নির্দলীয় সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

২০ জুলাই ২০২৩, ০৮:০০ পিএম | আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৩, ১২:০৫ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে চার সদস্যর দলগত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছে। এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কিভাবে অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করা যায়, এ নিয়ে আলোচনা করা। উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিবসহ নাগরিক সমাজের সদস্যদের সাথে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সবদলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন চায়। তিনি এ কথাও বলেছেন, কোনো দলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উজরা জেয়ার বক্তব্য স্পষ্ট। তবে এখানে তিনি যে কথাটি উল্লেখ করেননি তা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে। দেশের রাজনীতি কিংবা নির্বাচনের মূল সমস্যা এটি। বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধীদল স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, আগামী নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। বর্তমান সরকারের অধীনে হবে না এবং হতে দেয়া হবে না। তবে উজরা জেয়ার বক্তব্যে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের যে কথাটি রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় যে, আগামী নির্বাচন করতে হলে, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এর কারণ হচ্ছে, সরকার তার জোট বা সমর্থক দল নিয়ে অংশগ্রহণমূলক দেখালে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ইতোমধ্যে ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ভারত ছাড়া অন্যকোনো দেশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ, দেশের বৃহত্তম বিরোধীদল, যার বিপুল জনসমর্থক রয়েছে এবং গড়ে ৪০ শতাংশ মানুষের সমর্থনপুষ্ট, তাকে বা তার সমর্থকদের বাদ দিয়ে প্রকৃত অর্থে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন হয় না। কাজেই আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে হলে বিএনপি ও তার সমর্থক দলগুলোকে বাদ দেয়া যাবে না। আর তাদের অংশগ্রহণ করাতে হলে তাদের দাবি মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি উজরা জেয়ার কথার অন্তরালে এ বিষয়টি লুকায়িত রয়েছে? থাকতে পারে। এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিএনপি ও তার সমর্থক দলগুলো যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে তা ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে না। ফলে ‘অংশগ্রণমূলক’ করতে হলে বিএনপি ও তার সমর্থক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অপরিহার্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ’৯১-এর পর প্রত্যেক সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, এ নিয়ে রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ এরশাদের পতনের আগেই সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তবে এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন শেষ হতে না হতেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়ে যায়। দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অসহনশীলতা, অনাস্থা, অবিশ্বাস ও একগুঁয়েমির কারণে রাজনীতি স্থিতিশীল হতে পারেনি। ’৯১-এ ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ শেষে ’৯৬ সালে বিএনপি নিজের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামীলীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনÑসংগ্রাম শুরু করে। তখন বাধ্য হয়ে বিএনপিকে ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন করতে হয় শুধু সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যুক্ত করার জন্য। সংগতকারণেই সবাই ধরে নিয়েছিল, সংবিধান অনুযায়ী, পরবর্তী নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে থাকবে। ’৯৬Ñএ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ শেষে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নিজের পছন্দের লোক বসানোর অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদল আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। ‘নীলনকশা’র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করে। বিএনপি সে বছর ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধীদল সে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে তা প্রত্যাহার করলে এক গভীর সংকট সৃষ্টি হয়। এই সংকটকালেই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং তাদের স্বাগত জানায়। এ সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল বলেও ঘোষণা দেয়। সে সময় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাকে ওয়ান-ইলেভেন সরকার হিসেবে অভিহিত করা হয়, সে দুই বছর ক্ষমতায় থাকে এবং শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পরবর্তীতে নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট তিনÑচতুর্থাংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচিত হয়েছিলো, তারাই পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায় উল্লেখ করে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা দ্রুত বাতিল করে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার যুক্তি হিসেবে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ সরকার অনির্বাচিত। তার অধীনে নির্বাচন করা গণতান্ত্রিক ধারার পরিপন্থী। কাজেই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে নির্বাচন হবে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে। বলা বাহুল্য, সে সময় সরকারের এই ব্যাখ্যা, গণতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত ব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তা ছিল অসম্ভব। কারণ, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এমন কোনো সুসম্পর্ক বা একে অপরকে বিশ্বাস করার মতো সম্পর্ক কোনোকালেই গড়ে ওঠেনি। এক দলের অধীনে আরেক দল নির্বাচনে বিজয়ী হবেÑএমন বাস্তবতা ও বিশ্বাস কখনোই ছিল না এবং এখনও নেই।

দুই.
আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বর্তমানে যে অনড় অবস্থান তা থেকে তারা সরে আসবে, আপাতত এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপিও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে অনড় অবস্থান নিয়েছে। ফলে দেশে যে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ইতোমধ্যে বিএনপি’র এক দফা সরকার পতনের আন্দোলনে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছে। যত দিন যাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠার আশংকা রয়েছে। এটা এখন প্রায় সকলেই একমত যে, নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। অথচ ক্ষমতাসীন দল চাইলে এই সমস্যার সমাধান অনেক আগেই করা যেত। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া খুবই সম্ভব ছিল। প্রথমত, আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পাশাপাশি পরবর্তী দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে। তখন প্রত্যেকটি দলই পরবর্তী দুইটি নির্বাচনের পর দলীয় সরকারের অধীনে হবে বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিতে পারত। এতে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হতো। দ্বিতীয়ত, সরকার যদি তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং বিরোধীদলকে দমনÑপীড়ন ও নির্মূল করার প্রক্রিয়া অবলম্বন না করত এবং তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ দিত, তবে রাজনৈতিক পরিবেশ খুবই সহনশীল হয়ে উঠত। এর কোনটিই না হওয়ার ফলে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রীÑএমপিরা তাদের অধীনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করবে বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন, তা সফল হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একদিকে প্রধান বিরোধীদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ হাজার হাজার কর্মীদের মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো এবং দলনÑপীড়নে কোনঠাসা করে ফেলা, অন্যদিকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশ্বাস এক ধরনের প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। অনেক সরকার সমর্থক বিভিন্ন টক শোতে প্রায়ই বলে থাকেন, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ক্ষমতাসীনদলের অধীনে কোন না কোন সময় নির্বাচন শুরু করতেই হবে। তারা উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেম টেনে আনছেন। তারা এ বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন না, ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে নির্বাচন করতে হলে বিরোধীদলের আস্থা অর্জন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরী। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে বিরোধীদলের উপর দমনÑপীড়ন করে তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয় না। সেখানে সরকার ও বিরোধীদলের মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও পারস্পরিক সহবস্থান ও বিরোধীদলের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয় না। তারা শুধু দল ও তার নেতা-কর্মীদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে না। তারা দেশের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে দলকে নয়, দেশকে প্রাধান্য দেয়। আমাদের সরকারের মধ্যে এ চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় না। এ কারণেই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরী। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সরকারের মনে যদি এ শুভবুদ্ধির উদয় হয়, বিরোধীদলকে আস্থায় নেয়ার জন্য তাদের নেতাÑকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে হয়রানীমূলক মামলা না দেয়া এবং তা প্রত্যাহার ও মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল করা সম্ভব। অন্যদিকে, বিগত একদশকে বিরোধীদলের প্রতি ক্ষমতাসীন দল যে আচরণ করেছে, তাতে তাদের মনের ক্ষোভ দ্রুত নিরসন হবে এবং তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, এমন আশা করা কঠিন। যেমনটি বর্তমান সরকারের নেতাÑকর্মীরাও বিগত জোট সরকারের আচরণের কথা এখনও স্মৃতিচারণ করেন। তবে কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়, যদি সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্টরা পারস্পরিক দোষারোপের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে পারস্পরিক সহবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা হয়। এজন্য রাজনীতিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং গণতান্ত্রিক আচরণ ও কথাবার্তা প্রয়োজন। কথা ও আলাপ-আলোচনা হলে সমস্যার সমাধান দ্রুত হয়। রাজনীতিতে এখন সংলাপের বিষয়টি উচ্চারিত হচ্ছে। উজরা জেয়াও সংলাপের কথা বলে গেছেন। সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল একবার বলে বিএনপির সাথে সংলাপ হতে পারে। আবার পর মুহূর্তেই তা উড়িয়ে দিয়ে প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করছে। এ কারণেই রাজনৈতিক সংকট নিরসন হচ্ছে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক সংঘাত-সংর্ঘষ এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই। তারা বলেছেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সব সময়ই সরকার ও বিরোধীদলের সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপকে বৃহৎ পরিসরে দেখা উচিত। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সরকার যদি আন্তরিকভাবে বিরোধীদলকে আস্থায় নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেত, তবে রাজনৈতিক এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হতো না। রাজনীতি তো বটেই যেকোনো রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরস্পরের সংলাপ করা জরুরী। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে মতের বিরোধিতা থাকলেও দেশের স্বার্থে পারস্পরিক সমঝোতা থাকা দরকার। দুঃখের বিষয়, আমাদের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে বিরোধ লেগেই আছে। এক দল আরেক দলকে সহ্য করতে পারে না।

তিন.
আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই হয়নি। এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। এ ধরনের একটি উদাহরণও নেই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মানসিকতা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গড়ে উঠেনি। দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল একে অপরকে শত্রু মনে করে। ফলে একে অপরের অধীনে নির্বাচন করবে, এটা কল্পনাও করা যায় না। এখন যেমন বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায় না, একইভাবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগও নির্বাচন করতে চায়নি। ভবিষ্যতে করবে কিনা, তা অনিশ্চিত। তা করতে হলে উভয় দলকেই একে অপরের প্রতি সহনশীল হতে হবে। আপাতত এ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, ক্ষমতায় থাকার জন্য দুই দলের যেটি যখন ক্ষমতায় যায়, সেটি প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে দলীয়করণ করে। প্রশাসনকে প্রশাসনের মতো চলতে দেয় না। দলীয় আনুগত্যের নিরিখে প্রশাসন পরিচালনা করা হয়। দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতা সম্পন্ন দলের অনুগত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। সরকারের এ বিশ্বাস থাকে, অনুগত কর্মকর্তারা নির্বাচনে তাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ ধারণা যে ভুল, অতীতে তা বহুবার দেখা গেছে। যখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে, তাদের সাজানো প্রশাসন ভেঙ্গে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় বা রাষ্ট্রের প্রকৃত ইন্সট্রুমেন্টে পরিণত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রশাসনিক পুর্নবিন্যাসে বিগত যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো সুষ্ঠু ও দেশÑবিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে প্রশাসন দলীয়করণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। অনেক কর্মকর্তাকে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বাভাবিক নিয়মে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কথাবার্তা বলার কোন কারণ নেই। তারা কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে পারেন না। তাদের এই রাজনৈতিক চর্চা অগ্রহণযোগ্য। তবে বিগত এক দশকে প্রশাসনকে দলীয়করণের ফলে একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে দলীয় লোকের মতো আচরণ করতে দেখা গেছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার জরুরী। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা ছাড়া বিকল্প নেই। দলীয় আনুগত্যের প্রশাসন দিয়ে কোনভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। শুধু প্রশাসন নয়, নির্বাচন কমিশনকেও দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা প্রয়োজন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার, যার অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন হোক না কেন, প্রশাসনকে পেশাদার ও নিরপেক্ষ করতে না পারলে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যে প্রশাসনকে সরকারের অনুগতদের দিয়ে সাজিয়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

চার.
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিরোধীদলগুলো ক্ষমতাসীন দলের অধীনে ’৯৬ এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো। বিরোধীদলগুলো ভালো করেই জানত, সে সময়ের সরকারের সাজানো প্রশাসন দিয়ে কোনভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়েছিল বলেই সেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। আগেই বলা হয়েছে, প্রধান দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক এমন কোন আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত হয়নি যে, একে অন্যের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। ক্ষমতাসীন সরকার যতই বলুক, তাদের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসনের উপর কোন হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা হবে না, তারা রুটিন ওয়ার্ক করবেÑতাদের এ কথা সচেতন মহলে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বর্তমান প্রশাসন যেভাবে দলীয়করণ এবং নির্দেশনামূলক অবস্থায় রয়েছে, তাতে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজন নেই। প্রশাসন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের পক্ষে কাজ করবে। এ বাস্তবতায় নির্দলীয় ও দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক