হরিয়ানায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও রাজনৈতিক বুলডোজার এবং অনিশ্চিত ক্রান্তিকাল
০৮ আগস্ট ২০২৩, ১০:২৫ পিএম | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম
উপমহাদেশের রাজনীতি এক উত্তপ্ত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসা পরিবারের পতন এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পর এখন ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শাসকরা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে নানা রকম কারসাজি শুরু করেছে। জনগণের অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করে পরপর দুইটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানচিত্র থেকে কার্যত বিচ্যুত করে ফেলা হয়েছে। বিগত দুইটি নির্বাচনের আগে এবং পরে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য চাপ দেয়া হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তা অগ্রাহ্য করে একতরফা নির্বাচনের পথেই হেঁটেছে। প্রথম দিকে ওয়ার অন টেররিজম ও ইসলামোফোবিক এজেন্ডার কারণে ইসলামিক ও জাতিয়তাবাদী মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দমনপীড়ন চালিয়ে নিস্ক্রীয় কিংবা নির্মূল করে ফেলতে ক্ষমতাসীন দলের কঠোর অবস্থানের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মৌন সমর্থন থাকলেও পরবর্তীতে তাদের অবস্থান পাল্টে গেছে। বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর পশ্চিমাদের অবস্থান অনেকটা খোলাসা হয়ে যায়। বিশ্বের শতাধিক দেশকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে বিগত দুই দফায় বাংলাদেশকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। নবম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই গণতান্ত্রিক বিশ্বের মানচিত্রে ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্তর থেকে হাইব্রিড রেজিমে নেমে আসে বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই অবনমনের সাথে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন আক্রান্ত ও জর্জরিত হয়ে পড়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং টিকে থাকে তার সবকিছুই এখন হাইব্রিড রিজিমের তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র, সুশাসন, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুষম বন্টন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের দ্বারা প্রভাবিত, ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা যায়। সেই ওয়ান-ইলেভেন বিশেষ সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিবেশী ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের শিকার হতে দেখা গেছে। ভারতের আভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা যখন গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে পাশ কাটিয়ে একটি হিন্দুত্ববাদী জিঙ্গুইজমের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তখন বাংলাদেশের জনবিচ্ছিন্ন সরকার ভারতের সেই হিন্দুত্ববাদী সরকারের মন যোগাতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে কাপর্ণ্য করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সময় বলেই ফেলেন, ‘আমি ভারতকে যা দিয়েছি, আজীবন মনে রাখতে হবে’। এখন অতীতের কলঙ্ক মোচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পশ্চিমাদের চাপ সামলাতে ভারতের প্রভাব আর তেমনভাবে কাজ না করায় চীন ও রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশে প্রধান বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে হাইব্রিড রিজিমের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভারতের উপর পশ্চিমাদের চাপ তেমন জোরালো না হলেও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কারণে ভারতের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন ও জাতিগত নির্মূলের এজেন্ডা বিশ্বের সামনে ক্রমশ উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। বৃটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় ভারতের বিচারব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা সহ রাজনৈতিক- সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমুহ দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও সক্ষমতা বজায় থাকলেও বিজেপির শাসনে উগ্র জাতীয়তাবাদ অনেকটা ফ্যাসিবাদী চরিত্র গ্রহণের মধ্য দিয়ে সবকিছুই এখন হিন্দুত্ববাদের গেরুয়া মোড়কে আবির্ভূত হয়েছে।
ভারতের শাসকগোষ্ঠির সাম্প্রদায়িক নিয়ন্ত্রণ সামগ্রিকভাবে সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সহায়তায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক তৎপরতা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও কাশ্মিরের অবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অস্থিতিশীল। আশির দশকে ভারত সরকারের খালিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী অভিযানে রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের নেতাদের দাবিয়ে দেয়া সম্ভব হলেও এখন বিজেপি’র ‘হিন্দুত্ববাদী অপতৎপরতা’র কারণে ভিন্দ্রানওয়ালের অনুসারিরা আবারো পাঞ্জাবে শিখদের খালিস্তান আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছে। কাশ্মিরের মুজাহিদদের উপর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা যেমন তাদের নির্মূল করতে পারেনি, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা শিখদের নতুনভাবে সংগঠিত হতে বাধ্য করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃত অবস্থা ধামাচাপা দেয়া হলেও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মনিপুরের কুকি ও মেইতি জনগণের উত্তাল বিদ্রোহ এখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক সময়ের স্বাধীন মেইতি রাজাদের রাজ্য মনিপুরের পাবর্ত্য অঞ্চলে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা খৃষ্টান মিশনারিদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে মূলত দরিদ্র ও বর্ণবাদের শিকার নি¤œবর্ণের হিন্দুরা খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মনিপুর এক সময় হিন্দুদেন ছাপিয়ে খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিনত হয়। মুসলমানরা সেখানে তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠি। বিজেপি শাসিত মনিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতিদের মধ্যে খৃষ্টান ও মুসলমানদের প্রাধান্য হিন্দুত্ববাদীরা যেন মেনে নিতে পারছে না। কুকি উপজাতিদের সাথে সংঘাত বাঁধিয়ে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে মনিপুরের মূল জাতিগোষ্ঠির উপর হত্যা-নিপীড়নের ঘটনায় বিদ্রোহের উত্তাপ ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিজেপি শাসিত মনিপুরে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা থেকে সৃষ্ট দাঙ্গা ও ধ্বংসযজ্ঞ এখন সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হওয়ার কারণেই এখানকার সংঘাতময় অবস্থার দিকে পশ্চিমা বিশ্বের সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে। বিজেপি সরকার সংঘাত-সহিংসতা বন্ধে কার্যকর প্রশাসনিক-রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়ে এখন মাত্র ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের ক্ষুদ্র মনিপুর রাজ্যকে আলাদা তিনটি ইউনিয়ন টেরিটরিতে বিভক্ত করার ফর্মূলা দিচ্ছেন। মে মাস থেকে শুরু হওয়া মণিপুরের দাঙ্গা-সহিংসতায় শত শত মানুষের মৃত্যুর পর জুলাইয়ের শেষদিকে বিজেপি এমএলএ কুকি নেতা পলিনলাল হাওকিপ মনিপুরকে তিনটি আলাদা স্টেটে বিভক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। বিজেপি যখন অখন্ড ভারতের পৌরাণিক স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে নতুন করে অনাস্থার জন্ম দিচ্ছে, তখন ভারতের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক বিভাজন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলেছে।
ভারতে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা অন্যন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের উপর আঘাত করছে। কয়েক বছর আগে থেকেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভারতের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের ২০২৩ সালের রিপোর্টে ভারতে মুসলমানদের উপর বিজেপি সরকার ও সমর্থকদের নিপীড়ন ও ধারাবাহিক অপতৎপরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে বিবরণ তুলে ধরেছে, তাতে জম্মু-কাশ্মিরের পর হরিয়ানা দাঙ্গা ও পুলিশি নিবর্তনের ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানায় বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের ব্রজমন্ডল যাত্রাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মুসলমান হত্যার ঘটনা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সর্বশেষ রিপোর্টে আসেনি। অবস্থ্ াদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন ও সম্পদ, জায়গাজমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিজেপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে একসাথে কাজ করছে। করোনা মহামারির শুরুতে দিল্লী দাঙ্গায় শত শত মুসলমানকে হতাহত করা হয়েছে। শত শত বাড়িঘর মসজিদ-মাদরাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছিল। সে সব অপরাধের কোনো তদন্ত কিংবা বিচারের প্রক্রিয়া এখনো দৃশ্যমান নয়। উপরন্তু জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি নেতাকর্মীরা নতুন করে সাম্প্রদায়িক ইস্যু সৃষ্টির পায়তারা করছে। হরিয়ানার ব্রজমন্ডল যাত্রায় দাগী খুনি মুন মানেসারের অংশগ্রহণের ঘোষণা মুসলমানদের প্রতি উলঙ্গ উস্কানি। গত ফেব্রুয়ারিতে হরিয়ানার নুহ জেলায় বজরং দলের গো রক্ষক নেতা মনু মানেসরের নেতৃত্বে স্থানীয় মুসলমান যুবক জুনাইদ ও নাসিরকে রাস্তা থেকে ধরে এনে পিটিয়ে আধমরা করে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে পেট্টোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা করে। সেই ঘটনা ভারতের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বমিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের কাছে পলাতক মনু মানেসর যখন ব্রজমন্ডল যাত্রায় অংশ নেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে, তখন নুহ, গুরুগ্রাম ও সোহা জেলার মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিক্ষোভ ব্রজমন্ডল যাত্রায় ইটপাটকেল নিক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হিন্দুত্ববাদীরা এই বিক্ষোভের জেরে মুসলমান বাড়িঘর, মসজিদ ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বিশ্বহিন্দু পরিষদ, বজরং দলের সন্ত্রাসীদের সাথে নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো এখন হরিয়ানায় মুসলমানদের বাড়িঘর, সামাজিক, ধর্মীয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে দিতে শুরু করেছে। হরিয়ানার নুহ-গুরুগ্রাম (সাবেক মেওয়াত) জেলার জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলমান। সেখানেও হিন্দুত্ববাদীরা গো রক্ষার নামে প্রকাশ্যে মুসলমান যুবকদের হত্যা করে হত্যাকারীদের নেতৃত্বে ব্রজমন্ডল যাত্রা করেছে। সেখানে বিক্ষুদ্ধ মুসলমানদের উস্কানি দিয়ে পৌরাণিত পান্ডবদের শিবলিঙ্গ মন্দিরের নামে এখন বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে জায়গা জমি দখলের পরিকল্পিত তৎপরতা চলছে। ভারতের পার্লামেন্টে মনিপুর নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক হলেও হরিয়ানায় মুসলমানদের উপর নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বেআইনীভাবে বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘর ধ্বংসের উৎসবে মেতে উঠেছে। এ যেন অনেকটা মুসলমান উদ্বাস্তুদের উপর জায়নবাদী ইসরাইলীদের সম্প্রসারণবাদী নীতির ভিত্তিতে বুলডোজার দিয়ে ইহুদি আবাসন গড়ে তোলার ভারতীয় সংস্করণ।
আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচ গ্রুপের প্রধান প্রফেসর গ্রেগরি স্ট্যান্টন নব্বইয়ের দশকে রুয়ান্ডায় হুতো ও তুতসিদের সংঘাত ও গণহত্যা শুরুর আগেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি সম্ভাব্য গণগত্যা সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কার কথা অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলেন। বিশ্ব সম্প্রদায় একটি সম্ভাব্য গণহত্যার আশঙ্কা আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে রুয়ান্ডায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের গণহত্যা সংঘটিত হতনা। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতোদের হাতে তুতসি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠির প্রায় অর্ধেক গণহত্যার শিকার হয়। রুয়ান্ডার ৭০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৫ ভাগ ছিল তুতসি। দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যায় নিহতদের আশিভাগই ছিল তুতসিরা।
ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা পরিকল্পিতভাবে ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। গ্রেগরি স্টান্টন তার ভবিষ্যদ্বানিতে রাজনৈতিক গণহত্যা সংঘটনের যে ধাপগুলোর বর্ননা দিয়েছেন, ধারাবাহিকভাবে ভারতে তার সবগুলোই বাস্তবায়িত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি, নতুন নাগরিকত্ব আইন করে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে প্রতিপন্য করা অথবা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মত নাগরিকত্বহীন উদ্বাস্তুতে পরিনত করা অত:পর পরিকল্পিত হত্যাকা-, গৃহযুদ্ধ এবং বুলডোজার দিয়ে বিশেষ জনগোষ্ঠির বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ ও দখলবাজির মধ্য দিয়ে সংঘাত ও সহিংসতাকে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করার মধ্য দিয়ে এথনিক ক্লিনজিংয়ের টার্গেট পুরণের লক্ষ্য অর্জিত হয়। ভারতের জম্মু-কাশ্মির, আসামের কথা বিশেষভাবে উঠে আসলেও ভারতের সর্বত্র মুসলিম অধ্যুসিত এলাকাগুলোতে হিন্দুত্ববাদিদের পরিকল্পিত গণহত্যার ডাক এবং সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং গো রক্ষার নামে, কাল্পনিক মন্দির পুনরুদ্ধারের নামে মুসলমানদের উপর আক্রমন ও সম্পদ লুন্ঠনের অপতৎপরতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বেড়েই চলেছে। গরু চোরাচালানের অভিযোগে ফেব্রুয়ারিতে হরিয়ানায় মুসলমান যুবক জুনাইদ ও নাসিরকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর মনু মানেসর ও তার দলবলের কাউকেই বিচারের আওতায় নেওয়া হয়নি। উপরন্তু ব্রজমন্ডল যাত্রার নামে সেই হত্যাকারিরা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নুহ-গুরুগ্রামের মুসলমানদের বাড়িতে অগ্নি সংযোগ, লুটপাট ও বুলডোজার দিয়ে ভবন উচ্ছেদের ভয়নক নীলনকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে। হরিদ্বারে হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে মুসলমান গণহত্যার ডাক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও বৈষম্য নীতির কারণে নাগরিক হিসেবে মুসলমানদের অধিকার হরণের ধারাবাহিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের তৃতীয় দশকেই। ১৯৩৫ সালের স্বাধীনতা আইন এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আওতায় মুসলমানদের অবিভক্ত বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার যৌক্তিক দাবিকে ব্যর্থ করে দিতে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালের ১৩ থেকে ১৬ আগস্টের মধ্যে কলকাতায় সংঘটিত ৪ দিনের দাঙ্গায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, আহত হয় এর দ্বিগুন। দাঙ্গায় হতাহতদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। শতকরা ৭০ভাগ হিন্দু জনসংখ্যা অধ্যুসিত কলকাতায় উগ্র হিন্দুদের গণহত্যা থেকে বাঁচতে হাজার হাজার বিহারি উর্দূভাষি মুসলমান পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশে তারা এখনো আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে অভিহিত হচ্ছে। ভারতের শাসকশ্রেণী মুসলমানদের টার্গেট করে নতুন নাগরিকত্ব আইনের অপপ্রয়োগসহ পরিকল্পিত গণহত্যার আয়োজন করলেও বাংলাদেশে শতকরা ১০ ভাগ হিন্দু জনগোষ্ঠির চিত্র সম্পুর্নই ভিন্ন। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক রাজনীতি যখন ফ্যাসিবাদি চরিত্র গ্রহণ করে তখন নিজেদের মধ্যেই যে বিভাজন ও এন্টাগনিজমের রাজনীতির বিস্তৃতি ঘটায় তা পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিভাজিত, অস্থির ও নিরাপত্তাহীন করে তোলে। বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনীতি এখন তেমনি এক অনিশ্চয়তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ
পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়
জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭
রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ
ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা
উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন
ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা
উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল
পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের
বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
ইইউভুক্ত দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের হুমকি কাতারের
দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যের পেছনে ছুটে বিপদের ফাঁদে পর্যটকরা
ঢাকার বাতাস আজ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’
২৮ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদ
হিরো নয় কারিনার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি