গণতন্ত্রের অধিকার হরণ করা হচ্ছে উন্নয়নের কথা বলে
২৭ আগস্ট ২০২৩, ০৮:০৪ পিএম | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০২ এএম
গণতন্ত্রের স্টেকহোল্ডার হলো সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের সমর্থনে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে রাষ্ট্রশাসন করে। জনগণের সমর্থন বা আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে, যদি সে নির্বাচন হয় সর্ব প্রকার প্রভাবমুক্ত, গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন। কিন্তু সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের বর্ণনামতে, জনগণের কাক্সিক্ষত নির্বাচন চলে গেছে এখন ‘নির্বাসনে’। জনগণের ভোটভিত্তিক নির্বাচন হয় না, টেলিভিশনের পর্দাই পাস ফেল নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির লিগ্যাল বা সাংবিধানিক নাম হচ্ছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। অথচ, রাষ্ট্রের মালিক তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে অসহায়। এ জন্য (১) জনগণের অসচেতনতা অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা বার বার ধোকা খাওয়ার হতাশা, (২) গণতন্ত্রের প্রাকটিসবিমুখ রাজনৈতিক দল, (৩) উদ্দেশ্যবিহীন সংগঠিত রাজনৈতিক কর্মী বাহিনী।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় আঠারো কোটি। এর মধ্যে সচেতন মানুষ রয়েছে, কিন্তু সংখ্যাধিক্যই অসচেতন তাদের সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে। অন্য একটি শ্রেণি রয়েছে, যারা সংখ্যায় কম হলেও কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাবে নির্বাচনী পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ জন্য দলের নমিনেশন বাণিজ্যোর একতরফা মার্কেট দখল করেছে হাতে গোনা দুই একটি দল। ফলে নমিনেশন বাণিজ্যে টাকার খেলায় সমাজের ভালো লোক, দলের নিবেদিতপ্রাণ, ক্লিন ইমেজের লোকেরা ব্যাংক লুটেরা ও মানিলন্ডারিং হোতাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। নমিনেশন বাণিজ্যে ব্যাংক লুটেরা দিন দিন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বিধায় পার্লামেন্টে রাজপথের রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নমিনেশন বাণিজ্য সফল হওয়ার প্রধান কারণ, এ দেশের মানুষ প্রার্থী চেনে না, চেনে মার্কা এবং এ কারণেই ব্যাংকলুটেরারা রাজনীতি না করেই জনগণের প্রতিনিধি বনে যাচ্ছে টাকার বিনিময়ে। তারা নির্বাচনী মার্কা ক্রয় করে, জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয় না।
বড় বড় রাজনৈতিক দল মেধার ক্রমবিকাশ ও রাজনীতি জ্ঞানসম্পন্ন একটি কর্মীবাহিনী তৈরি করার পরিবর্তে ক্ষমতা ভোগের আকাশচুম্বী প্রত্যাশায় তাদের বিভোর করে তোলা হয়। ফলে, ক্ষমতার পরিবর্তন হলে দলের নীতি আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে হাট, ঘাট, বাজার, পরিবহন সেক্টর প্রভৃতি দখল ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে শুরু হয় অবিরাম লুটপাট। প্রতিযোগিতা শুরু হয় মানিলন্ডারিং এবং সম্পদপ্রাপ্তির। একটি রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার জন্য নি¤œবর্ণিত বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে। যথা: (১) অব্যাহতভাবে জ্ঞান অর্জন, (২) প্রশিক্ষণ, (৩) স্থানীয় ও জাতীয় সমস্যা নিরসন করার জন্য ক্রমাগত চিন্তাশীল হওয়া এবং (৪) গবেষণা।
এই চারটি বিষয়ে পারদর্শী হওয়া ছাড়া কর্মীবাহিনী লুটপাটের প্রতিযোগিতায় নামা ছাড়া জনগণের সমস্যার সমাধানে কোনো কাজেই আসে না। একটি রাষ্ট্রকে সমস্যামুক্ত করার জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অনেক ভূমিকা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু দল যখন ব্যক্তি মালিকানায় অর্থাৎ Limitted Company-তে পরিণত হয়, তখন দল পরিচালনায় কর্মীদের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্টের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি করার সময় শিক্ষক পড়িয়েছেন, Great Organigation is Run by it’s Rules, on the other hand Private organization is Run by the decision of the Owner. এ মতবাদ অনুযায়ী একটি বড় সংগঠন তার জঁষবং অর্থাৎ সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা, কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন দলে কর্তার ইচ্ছায় কর্মসাধন হয় বলে কর্মীরা দল পরিচালনায় অংশগ্রহণমূলক অবদান দলে রাখার সুযোগ পায় না। অন্যদিকে চাটুকারদের তোপের মুখে নিবেদিত কর্মীবাহিনী গড়ে উঠতে পারে না।
ক্রমাগত সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার নাম রাজনীতি এবং তারই অপর নাম আন্দোলন। রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে নি¤œমুখী অর্থাৎ নি¤œস্তর পর্যন্ত সাংগঠনিক বিন্যাস থাকতে হবে, যারা নিজেরাই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতি হয়ে গেছে কেন্দ্রভিত্তিক তথা ঢাকাকেন্দ্রিক। একটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থানীয় কর্মীরা নিতে পারেন না। ঢাকার নেতাদের যেভাবেই হোক বাগ মানিয়ে নমিনেশন নিয়ে এলাকায় পৌঁছতে পারলেই স্থানীয় সকলের দায়িত্ব হয়ে পড়ে প্রার্থীকের খুশি রাখা। প্রার্থী হওয়ার জন্য স্থানীয় প্রর্যায়ের নেতাকর্মীদের পিছনে এখন আর ধর্না দিতে হয় না, দরকার হয় টাকার বস্তা, যা ঢাকাতেই বিলি-বণ্টন করলে মনবাসনা পূর্ণ হয়। ক্ষমতাসীন সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নমিনেশন পদ্ধতি আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে স্থানীয় জনগণকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রমুখী করে স্থানীয়দের অধিকার বঞ্চিত করেছে। দলীয় নমিনেশনে রাজনৈতিক মার্কায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট প্রদানে এ দেশের জনগণ অভ্যস্থ নয় বিধায় সঙ্গতকারণেই জনগণ এ পদ্ধতি মেনে নেয় নাই, যার অবসান হওয়া আবশ্যক।
রাজনীতির গুণগতমান বৃদ্ধিসহ গতিশীল হওয়া আবশ্যক। গুণগতমান বৃদ্ধি পেলে পাল্টাপাল্টি অস্বচ্ছ ও আনহেলদী প্রতিযোগিতায় স্পিরিট কমে আসতো, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তা করা হয় পুলিশ দিয়ে, নতুবা হামলা-পাল্টা হামলা অথবা গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত করার মাধ্যমে।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের কর্মীবাহিনীর চেয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সাংগঠনিক ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদলে গড়ে উঠেছে উপমোহাদেশের প্রশাসনিক পদ্ধতি। এখানে প্রশাসন জনমুখী নয়, বরং জনগণকে প্রশাসনমুখী হতে হচ্ছে। প্রশাসনের নিকট জনপ্রতিনিধিরা অসহায়, এমন বক্তব্য পার্লামেন্টেই উপস্থাপিত হয়েছে অনেক বার।
যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবন। যে থাকে ক্ষমতায় সেই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে করে কলুষিত। মানুষের অধিকারকে হরণ করা হয় উন্নয়নের দোহাই দিয়ে। উন্নয়নের ‘শাক’ দিয়ে গণতন্ত্রের ‘মাছ’ ঢেকে দেয়া ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আমেরিকা-বৃটেনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বা ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, অনুরূপ ভারতীয় উপমহাদেশেতো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন রাশিয়া, চীনসহ ক্যমুনিস্ট রাষ্ট্রে গড়ে উঠে নাই। অধিকন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মকা-ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতায় থাকতেই হবে, এ প্রবণতা তখনই একরোখা দাবিতে পরিণত হয়, যখন ক্ষমতাসীনরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, রাষ্ট্রের কর্মচারীরা পেশাগত দায়িত্ব ভুলে যখন দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। হালে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা চলছে একপেশে অর্থাৎ তাদের সেবা পাচ্ছে সরকারি ঘরনার লোকেরা। অথচ, সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আ.লীগের হাতেও নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তুলে ধরেনি গণমাধ্যম!
ভারত বাংলাদেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা লুট করেছে : দুদু
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে সিটিজেন’স চার্টার অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত
মতিঝিলে বিশ্বমানের ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান শুরু আইসিডিডিআর,বি’র
স্বামীর অগোচরে স্ত্রী অন্য কারও সাথে কথা বলা প্রসঙ্গে?
চাঁদপুর মেঘনায় মালবাহী জাহাজে ৭ জনকে কুপিয়ে হত্যা, গুরুতর আহত ১
পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি
যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা