বরেন্দ্র এলাকার সংকট দ্রুত নিরসন করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৫ আগস্ট ২০২৩, ০৮:০৯ পিএম | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

বরেন্দ্র এলাকায় ভুগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। শুধু বরেন্দ্র এলাকা নয়, গোটা উত্তরাঞ্চলেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর নিচে নামছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কম বৃষ্টিপাত, খরা এবং কৃষি, শিল্প, মৎস্যচাষ ইত্যাদির জন্য ভূগর্ভস্থ পানির বেপরোয়া উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। দৈনিক ইনকিলাবের এক খবরে বিশেষজ্ঞদের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে রাজশাহীর তানোরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ১১৩ ফুট। ১৯৯০ সালে সেখানে পানির স্তর ছিল ৬৮ ফুট নিচে। খবরে এও বলা হয়েছে, গত ১০ বছরের পানির স্তর অন্তত ১০ ফুট নিচে নেমেছে। যেখানে ২০১০ সালে পানির স্তর ছিল ৫০ ফুট নিচে, সেখানে এখন ৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। আশংকার বিষয়, গত বছর পানির স্তর ২ ফুট নিচে নেমে গেছে। বরেন্দ্র এলাকাসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলে পানির প্রাকৃতিক উৎসসমূহ, যথা: নদনদী, খাল-বিল, জলাভূমি, দিঘী-পুকুর ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মক পানি সংকটের শিকার। এসব প্রাকৃতিক উৎসে পানির যোগান আসে মূলত পদ্মা-তিস্তাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদনদী থেকে। প্রতিবেশী ভারত পদ্মা-তিস্তা প্রভৃতি অভিন্ন নদনদীতে বাঁধ দিয়ে নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে শুকনো মওসুমে উত্তরাঞ্চলে মারাত্মক পানির সংকট দেখা দেয়। নদনদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। খাল-বিল পুকুর-ডোবা শুকিয়ে যায়। পদ্মা-তিস্তার মত নদীও মরা খাল-বিলের আকার ধারণ করে। বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠে নদনদীর বুকে। ফারাক্কা ও গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে ভারত গঙ্গা (পদ্মা) ও তিস্তার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যান্য অভিন্ন নদনদীর পানিও একইভাবে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের এই পরিকল্পিত পানি ছিনতাই বাংলাদেশের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে এসেছে। অনেক আগেই উত্তরাঞ্চলে মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেখা দিয়েছে লবণাক্ততার বিস্তার। পানির অভাবে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পÑ তিস্তা সেচ প্রকল্প এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্পÑ গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প এখন প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। এই দুই সেচ প্রকল্প যথাক্রমে তিস্তা ও পদ্মানদীর পানির ওপর নির্ভর করে নেয়া হয়েছিল। তিস্তা ও গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প পরিকল্পনা মোতাবেক বাস্তবায়ন ও কার্যকর হলে খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে অনেক আগেই দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বড় রকমের রফতানিসক্ষম দেশে পরিণত হতো। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভারতের সদিচ্ছার অভাবই এর একমাত্র কারণ। গঙ্গার পানি চুক্তি হলেও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পায় না। তিস্তা চুক্তির মূলা এখনো ঝুলছে।

ভারত যদি অভিন্ন নদ-নদীর পানি এভাবে জবরদস্তিমূলকভাবে সরিয়ে না নিতো, নদ-নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকতো তাহলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানির এমন অভাব বা আকাল দেখা দিতো না। আবাদ-উৎপাদন, শিল্প ও মৎস্যচাষ ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় পানি ভূগর্ভ থেকে তুলতে হতো না। বিভিন্ন কাজে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলেই পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পতিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি পড়ছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বাংলাদেশের ঋতুচক্র, প্রকৃতি ও পরিবেশের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত আগের তুলনায় কমে গেছে। শীতের প্রকোপ হ্রাস পেয়েছে। অনাবৃষ্টি, খরা, দাবদাহ, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, ভূকম্পন ইত্যাদি চরম ও বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার জন্য বৃষ্টিহীনতা ও খরাও দায়ী। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে সেচের পানির অভাবই দেখা দিচ্ছে না, শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও পানির সংকট হচ্ছে। এমন কি খাবার পানির সংকটও দেখা দিচ্ছে। দৈনিক ইনকিলাবের উত্তরাঞ্চলের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, নলকূপে পানি উঠছে না, এমনকি গভীর নলকূপেও কোনো কোনো এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানি না পাওয়ার অর্থ, সেচ ব্যহত হওয়াই কেবল নয়, খাবার পানিরও সংকট দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি একটি ভয়ংকর আশংকায় তাড়িত না করে পারে না। পানির অভাব বা ঘাটতি মরুবিস্তার দ্রুতায়িত করবে। জমি বন্ধ্যা হয়ে যাবে বা উৎপাদনসক্ষমতা হারাবে। আবাদ-উৎপাদন ব্যাহত হবে। প্রকৃতি-পরিবেশে বিরূপ পরিস্থিতি দেখা দেবে। অভাব-দারিদ্র বাড়বে এবং শেষাবধি মানুষকে উদাস্তু হয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। একথা কারো অজানা নেই, বিশ্বের যেখানে যেখানে মিঠাপানির সহজপ্রাপ্তি ও প্রাচুর্য বিদ্যমান, মানববসতি ও মানবসভ্যতার বিকাশ সেখানে সেখানেই হয়েছে। পানির অপর নাম জীবনই কেবল নয়, সর্বক্ষেত্রেই পানির প্রয়োজন ও অপরিহার্যতা প্রশ্নাতীত। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে ভূগর্ভে একটা শূন্যতা তৈরি হয়। পানির পুনর্ভরণ যদি যথাসময়ে ঠিক মতো না হয়, তাহলে ভূগর্ভের স্থিতিস্থাপকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিধস বা ভূমিবিপর্যয় ঘটার আশংকা তৈরি হয়। লক্ষ করার বিষয় এই যে, ভূগর্ভ থেকে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সেই পরিমাণ পানি পানির স্তরে জমা হচ্ছে না। এর কারণ, বৃষ্টিপাত কম হওয়া। যেমন, এবার জুলাই মাসে মাত্র ২১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাধারণত এমাসে গড়ে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।

বরেন্দ্র এলাকার সংকট বা উত্তরাঞ্চলের সংকট মূলত দেশেরই সংকট। খাদ্যশস্য, গম, রবিশস্য, ফল-ফলাদি, শাক-সবজি, তরিতরকারি ইত্যাদি উৎপাদনের ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চল দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এগিয়ে। বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যের ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের যোগান আসে উত্তরাঞ্চল থেকে। তাই বরেন্দ্র এলাকাসহ উত্তরাঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, জাতীয় পর্যায় থেকে গুরুত্ব দিয়ে সেটা ভাবতে হবে। বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেছেন, পরিস্থিতি উত্তোরণে নতুন পুকুর-খনন, বিদ্যমান পুকুর পুনর্খনন, কম পানি লাগে, এমন ফসলের আবাদ বাড়ানো এবং ভূগর্ভে কৃত্রিমভাবে পানি রিচার্জে জোর দিতে হবে। তিনি কার্যত পানির প্রাকৃতিক উৎস ব্যবহার, পানির পরিমিত ব্যবহার এবং পানি পুনর্ভরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার এই পথনির্দেশ বাস্তবায়নে সরকার অগ্রাধিকার দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ পরামর্শের বিকল্প নেই। সরকার এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। যেহেতু অভিন্ন নদ-নদীর পানি ভারতের তরফে একচেটিয়া প্রত্যাহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এ সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী, সুতরাং একইসঙ্গে সরকারকে অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আরো সক্রিয় হতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন

আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী

আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'

বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন

পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের

পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ

পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ

পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়

নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়

জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭

নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭

রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ

রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ

ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা

ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা

উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা

ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা

উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল

উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল