নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করলে বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ থাকবে না

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:০৯ পিএম | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম

দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানো কিংবা পর্দার আড়ালে কলকাঠি নাড়াচাড়া করার বিষয়টি নতুন নয়। বহু বছর ধরেই তা চলছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অন্যান্য যেকোনো বছরের তুলনায় প্রভাবশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে সেসব দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আনাগোনা ও অ্যাক্টিভিটি বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলা যায়, ইতোমধ্যে তা রেকর্ড গড়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে। তারপরই রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্যদিকে, চীন, রাশিয়া বলয়ও কোনো অংশে কম যাচ্ছে না। এর মধ্যে চীন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বেশি তৎপর। তবে তার প্রবল প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রকে এখনও টেক্কা দিতে পারেনি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ভারতকে বিগত দুটি নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সরব দেখা গেছে, সে এখন অনেকটাই নীরব। তার এই নীরবতার কারণ হিসেবে ধরা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সরবতা। অনেকে বলে থাকেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এবার চুপ থাকতে বলেছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিগত দুটি নির্বাচনকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখেছে, এবার সে ভারতের চোখ বন্ধ করে নিজের চোখে দেখতে চাইছে। তার নানামুখী কর্মকা-ে তা প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে ভারত এখন আগের মতো প্রকাশ্যে তেমন কিছু বলছে না, যদিও গত ৩ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পরিকল্পনামতো এবং বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে। যদিও তিনি ‘পরিকল্পনামতো’ নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু তা কোন ‘পরিকল্পনা’ তা পরিষ্কার করেননি। যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রায় নিত্যদিনই রাজনৈতিক দল, মন্ত্রী-এমপি, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে প্রকাশ্যে-গোপনে বৈঠক করছেন। তার এসব বৈঠক শেষে যখন বক্তব্য দেন, তখন তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখার যে প্রত্যাশা করছে, তা তিনি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশকে তা করে দেখাতে হবে। ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রত্যাশার কথা দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্ররা সেটা বারবার ব্যক্ত করছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও প্রভাবশালী দেশগুলোই নয়, আগামী নির্বাচন, আন্দোলনরত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ক্ষমতাসীন দলের আচরণ, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ব্যাপক অভিযোগ ও কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, যা সরকারের বিরুদ্ধে যায়। শুধু এসব সংস্থাই নয়, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কংগ্রেসম্যান ও ১৪ কংগ্রেসম্যান যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের ৬ সদস্য সেখানে যে চিঠি দিয়েছে, তা কোনোভাবেই সরকারের অনুকূলে নয়।

দুই.
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলগুলোর রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়, তা নিরসনে বিদেশিদের মধ্যস্থতা করার প্রকাশ্য দেনদরবারের বিষয়টি শুরু হয় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি তার অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে, বিরোধীদল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র বিরোধিতা করে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। তখন কমনওয়েলথের সাবেক মহাসচিব স্যার নিনিয়ান ছুটে এসেছিলেন উভয় পক্ষের মধ্যে দূতিয়ালি বা মধ্যস্থতা করার জন্য। তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে বৈঠক করে তাদের বোঝাতে বা সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। ফলে যা হবার তাই হয়। বিরোধীদলের ব্যাপক সংঘাত, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের মধ্যে বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে এবং সংসদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুক্ত করে পদত্যাগ করে নির্বাচন দেয়। তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। সে সময় বিদেশিদের প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সমস্যা দেখা দেয়, ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে যখন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়ে নানা ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা শুরু করে। এতে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। একধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সে সময় প্রায় দশ বছর পর বিদেশি দেশগুলোকে নির্বাচন নিয়ে বেশ তৎপর হতে দেখা যায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো ছুটে আসেন। তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দর সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে সমঝোতার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হয়। এর মধ্যেও বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। নির্বাচন কমিশন আগেই ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিল। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল নমিনেশন পেপার কিনে তা জমা দিলেও ১০ জানুয়ারির দিকে প্রত্যাহার করে নেয়। ঠিক তার পরদিনই ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে, এই ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের বিশেষ ভূমিকা ছিল। দুই বছর এই সরকার থাকার পর যে নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামী লীগ ও তার জোট দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ও তার জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। এক্ষেত্রে কোর্টের রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে ২০১৩ সালে বিরোধীদল বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে তুমুল আন্দোলন শুরু করে। এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও নির্বাচনে যাবেন না বলে বেঁকে বসেন। তিনি পিস্তল হাতে নিয়ে বসেছিলেন এবং ঘোষণা দিয়েছিলেন, সরকার যদি তাকে জোর করে নির্বাচনে নেয়, তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। এমন এক জটিল পরিস্থিতিতে সরকারের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং এসে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দেন। এরশাদ হাসপাতালে ভর্তি হন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তবে পরবর্তীতে তিনি নমিনেশন পেপারে সই করেননি বলে বললেও তা আমলে নেয়া হয়নি। চরম সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার নির্বাচন করে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ আসনসহ দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়। এ নির্বাচন সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য না হলেও একমাত্র ভারতের কাছে তা গ্রহণযোগ্য ছিল। বলা যায়, ভারত এককভাবে সরকারকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলোকে ম্যানেজ করে। সরকার এমন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিএনপি ও তার জোটের আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় বিএনপি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারের আশ্বাসে নির্বাচনে যায়। সেই নির্বাচন এমনই হয় যে, আগের রাতেই ভোট হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, সে নির্বাচনের পেছনেও ভারতের হাত ছিল। বিশ্বে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও ভারত আবার ত্রাতা হয়ে তা সমর্থন দিয়ে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করে। সরকারের এই পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গণতন্ত্রের সংকোচন, কর্তৃত্ববাদের বিস্তার, মানবাধিকারের অবনতি, মত ও বাকস্বাধীনতা খর্ব করার মতো অভিযোগসহ নানা নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়। বলা যায়, বাংলাদেশকে নিয়ে এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশন শুরু। কোনো ধরনের রাখ-ঢাক না করেই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার তাকিদ দিতে থাকে। এর মধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তার সাথে তাল মিলাতে থাকে, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এখন পর্যন্ত তাদের এ তৎপরতা চলছে এবং নির্বাচন পর্যন্ত যে চলবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

তিন.
দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানো কাম্য নয় বলে যতই সুনীতির কথা বলা হোক না কেন, এর জন্য কারা দায়ী, তা সকলেরই জানা। যারা বলে, তারাও এ দায় থেকে মুক্ত নন। সুনির্দিষ্ট করে বললে, এ পর্যন্ত নির্বাচন ও রাজনৈতিক গোয়ার্তুমির অপসংস্কৃতির কারণে বিদেশিদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া ছাড়া ’৯৬ তে এর শুরু। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলের মধ্যে যদি নিজ উদ্যোগে সমঝোতা হতো, তাহলে বিদেশিদের বলার কিছু থাকতো না। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে, তার আগে নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের এত মাথাঘামাতে দেখা যায়নি। সিস্টেমের কারণে তাদের সে সুযোগ ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। আরও স্পষ্ট করে বললে, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন গঠিত হয়, তখন বিদেশিদের ফর্মুলায় হয়নি। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই হয়েছিল এবং সমস্যার সমাধান নিজেরাই করেছিল। অন্যদিকে, যখনই বিদেশিদের হস্তক্ষেপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখনই তা বিতর্কিত হয়েছে। এর দৃষ্টান্ত ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করা নিয়ে বিরোধীদলগুলো যে আন্দোলন করছে, তার মধ্যে যুক্তি আছে। কারণ, দেশে দলীয় সরকারের আমলে কখনোই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার জন্য যে ধরনের গণতান্ত্রিক মানসিকতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে জোর করে বা যেনতেনভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার লোভ না থাকত, কিংবা পারস্পরিক রাজনৈতিক সমঝোতা, বোঝাপড়া, রাজনীতিকে রাজনীতির সুসংস্কৃতির মধ্যে চলার পথ তৈরি করত, তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মানসিকতা গড়ে উঠত। প্রধান দুই দলের মধ্যকার সম্পর্ক এমনই যে, তারা একে অপরকে দুচোখে দেখতে পারে না। একে অপরকে শেষ করে দিতে পারলে যেন বাঁচে, এমন মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করে। ক্ষমতাসীন দল প্রায়ই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা নিয়ে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দেয়। এটা বলে না, উন্নত বিশ্বে ক্ষমতাসীনদল ও বিরোধীদলের মধ্যে একে অপরকে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রবণতা নেই। বিরোধীদল ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করলে তা মেনে নেয়, এমনকি সরকার প্রধানকে পদত্যাগ করতেও দেখা যায়। থাকতে চাইলেও থাকতে পারে না। এর কারণ, তাদের শাসনকাজ পরিচালনার যত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ফলে যেকোনো সরকারকে এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয় এবং তা কোনো সরকার প্রধানের পছন্দ না হলেও তার কিছু করার থাকে না। তাকে এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে দেশ পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে, নির্বাচন চলাকালীন যেসব প্রতিশ্রুতি কিংবা নীতি সে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে নির্বাচিত হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিপালনে সহায়তা করে। এটা তাদের দীর্ঘদিনের অনুশীলনের ফসল। আমাদের দেশে এ অনুশীলন না করে কিংবা সরকার পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক না করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহবস্থান বা সমঝোতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি না করে হুট করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা এক অলৌকিক ও অসম্ভব ব্যাপার। এটা যেকোনো গণতান্ত্রিক ধারার দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের দেশের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সে সরকারের দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। এর মাধ্যমে বিরোধীদলকে দমিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। গত একদশকেরও বেশি সময় ধরে তা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। এ কারণেই বিদেশিরা আমাদের দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতি কিংবা নির্বাচন কিভাবে হবে, সে ব্যাপারে নাক গলানো বা কূটনৈতিক ভাষায় পরামর্শ দেয়ার সুযোগ পায়। এটা তাদের দোষ নয়, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দোষ। বিদেশিদের দোষ এ কারণে নয় যে, আমাদের দেশ ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সাহায্য-সহযোগিতা, ঋণ পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের উপর নির্ভরশীল। এক যুক্তরাষ্ট্রই যথেষ্ট আমাদের এসব পাওয়া না পাওয়াকে রুদ্ধ করে দিতে। যদি সে গার্মেন্ট আমদানি ও রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করে দেয়, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংককে আকারে-ইঙ্গিতে ঋণ দিতে না করে, রোহিঙ্গাদের সাহায্য না পাঠায়, বিনিয়োগ না করে, তাহলে আমাদের অর্থনীতির কি হবে, ভাবা যায়? তার এক ভিসানীতি নিয়েই তো আমাদের প্রশাসন থেকে শুরু করে অনেকের মধ্যে কাঁপুনি ও হতাশা দেখা দিয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন, জাতিসংঘ যদি শান্তি মিশন সংকুচিত করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে, তাহলে আমাদের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এসব প্রতিষ্ঠান ও দেশের ওপর তো যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রভাব রয়েছে। তারা তার বাইরে যাবে না এবং যাচ্ছেও যে না, তা ইতোমধ্যে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ও কঠোর নির্দেশনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়া, চীন ও ভারত বলয়ের যে কথা বলা হয়, তাদের কাছ থেকে আমাদের কি পাওয়ার আছে? বরং আমরা এটাই লক্ষ্য করছি যে, তারা আমাদের দেশে বাণিজ্য করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পোশাক রফতানি কিংবা রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে দেশগুলোর ভূমিকা বলতে কিছু নেই। উল্টো তাদের দেশের লোকজন আমাদের দেশে এসে কাজকাম করে বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। তুলনামূলক এই চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশ এবং চীন, রাশিয়া ও ভারত আমাদের দেশের রাজনীতি-নির্বাচন নিয়ে কথা বলে।

চার.
দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের নাক গলানো, পরামর্শ দেয়া বন্ধ করতে হলে, আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি বদলাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সমঝোতামূলক সম্পর্ক থাকতে হবে। নিজেদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। তাহলে, বিদেশিদের কোনো কিছু বলার আর সুযোগ থাকবে না। একগুঁয়েমি, গোয়ার্তুমি, ক্ষমতায় গিয়ে বিরোধীদলকে নিঃশেষ করে দেয়ার মতো প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক সুসংস্কৃতি, সহযোগিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার নীতি অবলম্বন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক সংস্থাগুলোকে দলীয়করণের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'

বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন

পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের

পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা

পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ

পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ

পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়

নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়

জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু

নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭

নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭

রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ

রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ

ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা

ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা

উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা

ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা

উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল

উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল

পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া

বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল