প্রতারণার ফাঁদ : সরকারকে কঠোর এবং মানুষকে সচেতন হতে হবে
২৮ আগস্ট ২০২৩, ০৯:১৭ পিএম | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১১:৩১ পিএম
অল্প বিনিয়োগে কম সময়ে অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করার ঘটনা নতুন নয় আমাদের দেশে। গ্রামে-গঞ্জে একদা প্রতারকচক্রের এই ধরনের প্রতারণার কথা প্রায়ই শোনা যেতো। সংঘ-সমিতি খুলে, এনজিও বানিয়ে বিপুল লাভের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক সময় লাপাত্তা হয়ে যেতো এসব সমিতি ও এনজিও’র কর্তাব্যক্তিরা। বলা হতো, হায় হায় কোম্পানি টাকা মেরে পালিয়ে গেছে। সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা টাকা মেরে পালিয়ে চলে যেতো ভারতে। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যেতো না। এখন গ্রামগঞ্জ ছাড়িয়ে বিভিন্ন শহরেও প্রতারকচক্রের ফাঁদ বিস্তৃত হয়েছে। প্রতারকরা আকর্ষণীয় নামের নানা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি খুলে দ্বিগুণ-তিনগুণ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ, এমন কি শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকেও টাকা হাতিয়ে নিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচার করছে। নিজেরাও পালিয়ে যাচ্ছে। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) খুলে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অনেক ঘটেছে। ডেসটিনির কথা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসায় ২০০০ সালে এর যাত্রা শুরু। ২০১২ সালে পর্যন্ত এ কোম্পানি প্রায় ৫ হাজারে কোটি টাকা তুলে নেয়। তখন ডেসটিনির ক্রেতা, পরিবেশক ও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ। ২০০৯ সালে ইউনিপেটুইউ নামের সাবেক কোম্পানি মাসে দ্বিগুণ লাভের লোভ দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। এর আগে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) নামের কোম্পানি ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে এক দশকে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। যুবকের ৩ লক্ষাধিক গ্রাহকের দাবির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপর। প্রতারকচক্র এখন ডিজিটাল মাধ্যমেও প্রতারণার জাল বিস্তার করে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করছে। ২০১৮ সালে বিপুল ছাড়ে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রীর কথা বলে ই-কর্মাস ব্যবসায় নামে ইভ্যালি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ইভ্যালির কাছে গ্রাহকদের পাওনার পরিমাণ ১১০০ কোটি টাকা এবং ধামাকার কাছে ৮০৮ কোটি পাওনা আছে। এ ধরনের আরও ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের বহু টাকা আটকা আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রতারিত গ্রাহকদের হিসাব থেকে জানা যায়, এমএলএম ও ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রায় ২২০০০ কোটি টাকা আটকে আছে। এদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় এককোটি সম্প্রতি মেটাভার্স ফরেন একচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) নামের দুবাইভিত্তিক একটি কানাডিয়ান কোম্পানি মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১১০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বলে দাবি করলেও বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রা সূচক, কমোডিটি স্টক ও ক্রিপ্টো মার্কেটের ট্রেডিং ব্রোকারের কাজ করতো। আসলে পুরোটাই একটি জুয়ার প্ল্যাটফর্ম। এমটিএফই’র তথ্য মতে, তার অ্যাপে বাংলাদেশ থেকে অ্যাকাউন্ট আছে মোট আট লাখ। এছাড়া কাতার, দুবাই, ওমান, সউদী আরব প্রভৃতি দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদেরও অনেকের বিনিয়োগ আছে। অন্যান্য অনেক লোকজনও এর প্রতারণার শিকার হয়েছে। এখানে এর কোনো অফিস ছিল না। অথচ, জানুয়ারি মাসে এর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির তরফে ‘ঘরে বসে আয় করার সহজ পথ’ বলে প্রচারণা চালানো হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদিতে। বিভিন্ন ভিডিও ও বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এতে আকৃষ্ট হয়েছে দলে দলে মানুষ। বিশেষ করে, বেকার যুবকরা এখানে অ্যাকাউন্ট খোলে এবং যথারীতি প্রতারণার শিকার হয়। এই হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণার জন্য প্রতারক চক্রতো অবশ্যই দায়ী, তার সঙ্গে লোভী বিনিয়োগকারীরাও সমান দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করলে স্বল্পতম সময়ে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ লাভ হবে, কোনো পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক দামে কেনা যাবেÑ এসব কথা কোনো বুদ্ধিমান-বিচক্ষণ ব্যক্তির বিশ্বাস করার কথা নয়। অবিবেচনা ও উদগ্র লোভই কেবল এমন কাজে কাউকে তাড়িত করতে পারে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে একই ধরনের প্রতারণার শিকার হতে আমরা এদেশের মানুষকে দেখেছি। তারা সর্বস্ব হারিয়েছে। অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। লোভের বশবর্তী হয়ে এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতছাড়া হয়ে গেলো, তার দায় কার? দায় অবশ্যই তথাকথিত বিনিয়োগকারীদেরও বহন করতে হবে। প্রবাদে আছে, লোভে পাপ, পাপে মরণ। একথা জানা থাকলেও অনেকে মানতে চায় না, যার খেসারত তাদের দিতে হয়। এ ধরনের প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পেতে হলে লোভ সংবরন করতে হবে।
একশ্রেণীর সংঘ-সমিতি, এনজিও, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি এবং ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা, মানুষের অর্থ আত্মসাৎ, পাচার দুঃখজনকই নয়, উদ্বেগজনকও বটে। এ ধরনের সমিতি, কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক সময় ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের রেজিস্ট্রেশন, অনুমোদন ও প্রশ্রয় দেয়। যুবক, ডেসটিনি, ইভ্যালি ইত্যাদি কোনো গোপন সংগঠন ছিল না। এদের কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব ছিল সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, দফতর ও পুলিশের। বাস্তবতা থেকে এটা স্পষ্ট, তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। করলে প্রতারণার ফাঁদ এত প্রকাশ্য ও বিস্তৃত হতে পারতো না। ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের নামে যে সব প্রতারণা হচ্ছে, বিটিআরসি তার দায় এড়াতে পারে না। আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনী মাটির নিচ থেকে আসামি ধরতে পারে বলে কথিত আছে। অথচ, বড় বড় কোম্পানিখুলে চোখের সামনে প্রতারকচক্র প্রতারণা করে যাচ্ছে, তারা কিছু করতে পারছেনা না। বলা হচ্ছে, এসব প্রতারণার দায় সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ নিতে চাইছে না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, একের পর এক যেসব প্রতারণা হচ্ছে, তার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে আরো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা তার সঙ্গে একমত। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমরা আশা করব। একই সঙ্গে আমরা আশা করবো, লোভে পড়ে কেউ যেন প্রতারিত না হয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পাবনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রাক বড়দিন উৎসব অনুষ্ঠিত
পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
ধর্ম-বর্ণ নয়, সমান মর্যাদায় হোক নাগরিক পরিচয়: জোনায়েদ সাকি
এসবিএসি ব্যাংকের শরিয়াহ্ সুপারভাইজরি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
আ.লীগের হাতেও নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তুলে ধরেনি গণমাধ্যম!
ভারত বাংলাদেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা লুট করেছে : দুদু
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে সিটিজেন’স চার্টার অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত
মতিঝিলে বিশ্বমানের ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান শুরু আইসিডিডিআর,বি’র
স্বামীর অগোচরে স্ত্রী অন্য কারও সাথে কথা বলা প্রসঙ্গে?
চাঁদপুর মেঘনায় মালবাহী জাহাজে ৭ জনকে কুপিয়ে হত্যা, গুরুতর আহত ১
পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি
যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত