এ মৃত্যুর দায় কে নেবে?
১৩ জুলাই ২০২৩, ০৮:০৭ পিএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম
আমাদের সড়ক মহাসড়কে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছে, যা বিশ্বে আর কোথাও নেই। এসব অদক্ষ চালকের দাপটে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছেই। লাগাম টানা যাচ্ছে না। সবার চোখের সামনে লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে গাড়ি চালায় তারা? দেশে নয়া সড়ক আইন কার্যকর হয়েছে ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে। বেদনার কথা হলো, এ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে সড়কে প্রতি বছর আহত এবং নিহতের হার বাড়ছেই। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এমনটা হচ্ছে।
আইন না মানায় প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এতে নিহত হয়েছে ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত ৪৬৮ জন। চলতি ২০২৩ সালে আনুপাতিক হারে দুর্ঘটনা আরো বেড়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। সড়ক মৃত্যুর হার বিগত দুই বছরের তুলনায় অনেক বেশি। শেষ বছরের দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে মোটরসাইকেল।
সড়ক আইন ছিল আগেও, এখনো আছে। প্রয়োগ হয় কি কখনো? নিরাপদ সড়ক হয়তো আর হবে না। অসভ্য দেশে সড়ক নিরাপদ হয় কী করে? যে দেশে সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা আইন বাতিল করার কথা বলে প্রশ্রয় পায়, সেদেশে সড়ক নিরাপদ হওয়ার আশা করা মোটেও ঠিক না। প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি সড়ক আমাদের জন্য নিরাপদ হবে? থামবে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল?
পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু টানেল সবকিছুই তো হচ্ছে দেশে। ভাবি খুনে সড়ক হয়তো আদৌ নিরাপদ হবে না। এ নিয়ে মনে বড় সংশয়! অথচ, সড়ক নিরাপদ হওয়া কিন্তু খুব জরুরি। খুন খারাবির চেয়ে সড়কেই মানুষ বেশি মরছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, আহত হয়ে পঙ্গু হচ্ছে শত শত মানুষ। সড়কে আইন না মানা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ এবং অবৈধ ড্রাইভার গাড়ি চালানো দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ। উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না। মোটরসাইকেলে হেলমেট না থাকলে জ্বালানি তেল না দেওয়ার নির্দেশ ছিল পেট্রোল পাম্পগুলোর প্রতি। সে নির্দেশ মানা হচ্ছে। তাই মোটরসাইকেল আরোহীরা হেলমেট পরে গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছে। কাজেই পরিবহনের ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি না দেওয়ার বিষয়টি জনস্বার্থে মেনে নেওয়া দরকার এবং মেনে নিলে মানুষ উপকৃত হবে। সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।
এর আগে সড়ক নিরাপদ না হওয়ার ব্যাপারে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে দোষারোপ করা হতো। এখন তিনি নেই। তাহলে কার শক্তিতে পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিকরা সড়ক আইন অমান্য করছে? এভাবে চললে আইন করে কোনো লাভ হবে না। আইন যেমন পাকাপোক্ত করতে হবে, তেমনি আইন মানতে হবে, আইন মানাতে হবে, আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তবেই সড়ক নিরাপদ হবে।
এদেশে কত শত রাজীবের হাত যাচ্ছে, পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে, এখলাছ উদ্দিন, ইমাম হোসেন, শারমিন, মিশুক-তারেক, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছেই না সড়কে মৃত্যু। আমরা বিশেষ দু’একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যু রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যান, স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কি তাতে? আমাদের সড়ক যেন এখন মরণ ফাঁদ। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ না ঝরছে, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি না হয়ে উঠছে। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তাতে, নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবে কি না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুঘর্টনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুঘর্টনার হিসাব নিয়ে পুলিশ এ তথ্য দিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুঘর্টনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যায় প্রায় ৫৫ জন। পুলিশের দেয়া তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুঘর্টনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেকে দুঘর্টনায় মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ রেকডর্ভুক্ত করে না। ২০০৯ সালের এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যুর সংখ্যা নেপালে সবচেয়ে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। সবচেয়ে কম যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুঘর্টনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ওই গবেষণায় আরো বলা হয়, সড়ক দুঘর্টনার শিকার ব্যক্তিদের প্রায় ৩২ শতাংশ ১৬ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে যানবাহন দুঘর্টনায় বছরে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং আহত ও পুঙ্গ হয়ে পরনিভর্রশীল জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এর চাইতেও অনেক বেশি মানুষ। সড়ক দুঘর্টনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুঘর্টনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এটি দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশসমূহের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। এক গবেষণা জরিপ হতে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুঘর্টনার জন্য দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। এক গবেষণায় দেখা যায়, নানা কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুঘর্টনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এক হাজার মোটরযানে দুই দশমিক পাঁচ ভাগ থেকে তিন দশমিক পাঁচ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুঘর্টনার শিকার হচ্ছেন।
বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট। এই হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কাজেই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। উপযুক্ত শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত হলে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা অবশ্যই কমে আসবে।
লেখক: সমাজ গবেষক ও কলামিস্ট
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক