কীভাবে কোটিপতি বাড়ে

Daily Inqilab মোহাম্মদ আবু নোমান

১৫ জুলাই ২০২৩, ০৭:৫১ পিএম | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম

অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও কোটিপতি হতে পারে যে কেউ। তবে পার্থক্য হলো, অন্য দেশের মানুষ কোটিপতি হয়, কাজ করে বা ব্যবসা করে। আর বাংলাদেশে বেশিরভাগ হয় চাঁদাবাজি করে, দুর্নীতি করে, ব্যবসায় সিন্ডিকেট করে, ভেজাল কারবার করে। বিদেশিরা নিজেদের পরিশ্রমে ধনী হয়, আর বাংলাদেশে শ্রমিক, কর্মচারীদের যথাযথ পারিশ্রমিক না দিয়ে হয় ধনী। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি অন্যের বুকে লাথি মেরে, লক্ষ মানুষ পথে বসিয়ে! দুর্নীতিবাজ, ভেজাল/সিন্ডিকেট কারবারী, স্বার্থপর, আপন স্বার্থে মগ্ন কোটিপতিতে ভরপুর এদেশ। কোটিপতি বাড়ছেই। মানুষের নাকি টাকার অভাব নাই। আবার যখন যাকাত দেওয়ার সময় আসে আমরা কি নিশ্চিত যে, পদদলিত মানুষের লাশ দেখবো না? প্রচ- রৌদ্রের মধ্যে টিসিবির গাড়ি আসার আগে শত শত মানুষ একটু কমদামে পণ্য কেনার জন্য যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বুঝা যায় দেশের মাথা পিছু আয় কার কত টাকা হয়েছে। এই দৃশ্য উন্নয়নের সাথে যায় না। মানলাম দেশে কোটিপতি বাড়ছেই। কিন্তু তারা কারা?

দেশের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতে গত ৩ মাসে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৪৫ জন। গত বছরের ডিসেম্বরে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৭ জন। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২ জনে। গত ১৩ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি প্রতি তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে। গত বছরের মার্চে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ জন। এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ৬ হাজার ৫৯৫ জন। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমলেও কোটপতি আমানতকারীদের সংখ্যা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের এই কোটিপতি হওয়ার বিপরীতে কত লাখ মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নি¤œবিত্তের কাতারে বা নি¤œবিত্ত থেকে বিত্তহীনের কাতারে পৌঁছেছে তা জানলে উন্নয়নের আসল মোজেজাটা বুঝা যেত।

মূলত আমাদের দেশে চলছে, অনিয়ন্ত্রিত ভূঁইফোর অর্থনীতি। সামষ্টিক সম্পদ না বাড়লেও কোটিপতি বাড়ে, ধনী বাড়ে। এটা একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব! কেননা, এ দেশে অনেক কিছুই সম্ভব। এখানে ব্যাংকের সোনা হয়ে যায় তামা, টাকা উধাও, বাড়ে ঋণখেলাপি, কয়লা হয়ে যায় ময়লা। রাষ্ট্রের টাকা লুট করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কী? বিশ্বব্যাপী যদি এ পরিসংখ্যান করা হতো, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ অতি ধনি ও দুর্নীতিবাজ কোটিপতি বাড়ার দেশ কোনটি, তাহলে আমাদের দেশের নাম সর্বশীর্ষে আসার সম্ভাবনা শতভাগ। আমাদের দেশের নব্য কোটিপতি, ‘আলট্রা ওয়েলদি’ বা অতি ধনী তথা ধনকুবের তকমাধারী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সরকারি আমলা-কামলাদের আয় ব্যায়ের হিসাব টান দেওয়া সম্ভব হলে আনঅ্যাকাউনটেবল অনেক বিষয় বেরিয়ে আসবে।

ইতিপূর্বে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮-এ বলা হয়েছিলো, অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, বিশ্বে ধনকুবের বৃদ্ধির উত্থানে শীর্ষে বাংলাদেশ। যে হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। ওয়েলথ এক্স মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি ইনসাইট ভেঞ্চার পার্টনারসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ওয়েলথ এক্সের দাবি, তাদের তথ্যভান্ডারে ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ধনকুবেরের তথ্য রয়েছে। ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ থাকলে তাঁদের আলট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনী ও ধনকুবের হিসেবে গণ্য করে সংস্থাটি।

দেশের অর্থনীতিবিদরা দ্রুত কোটিপতি বৃদ্ধি ও দ্রুত অতি ধনী বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। কারণ, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে দেশের কতিপয় মানুষের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে, এটা ঠিক। কিন্তু একটা শ্রেণির হাতে বড় অংশে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ফলে বৈষম্য অনেক বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। এতে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলছে, দেশ আর গরিব নয়, মানুষের আয় বেড়েছে, বিভিন্ন সূচকে দেশ এগিয়েছে, সব ক্ষেত্রেই আমরা রোল মডেল, আরো কত কী! সত্যি আমরা কতটা এগিয়েছি বা এগিয়ে থাকলে কারা কীভাবে এগিয়েছে, দেখার কেউ আছে কী?

সব সরকারের আমলেই কিছু ফন্দিবাজ বিভিন্ন অপকৌশলে ও সরকারি মদদে লাখ লাখ মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিশ্বের ধবকুবেরের সিরিয়ালে চলে গেছে। শেয়ার বাজার লুট, ব্যাংক লুট, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, যুবক ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে সাধারণ মানুষ হয়ে গেছে রাস্তার ভিখারি। প্রতিবারই একই বাস্তবতাÑ কিছু লোক শুধু শুধু টাকা পায়, আর কিছু লোক টাকা হারায়! আর সরকারি জমি দখল, রেলওয়ে, বিমান, পরিবহন, গার্মেন্ট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাত দখল করে কোটি টাকার মালিক।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এসেছে, সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। যাচ্ছেতাই করে ১০০ জনের অধিকার তছরুফ করে, দু’/এক জনের কোটি টাকার মালিক হবার অসম, নিষ্ঠুর, অমানবিক হিংস্র প্রতিযোগিতা চলছে। গরিব আর মধ্যবিত্তরা উপলব্ধি করছে জীবন কত কষ্টের। শত জনের সুখ কেড়ে নিয়ে দু’/চার জন তারে সুখ একশ গুণ বাড়াতে পারে, কিন্তু তাতে কমে যায় সুখীর সংখ্যা। যারা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে, তাদের রয়েছে ভবিষ্যতের শঙ্কা, রাজেনৈতিক অস্থিরতা তথা রাজনৈতিক শঙ্কা, দেশের নি¤œ জীবনযাত্রার মানে অনাগ্রহ, আর সবচেয়ে বড় কথা দেশপ্রেমের অভাব। দেশ রসাতলে যায় যাক, স্বপরিবারে এক সময় বিদেশ পাড়ি দিতে পারলেই হলো। সবকিছু দেখে বলতে হয়, সব সরকারেরই শাসকশ্রেণি এই দেশের কেউ নয়। তারা সেই ইংরেজদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারাও এদেশ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত, আজ এরাও লুটে তাদের দেশেই পাঠাচ্ছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী গত পাঁচদশকে আমরা আরো বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম! কোটিপতি বাড়ার খবরটি ভালো খবর। সরকারকে আয়ের বৈষম্যের ব্যাপারটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সুষম সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সাথে সাথে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, এটাই সকলের কামনা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক