নতুন আইন যেন পুরনো আইনের মোড়কীকরণ না হয়
০৮ আগস্ট ২০২৩, ১০:২৬ পিএম | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম
বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন -২০২৩’। গত সোমবার মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে এ আইনের খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ আইনে মোট ৬০টি ধারা থাকবে। মন্ত্রীসভার বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি রহিত করা হয়েছে। আইনটির বেশকিছু ধারার পরিবর্তন এনে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধে আইনের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬টি অজামিনযোগ্য এবং ১০টি জামিনযোগ্য ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এটি সেপ্টেম্বরে সংসদে বিল আকারে পাশের জন্য উত্থাপন করা হবে। খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এতে সাংবাদিকদের হয়রানি অবশ্যই বন্ধ হবে। তিনি এ কথাও বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমরা বাতিল করছি না। এই আইন পরিবর্তন করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন আইন করছি। এ আইন নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এতদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো বহাল থাকবে। ইতোমধ্যে আইনবিদ ও সচেতন মহলের অনেকে নতুন আইনকে পুরনো আইনের নতুন ‘মোড়কীকরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিদেশি কূটনীতিকরা এর অপব্যবহার ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তা বাতিল, স্থগিত বা নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বাতিলে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের সাংবাদিক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজও আইনটির বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল করার দাবী জানিয়ে আসছে। এ নিয়ে সরকারের ওপর অব্যাহত চাপ ছিল। কারণ, এর অপব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, এর মাধ্যমে সাংবাদিক, লেখক, সুশীল সমাজসহ সাধারণ মানুষও রেহাই পাচ্ছে না। এর আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনটি আইসিটি অ্যাক্ট নামে পরিচিত ছিল। এই আইনও নিবর্তনমূলক ছিল। দৈনিক ইনকিলাব ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি এর শিকার হয়। সে সময় তদন্তের নামে পুলিশ ইনকিলাব অফিসে অভিযান চালিয়ে তছনছ করে দেয়। ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনসহ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঐ আইনে মামলা দেয়া হয়। কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেফতারও করা হয়। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আইনটির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। তখন সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহল থেকে আইনটি বাতিলের দাবি করা হয়। নানা সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮ প্রণয়ন করে। দেখা যায়, আগের আইনের বহুল বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করা হলেও নতুন আইনে যে ধারা সংযোজন করা হয়, তা ৫৭ ধারার চেয়েও ভয়াবহ। আইনটি বাস্তবায়নের পর গণমাধ্যম হিসেবে ২০২০ সালের ২৭ জুন প্রথম শিকার হয় দৈনিক ইনকিলাব। এ আইনের বিরুদ্ধে ইনকিলাব শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সচেতন মহল এ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ৭ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এ মামলার শিকার হয়ে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন লেখক মুশতাক আহমেদ। এছাড়া দেশের প্রথম সারির পত্রিকার সম্পাদক থেকে শুরু করে অনেক সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়ে গ্রেফতার ও কারাগারে গিয়েছে। এ আইনের অপব্যবহার এতটাই বেড়ে যায় যে, সাংবাদিক মহল, সুশীল সমাজসহ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা এ আইন বাতিল ও স্থগিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। এতে সরকার চাপে পড়ে আইনটি সংশোধনের কথা বলে। অবশেষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত এবং কিছু ধারা সংশোধন করে নতুন নামে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটাকে ‘মন্দের ভাল’ বলা যায়।
নতুন ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নিয়ে ইতোমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক টুইট বার্তায় বলেছে, ‘বাংলাদেশ সরকারকে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে যেন ওই আইনের দমনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরিয়ে আনা না হয়।’ টিআইবি বলেছে, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন কোনোভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ কোনো কোনো আইনজীবী বলেছেন, যেসব ধারা আগেও ছিল এবং যেগুলো ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে, সেই ধরাগুলো থাকছে। শুধু সাজার পরিমাণ কমেছে। সাজার পরিমাণ কমলেও এ আইনের অপব্যবহার কমবে না। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘নতুন আইন পাস করার আগে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এবং সম্পাদকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করা উচিত ছিল। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে কি কি আছে, তা আমরা পুরোটা জানি না। সেটা সাংবাদিক বান্ধব কিনা, সরকার সত্যি সত্যি স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে কিনা, সেটা না দেখা পর্যন্ত আমরা স্বস্তি পাচ্ছি না। তিনি বলেছেন, ইতোমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যারা শিকার হয়েছে, কারাগারে রয়েছে, তাদের ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা প্রয়োজন।’ সরকারের নতুন আইন এবং সংশোধনের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। এটি সরকারের শুভ ইচ্ছার প্রতিফলন। আমরা আশা করব, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নতুন মোড়কে পুরনো নিবর্তনমূলক আইনের সংস্করণ হবে না। গণমাধামের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে তা খড়গ হয়ে উঠবে না। এ আইনকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের আইন উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে বহু দেশে রয়েছে, তবে সেখানে তা ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে হয়রানি বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। কোনো কোনো দেশে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করা হলেও তার সাথে আমাদের দেশ তুলনীয় হতে পারে না।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭
রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ
ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা
উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন
ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা
উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল
পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের
বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
ইইউভুক্ত দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের হুমকি কাতারের
দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যের পেছনে ছুটে বিপদের ফাঁদে পর্যটকরা
ঢাকার বাতাস আজ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’
২৮ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদ
হিরো নয় কারিনার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি
রাওয়ার নেতৃত্বে আবদুল হক ও ইরশাদ সাঈদ
স্লোভাক প্রধানমন্ত্রীর মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক
কুমিল্লায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৩ কিশোর নিহত