চাকমা ও কুকি-চীনদের সশস্ত্র বিদ্রোহ : অতীত ও বর্তমান
২৩ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩১ পিএম | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪৪ পিএম
অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আয়তনে দেশের এক-দশমাংশ। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলাকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এ অঞ্চলে বসবাস করে বাঙালিসহ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠি। এ অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ। কাছাকাছি বিশ্বখ্যাত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ঘিরে সুসমৃদ্ধ ভৌগোলিক অবস্থান, ল্যান্ড লক্ড ভারতের সেভেন সিস্টার অঞ্চল, কৌশলগত ট্রানজিট ও নানান কারণেই এ অঞ্চলের উপর রয়েছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠির নজর।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়। সে সময়ে চাকমা উপজাতি দশ বছরব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। ব্রিটিশরাজ্যের একটি স্বশাসিত এলাকারূপে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বীকৃতি লাভ ছিল ওই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। ফলে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা রাজনৈতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয়। তখন রাজমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে ১৯১৫ সালে সর্বপ্রথম চাকমা যুবক সমিতি গঠিত হয়। ১৯১৯ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় চাকমা যুবক সংঘ। ১৯২০ সালে কামিনী মোহন দেওয়ান গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি। প্রায় দুই দশক ধরে এই সংগঠনটি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৩৯ সালে যামিনী রঞ্জন দেওয়ান স্নেহকুমার চাকমা এই সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন থেকেই জনসমিতির মূল রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে জনসমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা করে। তদানীন্তন পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পড়ে পাকিস্তান অংশে। তখন স্নেহকুমার চাকমার গ্রুপ সেটা মানতে অস্বীকার করে সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে। তিনদিন পর নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে পাহাড়ি ছাত্রদের দাবি আদায় সংক্রান্ত একটি সংগঠন ‘হিল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা এবং জে বি লারমা। এ সমিতির সমর্থনে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের দেশদ্রোহীদের মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়। তবে উপজাতীয় যুবকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে গঠিত ‘সিভিল আমর্ড ফোর্স’ বা ‘সিএএফ’ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত)-এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীতে তুলনামূলকভাবে চাকমাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চাকমা সার্কেলের চিফ ত্রিদিব রায়।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়, ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য নেতৃত্ব পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান করলেও বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংগ্রামের সময়ে ওই নেতৃত্বই আবার পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। সার্কেল চিফের নির্দেশে হেডম্যান, কার্বারিরা তখন গ্রামের লোকদের জোরপূর্বক রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করে। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রের লোভে ‘সিএএফ’-এ যোগ দেয়। ত্রিদিব রায় তার সার্কেলের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রচার চালান। চাকমা ও অন্যান্য উপজাতিদের গুপ্তচরবৃত্তির কারণে স্বাধীন বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারেননি, সে কারণেই বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে শাহাদাত বরণ করেন। কুকি, বম, খেয়াং, লুসাই, খুমি, তঞ্চঙ্গাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র উপজাতিগুলোও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনে বিরোধিতা করে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেলের তিন চিফের মধ্যে একমাত্র মানিকছড়ির মং সার্কেলের চিফ মং প্রু চাঁই চৌধুরী (কিংবা মং প্রু সাইন) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি বাঙালিদের পক্ষে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর, বোমাং সার্কেলের চিফ অং শৈ প্রু চৌধুরী তদানিন্তন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নীতিগতভাবে বাংলাদেশ বিদ্বেষী ছিলেন না। তবে চাকমা সার্কেলের চিফ ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আর দেশে ফিরে আসেননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলোতে ছিল :
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন, (খ) সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরূপ সংবিধির অন্তর্ভুক্তি, (গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ, (ঘ) ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
সরকার কর্তৃক তাদের এই অযৌক্তিক দাবিগুলো প্রত্যাখাত হলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং জুম্ম জাতীয়তাবাদ ও ‘জুম্মল্যান্ড’ ধারণা জন্ম নেয়। এর পর পাহাড়িদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ (জেএসএস) গঠিত হয়। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে তাদের এই অযৌক্তিক দাবি আদায় সম্ভব নয় মনে করে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি জেএসএসের সামরিক শাখা তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’ গঠিত হয়।
এই ‘শান্তি বাহিনী’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে উপজাতি সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের উপর গণহত্যায় মেতে ওঠে। সেই সময়ে পার্বত্য বাঙালিদের উপর ৪২টিরও বেশি গণহত্যা পরিচালনা করে শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। তবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনসংহতি সমিতির অভ্যন্তরে দুটি মতাদর্শ বিদ্যমান ছিল। একদিকে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বাধীন বামপন্থী লারমা গ্রুপ, অন্যদিকে প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী প্রীতি গ্রুপ। ১৯৮২ সালের ২৪ অক্টোবর আদর্শগত সংঘাত থেকে শান্তি বাহিনী দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর প্রতিদ্বনদ্বী গ্রুপের হামলায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হন। এরপর তার ছোট ভাই জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে সন্তু লারমা তথাকথিত ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালাতে থাকেন।
এর পাশাপাশি স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্র ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের পাঁয়তারা করছেন। আর সে লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীল পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে দেবাশীষ রায় গোপনে বিভিন্ন দেশবিরাগী কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন। তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন উগ্রপন্থী সংগঠনসহ নানান সংস্থার সাথে এ ব্যাপারে লবিং করছেন। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে মদদ ও ইন্ধন দিচ্ছেন। জানা যায় যে, এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সন্ত্রাসীদের কাছে মায়ানমার থেকে সব অস্ত্রের চালান আসতো আরাকান আর্মির নেতা ডা. রেনিন সোয়ের মাধ্যমে। সেই রোনিন সোয়ের সাথে দেবাশীষ রায়ের গোপন বৈঠকের কথা অনেকেরই জানা।
স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের হাতিয়ার হিসেবে সম্প্রতি উপজাতিরা নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ দাবি করা শুরু করেছে। কারণ, ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। সেখানকার সকল ক্ষমতার মালিক হবে উপজাতিরা। উপজাতিদের এই ‘আদিবাসী’ দাবি করার পিছনের মূল কারিগর দেবাশীষ রায় বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে কোন ‘আদিবাসী’ নেই, বরং মূল বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে এই অ-বাঙালি জনসমষ্টিকে- উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু, এই অ-বাঙালি জনগোষ্ঠী জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণা ২০০৭ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৭ ও ১৬৯ নং কনভেনশনের ঘোষণা অনুযায়ী নিজেদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি আদায়ের কর্মসূচি পালন করে আসছে।
তবে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থানের ফলে ‘আদিবাসী’ ইস্যু কিছুটা স্তিমিত হলেও দেবাশীষ রায় বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের হাত করে এ ব্যাপারে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক মহলেও অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত UNPFII (United Nations Permanent Forum on Indigenous Issues), ILO (International Labour Organization), CHTC (Chittagong Hill Tracts Commision), আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস, আদিবাসী ফোরাম ইত্যাদি সংগঠনের মদদে এই ইস্যুটি এখনও চলমান রয়েছে।
অন্যদিকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সম্প্রতি নিজেদেরকে অনগ্রসর ও অবহেলিত সম্প্রদায় দাবি করে আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশকে অশান্ত করে চলেছে। এর ফলে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের কথা বিবেচনা করে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী কেএনএফকে দমনের জন্য সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে সেনাবাহিনীর পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দমনের এই অভিযানকে বিতর্কিত করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর পূর্ব ইতিহাস পর্যালোচনা বিচার ও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কুকিরা চীন, তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া হতে আগমন করে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পাহাড়ে বসতিস্থাপন করে। সেখান থেকে আসে পার্বত্য চট্টগ্রামে। প্রবাদে আছে, কুকিরা মঙ্গোলীয় মহাজাতির একটি শাখা। কুকি মূলত কোনো একক নৃগোষ্ঠি নয়। প্রায় ৫০টি জাতিগোষ্ঠির সমন্বয়ে কুকি-চিন-মিজো জাতি গঠিত। এদের অধিকাংশ মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বসবাস করে, এদের বড় একটি নৃগোষ্ঠি ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ‘মিজো’ উপজাতি, যারা বাংলাদেশে বম, লুসাই ও পাংখোয়া নামে পরিচিত।
এই জাতিগোষ্ঠির একটি অংশ মিয়ানমার ও ভারতে থাডো নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে ভারতের মিজোরাম জেলায় কুকি জো জাতির বসবাস বেশি। বাংলাদেশের বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল অঞ্চলে এরা বসবাস করে। এসব জাতিসত্তা নিজেদেরকে বলে ‘জো’।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার পাহাড়ি এলাকায় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কুকিরা স্থানীয় সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করে। কুকিদের এই আক্রমণে ১৮৬ জন ব্রিটিশ প্রজা খুন হয় এবং আটক হয় প্রায় একশ’রও অধিক। এছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির উপরও অত্যাচার করতে থাকে কুকিরা। প্রশাসনিকভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কুকিদের শায়েস্তা করার জন্য ব্রিটিশরা নানান আইন প্রণয়ন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ প্রশাসনের উপর কুকিরা দফায় দফায় আক্রমণ করে। এই আক্রমণ ঠেকাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা নয়, অর্থাৎ যাদের এ অঞ্চলে জায়গা-জমি নেই, তাদের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করে। এরজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (১৯০০) আইনে বলা হয়, এখানকার বাসিন্দা হতে হলে নিজ নামে জায়গা-জমি থাকতে হবে এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি)-এর বাসিন্দা সনদের ভিত্তিতে এ অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে গণ্য হবে। তৎকালীন কুকিরা দল বেঁধে এসে আক্রমণ করতো। মূলত কুকিদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হেডম্যান রিপোর্ট অনুযায়ী ডিসি সনদের প্রচলন শুরু হয়, যা আজ বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। এই কুকিরা ছিল বর্বর, অত্যাচারী এবং অকৃতজ্ঞ জাতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি জনগোষ্ঠির সঙ্গে মূল বিরোধ হচ্ছে চাকমাদের সঙ্গে, খ্রিস্টীয় ১৬শ’ শতকের দিকে আগত কুকিরা পরবর্তী অনুপ্রবেশ করা চাকমা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রিটিশরা চাকমাদের সহযোগিতায় কুকিদের দেশান্তরিত করেছিল। তার দায়ভার স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠি বহন করতে পারে না। সে কারণেই এর জন্য কুকিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে পারে না।
তাছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া এবং চোরাগোপ্তা হামলা করে কুকিরা তাদের সেই পুরানো উগ্রবাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। যদিও কুকিরা এই রাষ্ট্র কর্তৃক কখনো দেশান্তরিত বা নির্যাতিত হয়নি। কুকিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বারবার ছাড়তে হয়েছে চাকমাদের কারণে। তাই কুকিদের এই যুদ্ধ হওয়া উচিত চাকমাদের বিরুদ্ধে। তারা তা না করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিজোরামের রাজধানী আইজল থেকে এদেশে বসবাসরত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রবল সমর্থন দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিরোধী নানান কুৎসা ও প্রোপাগান্ডা দেখা যাচ্ছে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণ, বান্দরবানের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি।
চাকমাদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার সেই পুরাতন ভয়কে পুঁজি করে এখানকার জনগোষ্ঠীর তথাকথিত দলনেতা এবং কেএনএফের প্রধান নাথান বম প্রথমে সেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে সশস্ত্র সংগঠন এবং জাতির অধিকারের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চাঁদাবাজি অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। চাঁদাবাজির এই অর্থ দিয়ে অস্ত্র ক্রয় করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছে। এই চাঁদাবাজ ও অস্ত্রবাজদের রক্ষা করতে আইজল সমর্থন জানাচ্ছে। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ কুকি-চিন জনগোষ্ঠী কেএনএফের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে সমর্থন করে না এবং কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না কেএনএফ। সেটা সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট জানিয়িছে ৬টি জো জাতির প্রতিনিধিগণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবী ও অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, যে কোনো মহল কেএনএফকে দিয়ে দেশের ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা ও কুকি-চিনের এই সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য উপজাতীয় নেতা এবং কিছু বামপন্থী মহল দায়ী। সাধারণ পাহাড়িরা এখন বুঝে গেছে, উগ্রবাদী এইসব উপজাতীয় নেতা আসলে তাদের জিম্মি করে রাখতে চায়। চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যাদের মূল লক্ষ্য। অনেকেই এখন এই সন্ত্রাসী মহলের তান্ডব থেকে বেরিয়ে এসে শান্তি-সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে। তারা কোনো সন্ত্রাসী দলকে অন্তরে জায়গা না দিলেও মুখ খুলে তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলারও সাহস পায় না।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারের গত ১৭ বছরের নির্যাতন ভুলে যাবার সুযোগ নেই: আমিনুল হক
পাবনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রাক বড়দিন উৎসব অনুষ্ঠিত
পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
ধর্ম-বর্ণ নয়, সমান মর্যাদায় হোক নাগরিক পরিচয়: জোনায়েদ সাকি
এসবিএসি ব্যাংকের শরিয়াহ্ সুপারভাইজরি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
আ.লীগের হাতেও নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তুলে ধরেনি গণমাধ্যম!
ভারত বাংলাদেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা লুট করেছে : দুদু
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে সিটিজেন’স চার্টার অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত
মতিঝিলে বিশ্বমানের ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান শুরু আইসিডিডিআর,বি’র
স্বামীর অগোচরে স্ত্রী অন্য কারও সাথে কথা বলা প্রসঙ্গে?
চাঁদপুর মেঘনায় মালবাহী জাহাজে ৭ জনকে কুপিয়ে হত্যা, গুরুতর আহত ১
পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি
যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ