রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে
০৭ জুলাই ২০২৩, ০৮:৪২ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এ দুটি খাতেই বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২১-২০২২ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১০৩ কোটি ডলার আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৬১ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে ২.৭৫% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অপরদিকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫২০৮ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছিল আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৫৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এক্ষেত্রে ৬.৬৭ % প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি রপ্তানিকারক দেশের একটি আর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ২০টি রপ্তানিকারক দেশের একটি। রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে এই প্রবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এক অনন্য অর্জন। এ অর্জন আমাদের অগ্রগতি, উন্নয়ন এবং সক্ষমতার প্রমাণ। দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানির অগ্রযাত্রা তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র একটি দেশ। কিন্তু এখানে বসবাস করে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিদিনই আমরা উন্নয়ন এবং অগ্রগতির পথে অগ্রসর হয়েছি। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে এদেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১.১৮ কোটি ডলার আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৬১ কোটি ডলার। ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে এদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৫ কোটি ডলার আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫৫৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশকে তলাবিহীন জুড়ি বলার সুযোগ আজ কারো নেই এবং এ অভিযোগ আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। দেশের ১৭ কোটি মানুষের ৩৪ কোটি হাতের সম্মিলিত প্রয়াসেই আজ এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২০৩টি দেশে বাংলাদেশ তার পণ্য রপ্তানি করে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অনন্য সফলতা। বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক (নিট, ওভেন), হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চা, পাট ও পাটজাত পণ্য, ঔষধ, কাকড়া, শুটকি, গরু মহিশের নাড়ি ভুঁড়ি ও হাঁড়, বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য, সবজি ও তরিতরকারি, জুস, সিরামিক পণ্য, আইটি পণ্য, টিভি, ফ্রিজ, বিভিন্ন ধরনের হালকা প্রকৌশল পণ্য, বাইসাইকেল, হ্যান্ডিক্রাফট, সিমেন্ট, স্টিল পণ্য, জাহাজ, বেকারি পণ্য, কাগজ, মানুষের চুল ইত্যাদিসহ প্রায় ৭৫১ ধরনের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রধান খাত হলেও আমরা আরো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ খাতে রপ্তানি সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছি এবং কয়েকটি সেক্টরে বেশ সফলতাও অর্জন করেছি। বরাবরের মতই রপ্তানি আয়ের শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। পোশাক খাতে ২০২১-২০২২ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪২৬১ কোটি ডলার আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪৬৯৯ কোটি ডলার এবং এ ক্ষেত্রে ১০.২৭% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। ২০২১-২০২২ সালে এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২৫ কোটি ডলার আর ২০২২-২০২৩ খাতে রপ্তানি হয়েছে ১২২ কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি ১.৭৫ % কমেছে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে রয়েছে হোম টেক্সটাইল খাত। ২০২১-২০২২ সালে এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৬২ কোটি ডলার আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১১০ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে রপ্তানি ৩২.৪৭ % কমেছে। চতুর্থ স্থানে রয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য। ২০২১-২০২২ সালে এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১৩ কোটি ডলার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৯১ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে রপ্তানি ১৯% কমেছে। পঞ্চম স্থানে রয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য। ২০২১-২০২২ সালে এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১৬ কোটি ডলার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৮৪ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে রপ্তানি ২৭ % কমেছে। এসবের পাশাপাশি রপ্তানির ক্ষেত্রে ঔষধ খাত বেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং আভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১২৭টি দেশে ঔষধ রপ্তানি করছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮০০ কোটি ডলার এবং অর্জিত হয়েছে ৫৫৫৬ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে টার্গেটের ৯৫.৭৯ % অর্জিত হয়েছে। করোনা ভাইরাস সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি এবং ডলার সংকট সত্ত্বেও রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সফলতাই বটে। সুতরাং যে কোন মূল্যে প্রবৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।
রেমিট্যান্স আমাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম উৎস এবং রিজার্ভের প্রধান অংশ। বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশই যোগান দেয় এই রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এই রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমদানির বিপরীতে বৈদেশিক দেনা পরিশোধে এই রেমিট্যান্স প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। রেমিট্যান্সের প্রাপ্ত হিসাবটি শুধুমাত্র ব্যাংকিং চানেলে আগত হিসাব। হুন্ডির মাধ্যমে আগত রেমিট্যান্স যোগ করলে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরো বাড়বে। হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত হলে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। সুতরাং ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রবাসীদের মোটিভেট করতে হবে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে সহজে টাকা পাঠানোর সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে তাকে আরো ২.৫% টাকা বেশি প্রদান করা হচ্ছে। এটি অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত আছে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ এবং তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাকে দেখাভাল করার জন্য সরকারের জনশক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজ করছে এবং তা আরো বাড়াতে হবে। কোন দেশের কোন সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, তার আপ টু ডেট খবর নিতে হবে এবং তা জনগণকে জানাতে হবে। লোকজন যেন আরো বেশি করে বিদেশ যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দিয়ে তাদের দক্ষ করতে হবে। লোকজন যাতে সহজে ভিসা পায়, কম খরচে বিদেশে যেতে পারে এবং বিদেশে গিয়ে যেন কোনরকম বিপদের সম্মুখীন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত দুতাবাসগুলোর দায়িত্ব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এবং বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিটির সুখে-দুঃখে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পাশে থাকতে হবে। আমাদের অধিক জনসংখ্যাকে আজ সম্পদে পরিণত করতে হবে। কম জন্মহারের কারণে অনেক দেশে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। আবার যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে অনেক মানুষ হতাহত হবার কারণে অনেক দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এদেশের মানুষদের বেশি করে বিদেশে পাঠানোর বিরাট একটি সুযোগ রয়েছে এবং এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করতে হলে বিদেশে বেশি বেশি লোক পাঠাতে হবে। আর রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে বেশি করে শিল্পায়ন করতে হবে। ব্যাপক শিল্পায়নই কেবল একটি দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারে। এক্ষেত্রে শিল্প উদ্যোক্তাদের অবদান অপরিসীম। শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, নতুন পণ্য উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটায়, আবার সেই পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। ফলে তারা একদিকে আমদানি কমিয়ে পরনির্ভরতা কমায়, অপরদিকে পণ্য রপ্তানি করে দেশকে এগিয়ে নেয়। সুতরাং উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগিতা দিতে হবে। শিল্পকারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের যোগান দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য বন্দর ব্যবস্থাপনাকে আরো উন্নত এবং গতিশীল করতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক
জমকালো আয়োজনে পালিত হলো বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের সঙ্গে তুর্কী এমপির সাক্ষাৎ
বিহারীরা কেমন আছে
ব্রাহ্মণপাড়ায় ধর্ষণের শিকার হতদরিদ্র প্রতিবন্ধী যুবতীর সন্তান প্রসব! আতংকে ভুক্তভোগী পরিবার
মোরেলগঞ্জে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতির ১৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত