মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীদের দায় রয়েছে
১৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:০০ পিএম | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম
আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা। ঔপনিবেশিক আমলের সম্পদ পাচার ও লুণ্ঠনের ধারাবাহিকতায় ভূমি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্য দিয়ে সমাজে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল, উপনিবেশোত্তর নতুন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বৈষম্য নিরসন করে সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি ছিল সাধারণ মানুষের সরাসরি স্বার্থ ও আগ্রহের বিষয়। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো আমাদের রফতানি পণ্যের রাজস্ব পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া এবং জনগণের সম্পদ গুটি কতেক শিল্প পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার অভিযোগ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় পরিনত হয়েছিল। একটি কৃষিভিত্তিক অঞ্চলে বাইরে থেকে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যারা এখানে শিল্পোৎপাদনের ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রার ভিত্তি রচনা করেছিলেন, বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও আজকের অগ্রগতির পেছনে তাদের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কথিত সেই বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত সেই রাজনৈতিক পক্ষগুলো এখনো বহাল থাকলেও এখন আরো কয়েক ডজন শিল্পপরিবারের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক- বাণিজ্যিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদেরকে মুখ খুলতে দেখা যায়না। বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাস্তবতার কারণে সেই আমলে একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ থাকলেও কথিত শিল্প পরিবারগুলোর হাতে এ দেশের সাধারণ ভোক্তারা জিম্মি হয়ে পড়ার কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমনটি এখন স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে চলেছে। এখন কথিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে যেন দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রও অসহায় হয়ে পড়েছে। যেখানে জাতীয় সংসদের বেশিরভাগ সদস্য ব্যবসায়ী। সরকারের মন্ত্রী এমপিদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও সরকার ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায় হওয়ার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া মুনাফাবাজির সাথে সরকার তখনই আপস করতে পারে, যখন ভোক্তা তথা সাধারণ জনগণের কাছে সরকারের কোনো কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতা থাকে না। যদি জনগণের ভোট বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়াই শুধুমাত্র ব্যবসায়ী, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রভাবশালী দেশের প্রকাশ্য কিংবা গোপণ সমর্থন নিয়ে বার বার জাতীয় নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া যায়। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও দীর্ঘায়িত করার নেপথ্য কুশীলবদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে জনগণের স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখার কোনো সুযোগ থাকেনা। এ কারণেই দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকটকালে সরকার যখন কৃচ্ছ্রতার নীতি গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে, তখন নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সরকারি কর্মচারীদের ১০ ভাগ বেতনবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে, ব্যবসায়ী নেতাদের সিন্ডিকেটেড স্বেচ্ছাচারি ভূমিকার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে নিজেদের ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার হিসেবে আখ্যা দিয়ে সিন্ডিকেটেড একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ উন্মুক্ত রাখার বিনিময়ে আবারো একতরফা নির্বাচনের পক্ষে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা আদায় করে নেয়ার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে।
আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত প্রভাব কাজে লাগিয়ে, বিনাভোটে কিংবা রাতের ভোটে যেসব ব্যবসায়ী-রাজনীতিকরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ডাকসাইটে ব্যবসায়ী। কোটি কোটি টাকায় মনোনয়ন বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে বিচারেই এরা সংসদ সদস্য হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে একেকজন ধনকুবের বনে গেছেন। একজন ব্যবসায়ীকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সিন্ডিকেট করে বাজারের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারসাজি দেখা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে, কিংবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দেশীয় বাজারে দ্বিগুন মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিক তৎপরতা থাকলেও বিশ্ববাজারে মূল্য অর্ধেক কমে গেলেও দেশীয় বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায়না। করোনা মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধকে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি ইম্প্যাক্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের মূল্য অনেক নিচে নেমে গেলেও বাংলাদেশে তার কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যই সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত। দেশের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও মূল ধারার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কোনো সরকারই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। দেশীয় রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে সরকারের একচ্ছত্র প্রভাব অতিক্রম করে দেশের জনগণের মধ্যে জনস্বার্থের বিষয়ে জনমত গঠনকে এখন আর ফ্যাসিবাদী কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তথাপি সরকার জনগণের স্বার্থের বদলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পক্ষেই কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে নিস্পিষ্ট সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে অগ্রাহ্য করা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, তখন বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনেকটা সেই নন্দলালের মত। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সংকট তৈরী হবে’। এর মানে কি, কোটি মানুষের পকেট কাঁটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার অপারগ? নাকি তাদের সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজি বন্ধের পদক্ষেপ নিলে সম্ভাব্য একতরফা নির্বাচনে পালের গোদা ব্যবসায়ীদের সমর্থন পাওয়া যাবে না? গত ১৫ বছর ধরে দেশে ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় যখন তখন মূল্য বাড়িয়ে রাতারাতি শত শত কোটি টাকা মুনাফা করার সুযোগ পেয়েছে কিছু সংখ্যক কর্পোরেট ব্যবসায়ী। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্দশা ও ক্ষোভ থাকলেও সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের যেন তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে নিত্যপণ্য তথা চাল-ডাল-আটা, চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ-মরিচের মত খাদ্যপণ্যের মূল্য সাধারণ দরিদ্র মানুষকে বেশি আক্রান্ত করে। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তি থাকলেও কোনো কোনো মন্ত্রী-আমলার বক্তব্য বাস্তবতার বিপরীত।
সম্প্রতি একই অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, সরকার কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়লেও বাংলাদেশে চালের দাম বাড়েনি, মানুষ ভালো আছে। বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে অস্বাভাবিক মুনাফাবাজির দায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উপর চাপানো হলেও আদতে ব্যাপারটা সম্পুর্ণ বিপরীত। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গতমাসে বিশ্ববাজারে খাদ্য মূল্য ছিল গত ২ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়তি সময়ে যে হারে মূল্য বর্ধিত করা হয়েছিল, বিশ্ব বাজারের মূল্য কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে আসার পরও মন্ত্রী-আমলারা মূল্যস্ফীতির পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন। একচেটিয়া বাণিজ্য ও অস্বাভাবিক মুনাফাবাজির কারণে সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবন যাত্রায় বড় ধরণের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। করোনাকালীন বাস্তবতা এবং পরবর্তী মন্দায় বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার তথ্য একটি বেসরকারী সংস্থার জরিপে উঠে এসেছিল। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)’র যৌথ উদ্যোগের এই জরিপ রিপোর্ট প্রকাশের পর গত দুই বছরে অর্থনীতিতে কোনো নতুন উদ্যোগ বা ইতিবাচক কোনো ফলাফল দেখা যায়নি। এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, বাণিজ্য বৈষম্য ও মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এ কারণে আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্গতিহীন দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। এসব বাস্তব বিষয় মেনে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও দলবাজ আমলারা উন্নয়নের ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন। দেশের প্রতিটি মানুষই ভোক্তা। দেশের কৃষক-শ্রমিকরা ভোগ্যপণ্যের কারিগর বিনিয়োগকারী ও আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্যের যোগানদার। দেশের ১৮ কোটি মানুষকে জিম্মি করে আমলা-মন্ত্রী ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হাজার হাজার কোটি টাকার বাড়তি মুনাফা করে বিদেশে পাচার করছে। তার যাঁতাকলে স্বল্প আয়ের কোটি কোটি পরিবার নতুন করে অতি দরিদ্র মানুষের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী-আমলা ও মন্ত্রী-এমপি’র অতি ধনী হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা না থাকলে সরকারের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকে না। আমলাতন্ত্র, পুলিশসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারী দলের অনুগত প্রতিষ্ঠানে পরিনত করার বিনিময়ে জনগণের রাজস্ব থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারী ও সাধারণ সদস্যদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা ও ইমিউনিটি দেয়া হয়। এবার আমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমাদের বিশেষ নজরদারি, নিষেধাজ্ঞার আলটিমেটাম থাকায় আমলা, এমপি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হয়তো নির্বাচনে আগের মত প্রকাশ্য যুদ্ধংদেহী পক্ষপাতিত্ব করতে পারবে না। এমতাবস্থায়, সরকারের সবচেয়ে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান না জানিয়ে বিগত দুইটি নির্বাচনের অনুরূপ একদলীয় নির্বাচনের পক্ষে লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছে? সমাজের যে শ্রেণীর মানুষ দেশ থেকে অর্থ পাচার করে দেশে ডলারের সংকট সংকট সৃষ্টি করেছে, যে শ্রেণীটি মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছে, যাদের কারণে দেশের মানুষ গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী সেই শ্রেণীটি দেশের ক্রান্তিকালে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনের বদলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অস্বচ্ছতা, সংঘাত ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিভক্তি জিইয়ে রাখতে চাইছে! দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও পশ্চিমা উন্নয়ন ও বাণিজ্য অংশীদাররা যখন একই সুরে দেশে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে, একদিকে এক দফার আন্দোলন, অন্যদিকে ভিসা নীতি, র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞাসহ নতুন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন প্রকৃত সমস্যার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লেজুদবৃত্তির ভূমিকা সংকটকে আরো ঘণীভূত করতে পারে।
বাংলাদেশে চলমান সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সামগ্রিকভাবে আমাদের পিছিয়ে পড়ার ইঙ্গিত বহন করছে। রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সংকট হতেই পারে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, নানা চড়াই-উৎরাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে জনগণের সাধারণ ঐক্য ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমরা আবারো টোটালিটারিয়ান রিজিমের বদনাম নিয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছি! গত দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচন একপাক্ষিক দলীয় নির্বাচন হওয়ায় দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। সরকার গঠনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের রোডম্যাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ না থাকায় গণতান্ত্রিক বিশ্বের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ পড়ে গেছে। ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে হাইব্রিড রিজিমে পরিনত হয় বাংলাদেশ। সরকারের পক্ষ থেকে উত্তরণের কোনো উদ্যোগ না থাকা এবং মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্রমাগত অবনতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। উপরন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গুম-খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশের এলিট ফোর্স র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জারি করা মার্কিন ভিসা নীতি জাতির জন্য অপমান ও লজ্জাজনক। এতকিছুর পরও রাজনীতিতে কোনো আশাব্যঞ্জক সুফল দেখা যাচ্ছে না। এখনো সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফা নির্বাচনের আস্ফালন চলছে। ওরা যেন মরুভ’মির উটপাখির মত বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় অতিক্রমের চেষ্টা করে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা কূটনৈতিক কর্মকা-ের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অনেক দূর এগিয়েও কিছু করতে পারছে না। দেশীয় অংশীজনদের নিস্ক্রিয়তা, নিরবতা ও ক্ষেত্রবিশেষে বিপরীতমুখী আচরণের কারণে বিদেশি শক্তি নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছে। দেশের গণমাধ্যম, তথাকথিক সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো আগেই দুর্বল ও দলীয় সংগঠনে পরিনত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতির ক্রান্তিকালে সংকট সমাধানে ভূমিকা পালনের সক্ষমতা হারিয়েছে।
বিগত দশকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ তিউনিসিয়ায় এক জটিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের সময় সাধারণ মানুষের তুমুল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সউদী সমর্থিত বেন আলির স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। অনেকটা আমাদের দেশে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মতো। এরপর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রশ্নে তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ, অনাস্থা ও অচলাবস্থার মুখে পতিত হয় দেশ। সরকার ও বিরোধীদলগুলোর মুখোমুখী সাংঘর্ষিক অবস্থায় মধ্যস্থতা ও ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন এক নারী উদ্যোক্তা। তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ হেদি বৌচামাউই গ্রুপের সিইও, তিউনিসিয়ার কনফেডারেশন অব ইন্ডাসট্রির প্রেসিডেন্ট ওইদেদ বৌচামাউই। তিনি দেশের প্রধান চারটি সংস্থা সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি, ট্রেড ইউনিয়ন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে তিউনিসিয়ান ডায়ালগ কোর্য়াট্রেড গঠন করেন। তাদের মধ্যস্থতায় একটি জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক উত্তরণ নিশ্চিত হয়। সেই সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৫ সালে তিউনিসিয়ার ডায়ালগ কোয়ার্ট্রটেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূসিত করা হয়। বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতা তিউনিসিয়ার সে সময়ের অচলাবস্থার মত জটিল না হলেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবগুলো পরাশক্তির নজরদারির কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীনের খবরদারি ও কূটনৈতিক রশি টানাটানির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে এ দেশের জনগণের প্রত্যাশা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা। বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার প্রত্যাশিত সমঝোতা ও গণতন্ত্রে উত্তরণের পথরেখা উন্মোচন ও মানবাধিকারের টেকসই উন্নয়নে এ দেশের সিভিল সোসাইটি, এফবিসিসিআই’র মত ব্যবসায়ী সংগঠণগুলো যদি কার্যকর ভ’মিকা রাখতে রাখতে পারত, তাহলে তিউনিসিয়ান ডায়ালগ কোয়ার্ট্রটে এর মত বাংলাদেশের মধ্যস্থতাকারীরাও শান্তিতে নোবেল পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারে। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়া আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় সমান হলেও বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১০ গুণের বেশি। বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক ডায়াসপোরা অনেক বড়। তিউনিসিয়ার মোট জনসংখ্যার সমান বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে বসবাস করছে। চীন-ভারতের মাঝখানে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে এখন বিশ্বের চোখ। আর এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক
জমকালো আয়োজনে পালিত হলো বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী