সামাজিক সুরক্ষার ছায়াতলে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ
০৬ জুলাই ২০২৩, ০৮:১১ পিএম | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০৩ এএম
দেশের পশ্চাৎপাদ ও দরিদ্র্য মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান রেখেছে। সামাজিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল-প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি, বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সঠিক কর্মসংস্থান, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকপ্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি ইত্যাদি। এসব খাতে সরকার জিডিপির মোট ২.৫৫ শতাংশ ব্যয় করে থাকে, যা টাকার অংকে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বাংলাদেশ দারিদ্র্যমোচনে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই ক্ষেত্রে সরকারি উন্নয়ন কর্মকা-ের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ এবং নানাবিধ সামাজিক উদ্যোগে সমন্বিত প্রয়াসের ফলে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এর ফলে ২০০৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ শতাংশে। ঠিক একইভাবে অতি দরিদ্র্যের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বর্তমানে দেশে অতি দারিদ্র্যর হার ৫.৬ শতাংশ। সরকারের মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র্যমোচনের এই গতি অব্যাহত রাখা এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যর হার ১৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। এই জন্য সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২০২৫) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পরিকল্পিত নীতি কৌশল বাস্তবায়ন করছে। সরকার বৃহৎ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি একযোগে সমাজে পিছিয়ে পড়া দুস্থ অসহায় এবং ছিন্নমূল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য নানারকম কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা ও উপস্থাপন করেছে। তবে এর মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতির নিশ্চয়তা বিধান করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে তার প্রধান ১০টি অগ্রাধিকার কর্মসূচির অন্যতম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল অংশীজন হলো জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ব্যতীত উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বা উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। সে আলোকে সরকারের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ঠিক করা হয়েছে। এ কৌশল অনেকটা মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধতাড়িত।
বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা প্রদান কর্মসূচি আওতায় ‘বিধবা’ বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যাদের স্বামী মৃত; ‘স্বামী নিগৃহীতা’ বলতে তাঁদেরকেই বুঝানো হয়েছে, যারা স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা বা অন্য যে কোনো কারণে অন্ততঃ দু’বছর যাবৎ স্বামীর সংগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বা একত্রে বসবাস করেন না। স্বামী মারা যাওয়ার পর বা মহিলাদের বয়স হওয়ার পর তারা বেশ একাকিত্বে ভোগেন। সে সময় তাদের হাতে না থাকে অর্থ, না থাকে বল। এই দুইয়ের সংকট সমাধান হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু সহযোগিতার মনোভাব দেখানো সম্ভব বলে সরকার মনে করে। এই মানবিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে সরকার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা প্রণয়ন করেছে। এই ভাতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান; পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি; আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে তাদের মনোবল জোরদার করা; চিকিৎসা সহায়তা ও পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান।
বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভাতাভোগীকে ১০ টাকার বিনিময়ে নিজ নামে একটি ব্যাংকহিসেব খুলতে হয়। সেই হিসেবে প্রতি মাসে ভাতা জমা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ভাতাভোগীদের অনলাইন মাধ্যমে এ২চ বা গভর্মেন্ট টু পারসন পদ্ধতিতে ভাতা প্রদান চালু করা হয়েছে। এর ফলে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতাভোগীরা খুব সহজেই ভাতা পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫টি ক্যাশভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে ২২টি কর্মসূচির অর্থ এ পদ্ধতিতে সরাসরি উপকারভোগীর ব্যাংক হিসাব বা মোবাইল ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে অবশিষ্ট ক্যাশভিত্তিক কর্মসূচিসমূহকে জি-টু-পি পদ্ধতির আওতায় আনা সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে ৮০ শতাংশের অধিক ক্যাশভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা জি-টু-পি পদ্ধতিতে প্রদান করা হচ্ছে। কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে সমাজের দরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার মানুষের দরিদ্রতা ও বৈষম্য হ্রাস করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি, হিজড়া জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উপজেলা ও শহর সমাজসেবা অফিস, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরসহ সরকারি অন্যান্য দপ্তরের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেবাভোগী বাছাইকরণের প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউনিয়ন পরিষদ।
সমাজের দুঃস্থ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের কল্যাণে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজসেবা অধিদফতররের মাধ্যমে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। ওই অর্থবছরে ৪ লক্ষ ৩ হাজার ১১০ জনকে এককালীন মাসিক ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে সরকারের উদ্যোগে প্রবর্তিত এ কর্মসূচি সমাজসেবা অধিদপ্তর সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় ২০২২- ২৩অর্থবছরে ২৪ লাখ ৭৫ হাজার জন ভাতাভোগীকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে প্রদান করছে। বিগত ৯ বছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা বিতরণে প্রায় শতভাগ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্ধ রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা বর্তমান বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে বয়স্কভাতা ভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়িয়ে ৫৮ লক্ষ ১ হাজার জন করা হয়েছে। এছাড়াও মাসিক ভাতার হার ৫০০ থেকে ৬০০ টকাা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা ভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বৃদ্ধি করে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার জনে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মাসিক ভাতার হারও ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাক বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় উপকার ভোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ৫৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৫০৩ জনে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মা ও শিশু সহায়তার কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ১২ লক্ষ ৫৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৩ লাখ ৪ হাজার করা হয়েছে। অতিদারিদ্র্যদের জন্য কর্মসংস্থান কার্যক্রমে উপকারভোগীর দৈনিক ভাতার হার ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় দেশের দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য যতাক্রমে ৪০.৬ ও ৬৮.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ অভাবনীয় অর্জনের পেছনে স্বাভাবিক অর্থনীতিক কর্মকা-ের পাশাপাশি দেশের দুঃস্থ, দারিদ্র্য, অবহেলিত, অনগ্রসর সুবিধাবঞ্চিত ও সমস্যাগ্রস্ত পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠর জন্য সরকারের লক্ষ্যমাত্রাভিমুখী সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখাছে।
Ñপিআইডি ফিচার
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক
জমকালো আয়োজনে পালিত হলো বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের সঙ্গে তুর্কী এমপির সাক্ষাৎ
বিহারীরা কেমন আছে
ব্রাহ্মণপাড়ায় ধর্ষণের শিকার হতদরিদ্র প্রতিবন্ধী যুবতীর সন্তান প্রসব! আতংকে ভুক্তভোগী পরিবার
মোরেলগঞ্জে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতির ১৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত