বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ
২৬ জুলাই ২০২৩, ০৯:২৩ পিএম | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০৭ এএম
আগে বর্ষায় পুরো চলনবিল কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে হয়ে যেত সমুদ্র। তখন নদী এবং দহ আর পৃথক করে চেনা যেত না। ভাদ্র আশ্বিনেও পানি জমে থাকত উঁচু জমির পাশে। সেই পানিতে অজ¯্র চেলা, কাঁকাল প্রভৃতি ছিল। ছিপে উঠত রাশি রাশি। আলপিন বাঁকিয়ে বড়শি তৈরি করত লোকজন। সেই বড়শির সাহায্যে ধরত এদের।
আশ্বিনের শেষে চলনবিলের পানি নেমে যেত। দেখা যেত পানিতে টুইটম্বুর সেই নদী এবং দহ। কার্তিকে আসত মাছের ব্যবসায়ীরা। তাদের একজনের সঙ্গে বহু আগে পরিচয় হয়েছিল। তার নাম আব্দুল মুত্তালিব। আসত পাবনা শহর থেকে। দহে মাছ ধরার ইজারা নিত। কার্তিকে শুরু হতো দহে মাছ ধরার পালা। কত রকম যে মাছ। রুই, কাতলা, কালবাউস, সরপুঁটি, বিথে, বোয়াল, আড়, চিতল, পাবদা, চিংড়ি, বাচা, ফলি আরও কত রকমের মাছ। কী বিশাল তাদের আয়তন। দশ-পনেরো কিলোর রুই, কাতলা দেখেছি। দেখেছি পাঁচ-সাত কিলোর আড়, বোয়াল এবং চিতল। দেখেছি খয়রা মাছ-রূপোর মতো ঝক্ঝকে। কাঠের বাক্স এবং বাঁশের চাঁচ দিয়ে তৈরি ডোলে পুরে সেই মাছ চালান হতো ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিদিন ফাল্গুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। সে সময় নাকি কুড়ি-পঁচিশ কিলোর কাছিমও পাওয়া যেত। পানি কমলে শুরু হতো মাগুর, শিঙ্গি, ভেদা এবং কই মাছ ধরার পালা।
সে সব এখন গল্প। এক সময় এ অঞ্চলটি ছিল মাছের আকর। এখন মাছ শূন্য। সংস্কারের অভাবে এবং উজানে বিশেষ করে ভারতের বড় বড় নদীর পানি বাঁধ দিয়ে আটকানোর ফলে বহু নদী এবং জলাশয় মজে গেছে, মাছ এখন দুর্লভ। বলতে কি, শুধু বাংলাদেশেই নয়, একই অবস্থা পৃথিবীর বহু দেশে। পদ্মা, মেঘনায় এখন আর আগের মতো ইলিশ দেখা যায় না। পুকুর ডোবা জলাশয়ে শিঙ্গি মাছের উৎপাদন দারুণভাবে কমে গেছে। কেন এমন হলো? কারণ, গত পঞ্চাশ বছর ধরে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক এবং জীবাণুনাশক তথা রাসায়নিক যৌগ, যাদের ইংরেজিতে বলা হয় ‘পেস্টিসাইডস’। সেই বিষের দরুন জলাশয়ে কই, মাগুর, শিঙ্গি আর বেঁচে থাকতে পারে না। নদীর পানিও দূষিত হয়। মারা পড়ে ডিম এবং পোনা।
জমির অতিরিক্ত সার বর্ষার পানির তোড়ে পুকুর খাল বিল নদীতে পড়ে। সেই সার জলজ গাছপালা দারুণভাবে বাড়ায়। জলজ গাছপালার জঙ্গলে মাছের পক্ষে বাস করা শক্ত হয়। অতিরিক্ত গাছের দরুন পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে। এমন অবস্থায় মাছের বাচ্চা, ডিম, এমনকি বয়স্ক মাছও মারা পড়ে। বাড়তে পারে না। অতিরিক্ত চাষের দরুন জমির মাটি আলগা হয়। বাতাস এবং পানির প্রবাহে সেই মাটি জলাশয়ে পড়ে। এর ফলে বহু নদী-নালা-বিল, পুকুর মজে যায়। মাছের বাস করার ঠাঁইটুকুও এখন গেছে কমে। প্লাবন রোধ করতে তৈরি হয়েছে প্রচুর বাঁধ-রাস্তা। এর ফলে বর্ষার সময় পানির ¯্রােতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাছ, মাছের চারাপোনা এবং ডিম আগের মতো যাতায়াত করতে পারে না। তাই নদী, খাল, বিল, জলাশয়ে এখন মাছের এত অভাব। প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধার উপর মানুষ যেমন নির্বাচন করে তার বাসস্থান, ঠিক তেমনি মাছও সুযোগ বেছে নেয় তাদের সহজে বাস করার মতো এক একটি অঞ্চল। কোনো কারণে সেখানে গোলমাল ঘটলেই উদ্বাস্তুর মতো তারা সেই জায়গাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। নতুন অঞ্চলে গিয়ে কোনো কোনো মাছ কোনো রকমে নিজেদের টিকিয়ে রাখে, আবার অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়। সেখানকার প্রতিকূল আবহাওয়া, শত্রুভাবাপন্ন জলজ প্রাণী, খাদ্যের অভাব এবং জীবাণুর আক্রমণে মাছ মারা যায়। ইদানীং নদী এবং সমুদ্র উপকূলে তৈরি হয়েছে বন্দর। এখনও তৈরি হচ্ছে। সেইগুলোও মাছের বাসস্থানে বিপর্যয় ঘটায়।
না, শুধু স্থলভাগই নয়। বিপর্যস্ত এখন সাগর মহাসাগরেরও মাছ। মাছ মানুষের মূল্যবান প্রোটিন খাদ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মাছেরও চাহিদা বেড়েছে প্রচুর। সাগর মহাসাগর মাছের বৃহত্তম ভাঁড়ার। বিভিন্ন দেশে এখন সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য বড়ো বড়ো জালে ধরা পড়ে এমনও মাছ অথবা প্রাণী, যা মানুষের খাদ্য নয়। জালে পড়ে ওই সব প্রাণী মারা যায়। অথচ, তারাই অন্যান্য মাছের খাদ্য। এর ফলে যেসব মাছ আমরা খাদ্য হিসেবে পেতে চাই, তাদের খাবারে পড়ে টান। তারা মারা যায়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমুদ্রে চড়া মাছ এবং অপুষ্ট মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু কে শোনে সে কথা? দেশের নিজস্ব সমুদ্র অঞ্চলের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু উন্মুক্ত যেসব অঞ্চল, আন্তর্জাতিক সীমানার বাইরে সেখানে কোনো দেশই বাধা দিতে পারে না। ওইসব অঞ্চলে যেসব মাছ ধরার কথা নয়, তাদেরও ধরা হয়। ডিম পাড়ার বয়সের আগেই ধরা হয় নানান মাছ। তাই সাগর-মহাসাগরেও বহু মাছ কমে গেছে।
গত কয়েক দশক ধরে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মাণ, নদীর ধারে ইটভাটা তৈরি ও নিজেদের প্রয়োজনে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে কলকারখানার নোংরা পানি নদীতে ফেলা ইত্যাদি কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন স্থানগুলো বিনষ্ট প্রায়। মাছের ডিম ফোটার জন্য দরকার পানির স্রোত, সঠিক মাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেন ও নির্দিষ্ট কতকগুলো ভৌত রাসায়নিক গুণাবলিযুক্ত পানি। আমাদের দেশের অধিকাংশ বড় ও ছোট নদীতে এ অবস্থা বিদ্যমান নেই। এরপর আছে নদী সংযুক্তিকরণের মতো বিপদ, যাতে দূষিত নদীর পানি কলুষিত করবে অন্য অদূষিত নদীগুলোকে। তাই দেশীয় বড় কার্প মাছগুলোকে কৃত্রিমভাবে ডিম ফুটিয়ে ধরে রাখলেও মাছের বংশ ধরে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাঘ, কুমির, পাখিদের জন্য সরকারি ব্যবস্থা হলেও এদের ব্যাপারে কেউ খেয়াল করে না।
মাছ সংরক্ষণের জন্য ১৮৯৭ সালে ওহফরধহ ঋরঝযবৎরবঝ অপঃ নামে একটি আইন ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তন করে, সেটি বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে নুতন নতুন আইন করা হচ্ছে, যাতে পানি দূষণের প্রতিরোধ, মাছ ধরার জালের নির্দিষ্ট মাপের কথা, বিস্ফোরক ও বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে মাছ ধরা নিষেধ। এছাড়া প্রজনন ঋতুতেও মাছ ধরা নিষিদ্ধ। অপরিণত মাছ ধরা নিষেধ করা হলেও মানুষের লোভ এগুলোকে তোয়াক্কা করে না। আমাদের দেশে মাছ ধরার ব্যাপারে আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। অবাধে চলে মাছের পোনা নিধন। তাহলে উপায় কী?
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, মাছ কমে যাচ্ছে। কমে গেছে কড, জ্যাক ম্যাকেরাল, আনকোডেটা, পিলকার্ড, হ্যাডসক ব্লফিন টুনা, ডগ ফিশ, সামুদ্রিক বোয়াল প্রভৃতি। অনেক জায়গায় এসব মাছ প্রায় বাড়ন্ত। সমুদ্র উপকূলে বন্দর তৈরির দরুন বহু মাছ উদ্বাস্ত। তা ছাড়া, পানি দূষণ তো আছেই। নানা রকম মাছকে এখন পশুখাদ্য হিসাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। তাতেও সামুদ্রিক মাছের উপর প্রভাব পড়ছে। এই অবস্থা চললে পুকুর, জলাশয়, নদীতে ভবিষ্যতে দেশীয় মাছের আকালই শুধু নয়, সমুদ্রের বহু প্রজাতির মাছ কোনো কোনো অঞ্চলে প্রায় অবলুপ্তই হয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত
চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজন ধারালো অস্ত্রাঘাতে হত্যা;আহত ৫
চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ,দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার
গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু
সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার
নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা
ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০
আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!
ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ
তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী
গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ