বিচারকগণ যখন রাজনীতিবিদ
২৪ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২১ পিএম | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৭ এএম
সম্প্রতি অ্যাপিলেট ডিভিশনের একজন সম্মানিত বিচারকের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশে যে ডিসকোর্স চলছে তা হলো, বিচারকগণ কি রাজনীতিবিদ? দেশে এ ডিসকোর্স নতুন হলেও বিচারগণের কর্ম রাজনৈতিক প্রকৃতির কিনা এবং বিচারকগণ বিচারিক সিদ্ধান্তে pilitical allegiance এর প্রতিফলন দেখান কিনা তা নিয়ে বিংশ শতাব্দির প্রথম থেকেই সারাবিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে লিগ্যাল সমালোচকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। যে সব দেশে গণতন্ত্র ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গেছে, সে সব দেশের বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার তুলনায় উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশে বিচারকগণ একই স্বাধীনতা ভোগ করেন না। ইংল্যান্ডের সাথে তুলনা করলে আমেরিকার গণতন্ত্রকে এখনো উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশ বলতেই হয়। আমেরিকার কোর্ট রাজনৈতিক আনুগত্যের বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র কান্ট্রি লিগ্যাল প্রিন্সিপালের উপর ভিত্তি করে বিশেষ করে জুডিশিয়াল রিভিউতে ডিসিশান দিতে পারে কি না, এ বিষয়ে আমেরিকার জনমত বিভাজিত। ২০০০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ফ্লোরিডা অঙ্গ রাজ্যের ইলেক্ট্রনিক কাউন্টিং মেশিনে যে একষট্টি হাজার ভোট গণনা করা হয়নি, সেগুলো ম্যানুয়ালি গণনা করতে ফ্লোরিডা সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দিলে জর্জ ওয়াকার বুশ ক্যামেপেইন সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিল। George Waqar Bush ( Junior ) vs Al Gore মামলায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের মেজরিটি জাজ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, একষট্টি হাজার ভোট ম্যানুয়ালি গণনা করার ফ্লোরিডা কোর্টের রিকাউন্ট অর্ডার সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর Equal Protection Clause অনুযায়ী অসাংবিধানিক। অনেক একাডেমিক স্কলার ওই রায়ের পর সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, সেটা কোনো বিচারিক রায় ছিল না, বরং তা ছিল বিচারিক ভোট, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক রাজনৈতিক আনুগত্যের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন মাত্র। হার্ভার্ড ল স্কুলের প্রফেসর Alan Dershowitz বলেছিলেন, … that was cheating and violation of Judicial oath… পক্ষান্তরে ইংল্যান্ডের Royal Prerogative সংক্রান্ত জুডিশিয়াল Council for Civil Service Union vs Minister of Civil Service হাউজ অভ লর্ডস এর ল লর্ড গণ রাজনৈতিক আনুগত্যের বাইরে গিয়ে সরকারের বিপক্ষে জাজমেন্ট দিয়ে বলেছিলেন রয়্যাল প্রেরোগেটিভ জুডিশিয়াল রিভিউয়ের আওতাভুক্ত।
Separation of powers and independence of Judiciary-এর কিতাবী তত্ত্ব হচ্ছে, রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ কেউ কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনু: ২২-এ বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন মারপ্যাঁচে তা লাভ করতে সাবর্ডিনেইট জুডিশিয়ারীকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যদি ১/১১ রেজিমে নির্বাহী বিভাগের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিহিংসায় নির্বিকার ও নির্ভিক থেকে ডেসপারেইটলি কাজ না করতেন, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রাপ্তি সুদূরপরাহত ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সে স্বাধীনতার ফল ভোগ করছে, যদিও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন নিজের জন্য সে ফল ভোগ করতে পারেননি। সি¤পল মানহানির মামলায় তাকে একাধিকবার কাস্টডি ভোগ করতে হয়েছিল, একই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সারাদেশে একাধিক হয়রানিমূলক মামলা হয়েছিল, যা ছিল তার জন্য Irony of fate.
মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বিচারকগণের কর্ম রাজনৈতিক প্রকৃতির কি না বা বিচারকগণ রাজনীতিবিধ কি না তা ব্যাখ্যা করতে Attitudinal Approach এবং Strategic Approach সম্বন্ধে একটু আলোকপাত করা দরকার। Attitudinal Approach অনুযায়ী, একজন জাজ বিচারিক সিদ্ধান্ত দিতে নিজের আইডিওলজি ও বিবেকের উপর নির্ভর করেন। পক্ষান্তরে Strategic approach অনুযায়ী, একজন জাজ সিদ্ধান্ত নিতে আইনসভা, নির্বাহী সভা ও জনগণের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করেন। এ প্রক্রিয়ায় বিচারকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক রূপ লাভ করে। সিটিজেন রাইটকে সমুন্নত রাখতে কোর্ট প্রহরীর মতো কাজ করে। রিট বা জুডিশিয়াল রিভিউয়ের পরিধি দিনে দিনে বাড়ছে সারা বিশ্বে। স¤পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক পলিসি ম্যাটারে খুব কম ক্ষেত্রই আছে, যা জুডিশিয়াল রিভিউর আওতামুক্ত। যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক পলিসি ম্যাটার বাস্তবায়ন কোর্ট কর্তৃক ইনফোর্সেবল নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮, ক্লজ ২ অনুযায়ী মৌলিক পলিসি নতুন আইন তৈরি করতে ও সংবিধানের ব্যাখ্যায় গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ (যা কোর্ট কর্তৃক ইনফোর্সিবল) এবং ফান্ডামেন্টাল পলিসিগুলো একে অপরের সাথে ইন্টারলকে আবদ্ধ। সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট Alga Teles vs Bombay Municipal Corporation মামলার অবজার্ভেশনে বলেছে মৌলিক অধিকার ও রাস্ট্রের মৌলিক নীতি অংগাংগীভাবে জড়িত। প্রথমটাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়টাকে এনফোর্স করা যায় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জুডিশিয়াল রিভিউর পরিধি সরকারের মৌলিক পলিসি পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। জুডিশিয়াল রিভিউ রাষ্ট্রের পলিসি মেকিংকে নতুন রূপ দিতে পারে। এজন্যই বলা হয়, সাংবিধানিক কোর্ট রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সুপ্রিম কোর্টে জুডিশিয়াল রিভিউর ক্ষেত্র যত বাড়বে, বিচারকদের রাজনৈতিক প্রকৃতি ও ক্ষমতা ততই বাড়বে। The judicial power is political phenomenon as বিষয় জন্মগতভাবেই আইন রাজনৈতিক। সে অর্থে কোর্ট হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কোর্ট যে ক্ষমতা ভোগ করে তা পলিটিক্যালি ডিসাইসিভ, এটাই সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
২০২৫ সালে নিম্নমাধ্যমিক-মাধ্যমিকে ৭৬ দিনের ছুটির তালিকা প্রকাশ
খুলনা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকার পথে যুক্ত হচ্ছে ট্রেন জাহানাবাদ
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত গ্রহনযোগ্য নির্বাচন দিন
আশুলিয়ায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় আহত ৩
মাদারীপুরে পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব হলেন সরওয়ার আলম
তোমাদের হাতে উড়তে থাকবে সমৃদ্ধ স্বনির্ভর বাংলাদেশের বিজয় কেতন - সাভার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোঃ মঈন খান
দৌলতপুরে পুলিশের মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান : গ্রেফতার-২