শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বাড়ছে, খতিয়ে দেখতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৩ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩২ পিএম | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪৪ পিএম

গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে শেখ মঞ্জুরুল হক নামের এক শিক্ষার্থী। কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা এই প্রথম নয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ যারা লাভ করে, তারা মেধার বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ও নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা তার পরিবারেরই নয়, দেশের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। একজন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু এবং একজন প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী তরুণের মৃত্যু একার্থে বিবেচ্য নয়। তরুণরা জাতির ভবিষ্যৎ, বিশেষত যারা শিক্ষিত ও মেধাবান। অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। চলতি বছর ১৭ মে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভির আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এর তিন দিনের মাথায় একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরেক শিক্ষার্থী সামীয়ুল রহমান আত্মহত্যা করে। একই তারিখে রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফী তাদের ঢাকার বাসায় আত্মহত্যা করে। ইতিপূর্বে প্রকাশিত ইনকিলাবের এক খবর থেকে জানা যায়, গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার হিসাবে ২০২২ সালে ৬০০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েরসহ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা পর্যায়ের শিক্ষার্থীও রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি শুধু অভিভাবকদের মধ্যেই নয়, বরং শিক্ষক, সমাজবেত্তা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এও লক্ষ করা যায়, লেখালেখি, কর্মশালা, সভা-সেমিনার এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা আত্মহত্যা নিরোধে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাট ইত্যাদির পাশাপাশি নানাবিধ ব্যর্থতা, মাদকাশ্রয় এবং চরম হতাশা থেকে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা। দৈশিক ও সামাজিক বাস্তবতা তাদের আত্মহত্যা ছাড়াও নানা ধরনের বিপথগামিতা, উগ্রতা ও সন্ত্রাসমুখিতার দিকে ধাবিত করছে। কেউ যখন কারণে-অকারণে বঞ্চনা, ব্যর্থতার শিকার হয়, জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণায় উপনীত হয়, তখন আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় এবং নিজের জীবন নিজেই হরণ করে। বঞ্চনা-ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠার মানসিক শক্তি এবং জীবনের মূল্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে তার পক্ষে আত্মহত্যার মতো গর্হিত পথ বেছে নেয়া সম্ভব হতে পারে না। উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের দেশেই কেবল নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও আত্মহননের প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। এটা দেশ বিশেষের সমস্যা যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে। জাতীয়ভাবে তো অবশ্যই, আন্তর্জাতিকভাবেও এর মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। আমাদের দেশে এক সময় দারিদ্র্যের কারণে অনেককে আত্মহত্যা করতে দেখা যেতো। প্রেমে ব্যর্থতা এবং কোনো কিছুর অপ্রাপ্তিতেও অভিমানবশত কেউ কেউ আত্মহত্যা করতো। এখন এসব কারণ ছাড়াও অন্যান্য কারণও যুক্ত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশেও যখন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে, তখন বলতে হবে, ‘সুখের অসুখ’ এর জন্য কম দায়ী নয়।

সমাজগবেষক ও ধর্মতত্ত্ববিদদের মতে, ধর্ম চর্চার অভাব এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় আত্মহত্যার প্রবণতা ও সংখ্যা বৃদ্ধির আসল কারণ। সব ধর্মেই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মের অনুশাসনের মান্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকলে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক প্রতিফলন ঘটলে কোনো দেশে বা সমাজেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে না। পরিতাপজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ৯২ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে, যাদের ধর্ম আত্মহননকে অমোচনীয় পাপ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, সে দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে। বলা প্রাসঙ্গিক, যেসব মুসলিম দেশে ইসলামী অনুশাসন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত সেসব দেশে আত্মহননসহ বিভিন্ন ঘৃণ্য অপরাধ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। আমাদের সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে ইসলামের চর্চা ও প্রতিফলন উঠে গেছে। পরিকল্পিতভাবে বরং ধর্মচর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ইসলামের বিষয়াশয় উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর প্রতিফল আমরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে প্রত্যক্ষ করছি। আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি তার একটি। প্রকৃত ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠাই শিক্ষার্থীসহ সকল পর্যায়ের মানুষকে আত্মহত্যা থেকে রেহাই দিতে পারে। যেহেতু আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক বৈকল্য বা সমস্যার সম্পর্ক আছে, সুতরাং মানসিক চিকিৎসার প্রসারও জরুরি। যথাযথ কাউন্সিলিং হতে পারে এর একটি কার্যকর চিকিৎসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, সেই মঞ্জুরুল হক নাকি মাদকে আসক্ত ছিল। প্রেমঘটিত ব্যাপার ছিল। সে দু’বছর পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে বলেও খবরে উল্লেখ আছে। অথচ, ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাব যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকতো তাহলে উল্লেখিত কোনো কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হতো না। উপযুক্ত কাউন্সিলিং তার এই চূড়ান্ত বিপথগামিতা থেকে তাকে রক্ষা করতে পারতো। ইনকিলাবের খবরে জানানো হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলে কাউন্সিলিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, অবিলম্বে সব হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা উচিত। তাদের আরো অভিমত, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। একই সঙ্গে সমাজে ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুশীলন ও প্রসার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি

পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি

যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত

যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত

১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান

১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান

জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা

জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা

স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান

মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই  আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি  বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ  কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

২০২৫ সালে নিম্নমাধ্যমিক-মাধ্যমিকে ৭৬ দিনের ছুটির তালিকা প্রকাশ

২০২৫ সালে নিম্নমাধ্যমিক-মাধ্যমিকে ৭৬ দিনের ছুটির তালিকা প্রকাশ

খুলনা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকার পথে যুক্ত হচ্ছে ট্রেন জাহানাবাদ

খুলনা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকার পথে যুক্ত হচ্ছে ট্রেন জাহানাবাদ

প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত গ্রহনযোগ্য নির্বাচন দিন

প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত গ্রহনযোগ্য নির্বাচন দিন

আশুলিয়ায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় আহত ৩

আশুলিয়ায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় আহত ৩

মাদারীপুরে পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

মাদারীপুরে পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব হলেন সরওয়ার আলম

প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব হলেন সরওয়ার আলম