত তলানীতে রয়ে গেছে। বর্তমানে সাফল্যের ক্রমানুসারে পৃথিবীর সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো: ১.এমআইটি (ইউএসএ), ২.অক্সফোর্ড (ইউকে), ৩.স্ট্যানফোর্ড (ইউএসএ), ৪.কেমব্রিজ (ইউকে), ৫.হার্ভার্ড (ইউএসএ), ৬.ক্যাল-টেক (ইউএসএ), ৭.ইম্পিরিয়াল কলেজ (ইউকে), ৮.সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (সুইজারল্যান্ড), ৯.ইউনিভার্সিটি কলেজ (ইউকে) ও ১০.ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো (ইউএসএ)।

এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়োপযোগী উন্নত জ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় না। সেখানে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির কোনো নাম-গন্ধও নেই। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে দিনরাত পৃথিবীকে নতুন জ্ঞান উপহার দিতে ব্যস্ত। সেখানে ভিসি ও অন্যান্য পদ নির্ধারিত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যোগ্যতার ভিত্তিতে। এমতাবস্থায় আমাদের কর্তৃপক্ষের উচিত বিশ^বিদ্যালয়ের কাঙ্খিত গবেষণার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা! কর্তৃপক্ষের উচিত উন্নত বিশে^র যেকোনো একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করা। আর বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের উচিত বিশ^বিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতি পরিহার করে চলা। লেজুড়বিত্তিক ছাত্ররাজনীতি থেকে নিজকে বিরত রাখা। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি হওয়া উচিত মাত্র একটা বিষয়ে। আর তাহলো শিক্ষা ও গবেষণায় তৎপর হওয়া।

জাতির জন্য একটি দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের দেশটির বয়স ৫২ বছর হলেও শিক্ষাবাজেটকে অনুদান বলা হয়ে থাকে! আর যে কেউই অনুদান বলতে ভিক্ষাকেই বুঝে থাকবেন। এটি শিক্ষক সমাজের জন্য একটি গ্লানিময় অধ্যায়। গ্লানিময় এ অধ্যায়ের অবসান হওয়া দরকার। আমাদের বুঝাতে হবে, শিক্ষাবাজেট অনুদান নয় বরং এটি একটি প্রোডাক্টিভ বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগটি আমাদের দেশে খুবই অপ্রতুল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সকল দেশের নি¤েœ অবস্থান করছে।

বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যেহেতু সমাজের দর্পণ সেহেতু তারা একাডেমিক কাজের বাইরে গিয়ে সমাজের জন্য কিছু ভালো কাজ করতে পারেন। তারা সাধারণত জেলা ও বিভাগীয় শহরে অবস্থান করেন। এ শিক্ষকগণ বসবারত সংশ্লিষ্ট শহরের সবচেয়ে সম্মানিত সেরা মানুষ। সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে তাঁরা সম্মানিত। কিন্তু তারা উন্নত বিশে^র শিক্ষকদের মতো বেতন-ভাতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পান না। এমনকি দেশীয় আমলাদের থেকেও তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান অনেক নিচুমানের। তাদের তুলনায় শিক্ষকগণ অতি সাধারণ জীবন যাপন করেন। শিক্ষকগণ দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত পদে চাকরি করলেও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তাদের কোনো অবস্থানই নেই।

দেশে আমলারাই সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধাভোগী নাগরিক। তারা তাদের নির্ধারিত বেতনের বাইরে নানাবিধ অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। শুধু বাবুর্চি এলাউন্স বাবদ তারা মাসে ১৬ হাজার টাকা পান। বাসভবনে নিরাপত্তা এলাউন্স বাবদ তারা ভাতা পান ১৬ হাজার টাকা! প্রতি মাসে না হলেও একজন আমলা বছরে অন্তত ২/১ বার বিদেশ ভ্রমণে যান। এ উপলক্ষে টিএ/ডিএ বাবদ পান কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা! একজন আমলা বিনা সুদে গাড়ি ক্রয়ের সুবিধা পেয়ে থাকেন, যার মূল্য পদ ভেদে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা! গাড়ির জ্বালানি খরচ বাবদ প্রতি মাসে তিনি পান ২০ হাজার টাকা। এছাড়া আবাসিক টেলিফোন ভাতা, সেলফোন ভাতা, ইন্টারনেট ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, ডোমেস্টিক ভাতা, হেয়ারকাটিং ভাতাসহ নানা ভাতা পেয়ে থাকেন! চাকরি শেষে একবারেই একজন আমলা বস্তা ভর্তি টাকা পান। অবসরকালীন পেনশনতো আছেই। চাকরি শেষে একজন আমলা নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি পান। তাদের সন্তানদের মানুষ করার গ্যারান্টি পান। তারাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নির্মাতা ও পরিচালক। তাদের হাতে গড়া বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অতিশয় ক্ষয়িষ্ণু ও দুর্বল। তাদের সন্তানরা তাই এদেশে পড়ে না। সন্তানদেরকে বিদেশ পাঠিয়ে তারা সুশিক্ষা নিশ্চিত করেন। সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেন। তারা দেশের সকল আয়-রোজগার বিদেশে ইনভেস্ট করেন। সামাজিক অস্থিরতায় ভরা এ দেশ তার আর ভালো লাগে না। এক সময় তিনিও বিদেশে পাড়ি জমান। বিদেশের মাটিতে নিশ্চিত ও সুন্দর আগামী গড়েন। বিপরীতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সরকার নির্ধারিত বেতন ছাড়া কিছুই পান না। সামাজিক মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে শিক্ষকদের অবস্থান বলতে গেলে কিছুই নেই। যেটুকু আছে সেটুকুও এক সময় আমলারা কেড়ে নিয়েছিল। হারানো সে মর্যাদাটুকু ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হয়েছে। একজন অধ্যাপক একটি জেলা শহরে একাকি বাড়ি করার সক্ষমতা রাখেন না। তাই দল বেঁধে ১০/২০ জন মিলে একটি ভবন নির্মাণ করেন। একটি ভবনে একজন অধ্যাপক একটি বা দুটি ফ্ল্যাটের মালিক হন। এসময়ে একজন অধ্যাপক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ তখন বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে মহান দৃষ্টিতেই দেখে থাকে। তাদের বেতন যাই থাকুক আমজনতা তাদেরকে অনেক বড়লোক মনে করে থাকে। বলতে দ্বিধা নেই যে, শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার মধ্যেও শিক্ষকদেরকে এখনো মানুষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। তাদের এ দৃষ্টিকে সামনে রেখে শিক্ষকগণ আরো কিছু সামাজিক ও মানবিক কাজ করতে পারেন! বসবাসরত শহরে তারা একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট খুলতে পারেন। যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার কাজে সময় কাটাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট শহরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণের জন্য এটি একটি সহায়ক গবেষণাগারে রুপ নিতে পারে। সম্মানিত শিক্ষকগণ সমন্বয়ে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে উঠতে পারে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যে পৌঁছতে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। মাসিক একটা চাঁদা নির্ধারণ করে প্রতিবছর সংশ্লিষ্ট শহরের একজন দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে পারেন। প্রতি বছর একটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে পারেন! গৃহীত এ কর্মসূচীর মাধ্যমে একজন শিক্ষক মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

লেখক: অধ্যাপক, দা’ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক