চট্টগ্রামে এই দুঃসহ পানিবদ্ধতা কেন?

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৭ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩৪ পিএম | আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০২ এএম

গত তিন-চার দিন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে; কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। মানুষের বাসা-বাড়িতেও পানি। তাদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার সীমা-পরিসীমা নেই। অঝোরে বৃষ্টিপাত এবং সাগরের জোয়ার এই দুঃসহ পানিবদ্ধতার কারণ। অবশ্য পানিবদ্ধতা চট্টগ্রাম শহরে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটা অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজট ও পানিবদ্ধতা চট্টগ্রামের প্রধান দুটি সমস্যা হলেও পানিবদ্ধতাই এক নম্বর সমস্যা বলে চিহ্নিত। যখন-তখন সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি যোগ হলে পানিবদ্ধতার পরিধি ও পানিস্ফীতি বাড়ে। যেমন, এখন সেটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। চলতি বছরের ৭ মাসে অন্তত ১০ বার চট্টগ্রাম শহর পানিবদ্ধতার শিকার হয়েছে। অধিবাসীদের অধিকাংশ চরম অসহায়ত্ব ও বিপন্নতার সম্মুখীন হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনেকে সর্বস্ব খুইয়েছে। ঘন ঘন পানিবদ্ধতার সম্মুখীন হওয়ার ফলে কাটা পাহাড়-টিলার পরিত্যাক্ত মাটি পানির সঙ্গে মিলে শহরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এই কাদামাটি ও ময়লা-আবর্জনায় শহরের নালা-নদর্মা পূর্ণ হয়ে পানিনিকাশ ক্ষমতা হারিয়েছে। পানি দ্রুত না সরতে পারার এটাই মূল কারণ। এ মুহূর্তে শহরময় ময়লা-আবর্জনা ও কালো পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। ওদিকে শহরের রাস্তাঘাট ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে আছে। খান্দাখন্দ ও ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। যান চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ এ অবস্থায় কতটা নিরুপায় হয়ে পড়েছে, সহজেই অনুমেয়। তাদের দেখভাল করার ও দুঃখ-দুর্ভোগ মোচনের জন্য যেসব ‘সেবাদানকারী’ সংস্থা আছে, যেমন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাউবো) পরিবেশ অধিদফতর ইত্যাদি কোনোই কাজে আসছে না। তারা পানিবদ্ধতার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে। দায়িত্ব নিয়ে কেউই গণদুর্ভোগ নিরসনে এগিয়ে আসছে না। পর্যবেক্ষকরা সঙ্গতকারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছেন, চট্টগ্রামবাসীরা যেন এতিম, অভিভাবকহীন। এ মন্তব্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কারো জন্যই সুখকর-সস্তিকর নয়। তাদের আরো অভিমত, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতাই এ দুঃখজনক অবস্থার জন্য দায়ী।

দেশের প্রধান শহর ঢাকার পরিস্থিতিও চট্টগ্রাম শহরের অনুরূপ। যানজটে এ শহর প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রী ও যানবাহন আটকে থাকে রাস্তায়। যানজটে মানুষের আর্থিক-মানসিক ক্ষতির শেষ নেই। ফ্লাইওভার, বিআরটি, মেট্রোরেল ইত্যাদি এত কিছু করা হচ্ছে; কিন্তু যানজট এতটুকু কমছে না। অন্যদিকে সামান্য বৃষ্টিতে শহরের বিভিন্ন এলাকা পানিবদ্ধতার কবলে পতিত হচ্ছে। আগে কিছু নিচু এলাকায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হতো; এখন উঁচু বলে কথিত এলাকাতেও পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হতে দেখা যায়। পানিবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; কিন্তু পানিবদ্ধতা এতটুকু নিরসিত হয়নি। দিনকে দিন পানিবদ্ধতার পরিধি ও স্থায়িত্ব বাড়ছে। কদিন আগেও বৃষ্টিতে ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। মানুষ অশেষ কষ্ট ও বিড়ম্বনার শিকার হয়। দেশের দুই প্রধান শহরেই দেখা যাচ্ছে, পানিবদ্ধতা নিরসনে নেয়া প্রকল্পগুলো কোনো সুফল দিচ্ছে না। অথচ, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের কথাই ধরা যাক। জানা যায়, ১৯৬৬ সালে একটি বিদেশি কোম্পানি পানিবদ্ধতা নিরসনে একটি পরিকল্পনা দিয়েছিল, যা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। ১৯৭৫ সালে সরকারের পক্ষে একটি মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনার কাজ কোন কর্তৃপক্ষ কীভাবে করবে তা ঠিক করতে অনেক সময় চলে যায়। কার্যত প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ৬ থেকে ১০ বছর আগে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মতে, মহাপরিকল্পনা মোতাবেক, পানিবদ্ধতা নিরসনে তিনটি সংস্থা চারটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। এ তিনটি সংস্থা হলো, সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই তিন সংস্থার পরস্পর সহযোগিতায় প্রকল্পগুলোর কাজ হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। এদের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে লক্ষ্যযোগ্য। জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন ১টি, সিডিএ ২টি এবং পানি উন্নয়নবোর্ড ১টি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। গত ৬ বছরে এসব প্রকল্পে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অথচ, এখনো এর সুফল অধিবাসীরা পাচ্ছে না। আগামী বছর জুনে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু হবে বলে মনে হয় না।

একই সমস্যার সমাধানে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্প বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের আওতায় বাস্তবায়ন, তাদের কাজের মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা বা সমন্বয় না থাকা, দক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব পরিকল্পনা বা প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত ও তা থেকে সুফল না পাওয়ার মূল কারণ। আলোচ্য ক্ষেত্রে সেটা বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা গেছে। লক্ষ করার বিষয়, কোনো একটি প্রকল্প যখন গ্রহণ করা হয়, তখন তা থেকে প্রাপ্তব্য সুবিধা, সুবিধাভোগীদের চিহ্নায়ন, কতদিনে সুবিধা পাওয়া যাবে সেটা নির্ধারণ, কতদিনে কত অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়ন হবে ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সচরাচর এসব ঠিকমত করা হয় না। যেনতেনভাবে প্রকল্প নেয়া হয়। কাজও শুরু হয়। তখন দেখা যায় নানা অসম্পূর্ণতা ও অসংগতি। মাঝ পথে প্রকল্পের সংশোধন হয়। অর্থের বরাদ্দ বাড়ে। কাজ ঠিক সময়ে শেষ হয় না। সুবিধাভোগীরা সময়মত সুবিধা পায় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিলম্বের কারণে প্রকল্পের উপযোগিতা আর থাকে না। এভাবে যেমন অর্থের অপচয় হয়, তেমনি চুরি-দারি, লুটপাট হয়। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, চট্টগ্রাম শহরের পানিবদ্ধতা নিরসনে নেয়া প্রকল্পগুলো অনুপুঙ্খ তদন্তের আওতায় আনা হোক। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণ, তাদের বাস্তবায়নমান ও অর্থব্যয় ইত্যাদি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। অনুরূপ ব্যবস্থা রাজধানী শহরের পানিবদ্ধতা নিরসনে নেয়া প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও নেয়া হোক। গৃহীত সব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বছরের পর বছর ধরে এরকম জনদুর্ভোগ ও নিষ্ফল অর্থব্যয় বরাদশতযোগ্য হতে পারে না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী

আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'

বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন

পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের

পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ

পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ

পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়

নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়

জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭

নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭

রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ

রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ

ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা

ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা

উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা

ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা

উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল

উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল

পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া

বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া