ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

কে পালাবে, কে পালাবে না, সময়ই বলে দেবে

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৫ জুন ২০২৩, ০৮:০৬ পিএম | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৩, ১১:৫০ পিএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত ও ধোঁশাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে, আদৌ হবে কিনা, বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কিনা, সরকার দাবি না মানলে কী হবে? ইত্যকার প্রশ্ন এখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। বিএনপি তত্ত¡াবধায়ক দাবি’র ইস্যুতে এখন পর্যন্ত অনড় অবস্থানে রয়েছে। দলটির প্রত্যেক নেতা সভা-সমাবেশে একই সুরে এই দাবি তুলে ধরছেন। পাশাপাশি জনসম্পৃক্ত দাবির পক্ষেও সরব রয়েছেন। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার অধীনে নির্বাচন করা নিয়ে অনড়। এর মধ্যে দুই দলের নেতাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য চলছে। বিএনপি এক বক্তব্য দিলে, আওয়ামী লীগ পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছে। রাজনৈতিক মাঠের বক্তৃতায় অনেক বক্তব্যই দেয়া হয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এসব বক্তব্যকে ‘মেঠো বক্তব্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ধর্তব্যের মধ্যে নেয়া হয় না। যাকে বলে ‘পলিটিক্যাল রেটোরিক’ বা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। সাধারণ মানুষ এসব বক্তব্য শোনে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজ জ্ঞান দিয়ে বিচার করে তা বিশ্বাসও করে। অনেকে এসব বক্তব্য বিশ্বাস করে না। অথচ রাজনীতিকরা জনপ্রতিনিধি কিংবা জনগণের হয়ে কথা বলেন। সাধারণ মানুষ তাদের বক্তব্য শোনে এবং নির্ভর করে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের কথা কেন বিশ্বাসযোগ্য হবে না? আবার মেঠো বক্তৃতার বাইরে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের বক্তব্য যা লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে, তা নিয়েও অনেক সময় প্রশ্ন দেখা যায়। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, প্রতিশ্রæতি কিংবা দাবি আদায়ের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ার রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মনে থাকে এক কথা, মুখে বলেন আরেক কথা। মন ও মুখের কথা এক হতে দেখা যায় না। কী ক্ষমতাসীন, কী বিরোধীদল উভয়েই জনগণকে এ ধরনের কথা দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তারা বুঝতে চায় না, জনগণের মধ্যেও বুদ্ধিমান মানুষ রয়েছে। তারা বোঝে, কোনটা আক্ষরিক অর্থে সত্য, কোনটা বাগাড়ম্বর। কেবল রাজনীতিকরাই মনে করেন, তাদের সব কথা জনগণ বিশ্বাস করে এবং তাদের যেভাবে বলা বা বোঝানো হবে, সেভাবেই বুঝবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিরোধীদলের দাবি যদি ন্যায্যও হয়, তা ক্ষমতাসীন দল মানতে চায় না। আবার ক্ষমতাসীন দলের কাজকর্ম সঠিক হলেও তা বিরোধীদল বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে। দুই পক্ষ দুই মেরুতে অবস্থান করে। এমনকি জাতীয় কোনো ইস্যুতে বা দুর্যোগে কারো মধ্যেই পারস্পরিক সহযোগিতা করা বা একমত হতে দেখা যায় না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলের সাথে আলোচনা বা পরামর্শ না করে নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করে। এমনকি বিরোধীদল পরামর্শ দিলেও তা গ্রহণ করা হয় না। এর কারণ, ক্ষমতাসীন দলের ‘ইগো’ বা অহং সমস্যা। বিরোধীদলের সাথে আলাপ বা পরামর্শ করলে যদি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তাহলে তার অক্ষমতা প্রকাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কা কাজ করে। অথচ উন্নত বিশ্বে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশেও জাতীয় সমস্যায় সরকার ও বিরোধীদল উভয়েই একমত পোষণ করে থাকে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের অন্যতম প্রতিশ্রæতি ছিল বিশ্বে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার উদ্যোগ নেয়া। তিনি নির্বাচিত হয়ে প্রতিশ্রæতি মোতাবেক ২০২০ সালে গণতন্ত্র সম্মেলন করেন। এ গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ দাওয়াত পায়নি। এ বছরও গণতন্ত্র সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এবারও বাংলাদেশ দাওয়াত পায়নি। এটা বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই অসম্মানের। এর মধ্য দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে এটাই বোঝানো হয়েছে, আমাদের দেশে গণতন্ত্র অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। অথচ যে পাকিস্তানকে সবচেয়ে ভঙ্গুর একটি দেশ বলা হয়, সেই পাকিস্তান দুইবারই দাওয়াত পেয়েছে। বাইডেনের এই গণতন্ত্র সম্মেলনকে কিন্তু বিরোধীদল রিপাবলিকান সমর্থন করেছে। তারা সমর্থন করেছে এজন্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন গণতন্ত্রকামী দেশে গণতন্ত্র সুসংহত করার বাইডেনের উদ্যোগ সঠিক। এক্ষেত্রে তারা তাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। রিপাবলিকানরা বুঝতে পেরেছে, বিশ্বের যেসব দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হয়, সেসব দেশের সরকার যদি একনায়কতান্ত্রিক হয়ে পড়ে, তাহলে তারা রাশিয়া ও চীন, যেখানে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলবৎ তাদের বলয়ে ঢুকে পড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। এই স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য বাইডেনের নীতির সাথে রিপাবলিকানরা একমত পোষণ করেছে।

দুই.
আমাদের দেশে একবারই আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধীদল একমত হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ’৯০-এর এরশাদবিরোধী গণ আন্দোলনের সময়। এরশাদের পতনের জন্য তারা যেমন একসাথে আন্দোলন করেছে, তেমনি পতনের পর কোন পদ্ধতি নির্বাচন হবে তার ফর্মূলা ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ গঠনেও একমত হয়েছিল। তখন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বঙ্গ ভবনে বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদের শপথ পাঠের আয়োজন করা হয়। শপথ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পাশাপাশি একই সোফায় বসেছিলেন। সেই বিরল ছবি নেটদুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দেশের ইতিহাসে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথমবারের মতো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনটি এমনই নিরপেক্ষ ছিল যে, নির্বাচনের আগেই ধরে নেয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই বিজয় লাভ করতে যাচ্ছে। বিএনপিও তাই বিশ্বাস করে বিরোধীদলে বসার মাইন্ডসেট ঠিক করে। দেখা যায়, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, বিএনপি বিজয় লাভ করে। নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে সরকার গঠন করেছিল। সবচেয়ে নিরপেক্ষ সেই নির্বাচন নিয়ে তখন আওয়ামী লীগ অভিযেগ করেছিল, ‘সূ² কারচুপি’ হয়েছে। তবে তার এই অভিযোগ তখন ধোপে টিকেনি। পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে ‘দা-কুমড়া’ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের ভুল-ত্রæটি বিরোধীদল যেমন ধরিয়ে দেবে, পরামর্শ দেবে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলকেও দেশ পরিচালানা এবং জাতীয় স্বার্থে বিরোধীদলের পরামর্শ গ্রহণ ও একমত পোষণ করবে। দেখা গেছে, সে সময় ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলের মধ্যে এমন সম্পর্ক সৃষ্টি হলো যে, বিরোধীদল একাট্টা হয়ে কিভাবে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবে, আর ক্ষমতাসীনদল নিজ নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দমন-পীড়ন করে কিভাবে ক্ষমতায় থাকবে, সেই তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, যা কালপরিক্রমায় তীব্র আকার ধারন করেছে। এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, বিরোধীদল বিএনপি বলছে, ‘ক্ষমতাসীন দল পালানোর পথ পাবে না।’ পাল্টা জবাবে ক্ষমতাসীন দল বলছে, ‘আওয়ামী লীগ খেলতে নামলে বিএনপির পালানোর পথ থাকবে না।’ অর্থাৎ কে যে পালাবে আর কে যে পালাবে না, তা জনগণ বুঝতে পারছে না। কারণ, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে গেছে যে, পরস্পরবিরোধী এসব বক্তব্যকে জনগণ ‘মেঠো বক্তব্য’ ধরবে নাকি তাদের কথামতো সত্যি সত্যি কেউ পালিয়ে যাবে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, বিগত প্রায় পনের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে বিএনপি’র ওপর এমন দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, গ্রেফতার ও নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়ার যে প্রক্রিয়া চালিয়েছে, তাতেও দলটি টিকে আছে, পালিয়ে যায়নি। বছর দেড়েক আগেও ক্ষমতাসীনদল বিএনপিকে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ এমনকি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দেয়নি। বিএনপির বহু নেতাকর্মী এলাকা কিংবা ঘরে থাকতে পারেনি, পালিয়ে বেড়িয়েছে। তবে দেশ থেকে পালায়নি। বিএনপিও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বরং দলটি ঘুরে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি যে বলছে, ‘আওয়ামী লীগ পালাবার পথ পাবে না।’ তাদের এ কথা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কারণ, আওয়ামী লীগও বৃহৎ একটি দল। নানা ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে টিকে ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় এসে বিগত পনের বছরে দলটি বিরোধীদলকে দমন করে যেভাবে দেশ শাসন করেছে, তা দেশ-বিদেশের অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভেঙে দেয়া, বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নিজের অধীনে যেভাবে নির্বাচন করেছে, তা কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এছাড়া বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের খুন-গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে সংবাদমাধ্যমসহ বাকস্বাধীনতা হরণ এবং গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার অভিযোগও উঠেছে। এ অভিযোগের ভিত্তি দিয়েছে, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচন করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ও র‌্যাব-পুলিশের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া।

তিন.
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি দেয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীনদল থেকে শুরু করে বিরোধীদল তো বটেই দেশের জনগণের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। শুরুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই এ নীতিকে স্বাগত জানিয়ে উভয়ের পক্ষে এ নীতি গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। তবে এ নীতি যে ক্ষমতাসীন দলের ওপর বেশি প্রভাব ফেলবে বা ফেলেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার বিরোধিতা ও বিষোদগার থেকেই বোঝা যায়। সাধারণত বিশ্বে আইন বা নীতি করা হয় ভিকটিমকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য। যার দ্বারা ভিকটিম আক্রান্ত হয়, তাকে বিচারের আওতায় আনার জন্য। এ বিবেচনায়, র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসানীতি যে প্রকারন্তরে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধেই গেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন এমন গুঞ্জণও ছড়িয়ে পড়েছে যে, ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসনের যারা নানা ধরনের দুর্নীতি ও অপকর্মের সাথে জড়িয়েছে, তাদের অনেকের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে একধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অনেকের ভিসা বাতিল করেছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে, কার ওপর কখন ভিসানীতি আরোপ করা হয়, তা কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না। যারা এ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে তো বটেই, কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে তাদের অঢেল ধন-সম্পদ রয়েছে এবং সন্তান-সন্ততি পড়াশোনা করছে। ভিসানীতি যদি তাদের ওপর আরোপ করা হয়, তাহলে তাদের অকূলপাথারে পড়া ছাড়া গতি থাকবে না। ফলে যারা সম্পদ ও সন্তানদের নিরাপদ রাখতে চান, তারা দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র গুঞ্জরিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপি’র কোনো নেতাকর্মীদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। কাজেই, ভিসানীতি যে ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসনের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীকে বেশি ভাবাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। এ ভাবনা থেকে কারো কারো মনে দেশ ছাড়ার চিন্তা কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে বারবারই তারা এ অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতও গত কিছুদিন বিএনপিসহ ক্ষমতাসীনদলের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের সাথে ঘন ঘন বৈঠক করেছেন। দেশটি যে বাংলাদেশের ওপর তার ভিসানীতির শর্তগুলো নিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস, তা এ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু হয়, তার শত্রæর প্রয়োজন হয় না। আবার বলা হয়ে থাকে, সে যে দেশের দিকে নজর দেয়, যতই তার সমালোচনা করা হোক, সে তা বাস্তবায়ন করে ছাড়ে। বাইডেন প্রশাসন বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে সুসংহত করার যে নীতি অবলম্বন করেছে, তা থেকে বাংলাদেশও বাদ যাচ্ছে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকোচন কিংবা ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে তার দৃষ্টি পড়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশে যদি কথিত কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকে, তাহলে বাংলাদেশ তার শত্রæ বলয় কর্তৃত্ববাদী শাসনাধীন চীন ও রাশিয়া বলয়ের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, যা তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সে বাংলাদেশকে হাতছাড়া করতে চায় না। ফলে বাংলাদেশের মানুষের চাহিদার সাথে সমন্বয় করে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে সরকারকে চাপে ফেলতে ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, এ ভিসানীতি নাইজেরিয়া, উগান্ডা, বেলারুশসহ আরও কয়েকটি দেশে প্রয়োগ করা হলেও তা নির্বাচনের পরে করা হয়েছে। বাংলাদেশে করা হয়েছে নির্বাচনের প্রায় সাত মাস আগে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করে তার শত্রæ বলয় থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। আর তা তার পক্ষে করা সম্ভব। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের ওপর নির্ভরশীল। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সবার উপরে রয়েছে। বাংলাদেশের রেমিটেন্স আসার ক্ষেত্রে দেশটি এখন এক নম্বরে রয়েছে। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রেও এক নম্বর ডেসটিনেশন। অন্যদিকে, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে লোন পেতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বা ইশারা-ইঙ্গিত খুবই প্রয়োজন। ফলে তাকে উপেক্ষা করা আমাদের মতো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়।

চার.
সরকার দেশের অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালের জন্য বৈশ্বিক মন্দা কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধকে যতই দায়ী করুক না কেন, অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, তা পুরো অংশে সত্য নয়। কারণ, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এই দুর্নীতি না হলে দেশ এত সংকটে পড়ত না। ডলার সংকট ও রিজার্ভ নি¤œগামী হতো না। এটা হয়েছে, দুর্নীতি ও বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের অদূরদর্শিতার কারণে। সরকার এ ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ডলার তথা অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রশাসনের অনেকের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। তাদের কাজের স্পৃহাও কমিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেকের মধ্যে এখন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এরাই দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্রকে সংকুচিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। সরকার এখন যতই বলুক, সে খেলতে শুরু করলে বিএনপি’র পালানোর পথ থাকবে না। তার এ কথার সারবত্তা এখন নেই বললেই চলে। কারণ, বিএনপিকে বিগত পনের বছরে নিপীড়ন-নির্যাতন করেও নিঃশেষ করা যায়নি। দেশছাড়াও করা যায়নি। তারা দেশে থেকেই মার খেয়েছে, দেশের মাটিতেই পড়ে থেকেছে। তাদের হারানোর কিছু নেই। যদি হারানোর কিছু থাকে, তা ক্ষমতাসীনদলের লোকজনের রয়েছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে, বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে